।। মুফতি মকবুল হোসাইন কাসেমী ।।
কুরবানি হলো ইসলামের একটি শি’য়ার বা মহান নিদর্শন। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা’আলা নির্দেশ দিয়েছেন-
অর্থাৎ- ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কুরবানি কর।’ (সূরা আল-কাউসার- ২)।
হযরত আদম আ. হতে প্রত্যেক নবীর যুগে কুরবানি করার ব্যবস্থা ছিল। যেহেতু প্রত্যেক নবীর যুগে এর বিধান ছিল সেহেতু এর গুরুত্ব অত্যধিক। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
অর্থাৎ- আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানির নিয়ম করে দিয়েছি; তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করে। (সূরা আল-হাজ্জ- ৩৪)।
পাশাপাশি কুরবানি একটি আবশ্যকিয় বিধান। কুরবানি করা ওয়াজিব। হযরত আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (স.)এরশাদ করেছেন-
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানি করবে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে। (মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ)।
কুরবানির শরয়ী মর্যাদা সম্পর্কে ফকিহগণের মত হচ্ছে- ইমাম নখয়ী, ইমাম আবু হানিফা, আবু ইউসুফ প্রমুখ কুরবানি করাকে সাধারণ সামর্থ্যবান মুসলমাদের জন্য ওয়াজিব বলেছেন। কিন্তু ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদের মতে কুরবানি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। অপরদিকে কুরবানি একটি ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। কুরবানির ফজিলতের ব্যাপারে কোরআন এবং হাদীসে অনেক বর্ণনা এসেছে।
হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন-
অর্থাৎ- আদম সন্তান (মানুষ) কুরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করা (কুরবানি করা) অপেক্ষা আল্লাহর নিকটে অধিক প্রিয় কাজ করে না। নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন (কুরবানি দাতার পাল্লায়) কুরবানির পশু, এর শিং, এর লোম ও এর খুরসহ এসে হাজির হবে এবং কুরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পতিত হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তায়ালার নিকট সম্মানিত স্থানে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা কুরবানি করে সন্তুষ্টচিত্তে থাকো। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)।
আরও পড়তে পারেন-
ওজন দরে গরু ক্রয় করে কুরবানী করা জায়েয হবে কি?
রাসূলুল্লাহ (সা.)এর দাম্পত্য জীবনে খাদিজা (রাযি.)এর ভূমিকা
কুরবানী এলেই তাদের পশুপ্রেম বেড়ে যায়!
ইসলামে কুরবানীর বিধান সুস্পষ্ট: এর বিকল্প অন্য কিছুতে হতে পারে না
কুরবানীর ঐতিহাসিক পটভূমি এবং দার্শনিক তাৎপর্য
প্রাণঘাতী বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এ সময়ে ঘনিয়ে আসছে কুরবানি। চাঁদের হিসাব অনুযায়ী আগামী ১ আগস্ট বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হবে এ করবানি। এবারের কুরবানির রূপরেখা কেমন হবে? মহামারির এ সময়ে মানুষের কুরবানির ভাবনা কেমন হওয়া উচিত, এ নিয়ে ইতিমধ্যে চলছে অনেক জল্পনা-কল্পনা। চলছে আলোচনা-টকশো।
করোনায় কুরবানি আদায়ে মানুষের করণীয় কী- এই নিয়ে নানা জন নানা উদ্দেশ্যে আলোচনা ও তর্ক তৈরি শুরু করেছেন। নাস্তিক্যবাদি ধ্যান-ধারণার ও ইসলামবিদ্বেষীরা বলছেন- কুরবানীর টাকা পশুর পিছনে খরচ না করে দান করে দেয়ার জন্য। নাউযুবিল্লাহ! নাস্তিক ও ইসলামবিদ্বেষীদের অজ্ঞতা, মূর্খতা তাদের বিবেক, আক্বলকে সংকীর্ণ করে দিয়েছেন।
ইসলামিক স্কলারদের মতে, এ দাবি একেবারেই হাস্যকর এবং অযৌক্তিক। কারণ, প্রথমত এটি মুসলিমদের এমন একটি ইবাদত, যা বছরে একবার হয়ে থাকে। কুরবানির সঙ্গে প্রায় সব মুসলিমদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। যারা কুরবানি দিতে পারেন তাদের যেমন সম্পৃক্ততা রয়েছে, তেমনি যারা কুরবানি দিতে পারে না; এমন সব অভাবি মানুষের সম্পর্কও রয়েছে কুরবানির সঙ্গে। তারা সারা বছর গরু/খাশির গোস্ত কিনে খেতে পারেন না। কুরবানির সময়ই তারা চাহিদা মিটিয়ে গোশ্ত খেতে পারেন। আর এতে ধনী-গরিবের মিলন হয়, বৈষম্য দূর হয়। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ও আন্তরিকতা তৈরি হয়। মানবিকতাবোধের চর্চা হয়। কুরবানীর গোস্ত আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের মাঝে বিলানোর ফলে তাদের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির চর্চা হয়। এসব যুক্তিরও অনেক ঊর্ধ্বে হল- পবিত্র কুরবানী ইসলামের বিধান। সুতরাং এর বিকল্প কিছু ভাবার বা তর্ক তোলার এখতিয়ার কোন মুসলমানের নেই।
কুরবানি উপলক্ষ্যে পশু পালনে বিনিয়োগকারী এমন অনেক ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা কোটি কোটি টাকা কুরবানি উপলক্ষ্যে পশুতে বিনিয়োগ করেছেন। তাদের বিষয়টিও ভেবে দেখতে হবে। কেননা কুরবানির একটি মৌসুমের ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে তারা বছরব্যাপী জীবিকা অর্জন করে থাকেন। এতে জাতীয় অর্থনীতির গতি সঞ্চার হয় এবং বিপুল কৃষক ও গরীব মানুষের আয়ের পথ তৈরি হয়।
সুতরাং কুরবানি হচ্ছে- ইবাদত, গরিব-দুঃখীর অধিকার, ব্যবসায়ী ও খেটে খাওয়া মানুষের জীবন-জীবিকায় বিনিয়োগ। তাই এসব বিবেচনায় কুরবানি বন্ধ নয়, কুরবানির পশুর হাটও বন্ধ নয়, বরং যথাযথ স্বাস্থ্য নিরাপত্তার মাধ্যমে এটি অব্যাহত রাখাই জরুরি। আল্লাহ আমাদের সকলকে ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ বিধান যথাযথ ভাবে আদায়ের তাওফিক দান করুন। আমীন।।
– মুফতি মকবুল হোসাইন কাসেমী, ফারেগে দারুল উলূম দেওবন্দ এবং শিক্ষা সচিব- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা।
উম্মাহ২৪ডটকম:এমএমএ