আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা’ হলো- হায়াত, মউত, রিযিক ও রোগব্যাধি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। আল্লাহ যদি হায়াত রাখেন, তাহলে কেউ মারতে পারবে না, আর আল্লাহ যদি কাউকে মারতে চান, কেউ তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। আল্লাহ যাকে রোগব্যাধিতে আক্রান্ত করতে চান, লকডাউনসহ কোন কিছুই তাকে সুস্থ রাখতে পারবে না।
এই আক্বিদা এতো শক্ত যে, এখানে ‘কিন্তু’, ‘যদি’ বা ‘তবে’ এর মাধ্যমে মুনাফিকি করার কোন অবকাশ নেই। আল্লাহ তাআ’লা যদি মউত বা রোগব্যাধি আমার ভাগ্যে না রাখেন তাহলে হাজার অসতর্কতার পরও আমি করোনায় আক্রান্ত হবো না।
বর্তমানে কি আমাদের অন্তরে এই আক্বিদা আছে? তার উত্তরে যদি বলা হয় যে, হ্যাঁ, যা হয় সব আল্লাহর হুকুমেই হয়; তবে সতর্কতা অবলম্বনে তো কোন বাধা নেই? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বাধা নেই। তবে, হাতে মোজা মুখে হুফা বা টুফার নাম সতর্কতা নয়। জেনে নিন সতর্কতা কাকে বলে? সুন্নাত তরীকায় চলার নামই হলো সতর্কতা। রাসূল (সা.) জীবনের কোন এক মূহূর্তেও অসতর্ক অবস্থায় চলেননি, তাই তার অনুস্মরণে চলার নামই সতর্কতা।
আর সেটা কেমন-
১, সর্বদা অজুর সাথে থাকতে হবে।
২, মেসওয়াকের অভ্যাস রাখতে হবে।
৩, দাড়ি রাখতে হবে।
৪, চলা ফেরায় মাথা ঢেকে রাখতে হবে।
৫, পানাহার বসে করতে হবে।
৬, খাওয়ার আগে পরে হাত ধৌত করতে হবে।
৭, পেশাব পায়খানার সময় মাথা ঢেকে রাখতে হবে।
৮, পেশাব পায়খানার পরে ঢিলা ব্যবহার করতে হবে।
৯, অতঃপর পানি দ্বারা ইসতেঞ্জা করতে হবে।
১০, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে জামাতের সাথে আদায় করতে হবে।
১১, দৈনিক তেলাওয়াত করতে হবে।
১২, যে কোন কাজ আরম্ভ করতে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়তে হবে।
১৩, পানাহার ডান হাতে করতে হবে।
১৪, যে কোন মুসলমানের সাথে সাক্ষাৎ হলে সালাম মুসাফাহা করতে হবে।
১৫, শরীর, পোষাক ও ঘর ময়লা মুক্ত রাখতে হবে।
১৬, মহল্লার রোগীর ইয়াদত/ খেদমত করতে হবে।
১৭, অলস হয়ে বসে থাকতে পারবে না, দৈনিক কিছু কাজ করতে হবে।
১৮, অতিরিক্ত ঘুম ও পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে
১৯, খাদ্য দ্রব্য ঢেকে রাখতে হবে
২০, ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বিসমিল্লাহ ও মাসনুন দোয়া পড়তে হবে
২১, যানবাহনে উঠতে ও সফর করতে বিসমিল্লাহ ও মাসনুন দোয়া পড়তে হবে
২২, সুন্নাত তরীকায় ঘুমাতে হবে
২৩, মহিলাদের পর্দায় থাকতে হবে।
২৪, নিয়মিত বাড়তি নখ কাটা ও শরীরের অবাঞ্ছিত কেশ পরিষ্কার করতে হবে।
২৫, বিনা প্রয়োজনে দোকানপাট বা বাজারে আড্ডা দেওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে, ইত্যাদি।
আরও পড়তে পারেন-
করোনাভাইরাস: আল্লাহর রহমত ও দয়া পেতে হলে হক্ব ও সৎকর্মে দ্রুত ফিরে আসা জরুরী
যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ বিরোধী দাঙ্গা: পেন্ডেমিক পরবর্তি সমাজ বিবর্তনের পূর্বাভাস
মওলানা বরকতুল্লাহ আমাদের ইতিহাসের কে হন?
কুরআন-হাদীসের আলোকে মাযহাব না মানার ক্ষতি
সফল জীবন ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ার সহজ উপায়
এভাবে জীবনযাপনের নামই সতর্ক জীবনযাপন। যদি এভাবে চলতে পারি, ইনশাল্লাহ বিপদ মুক্ত থাকবো।
সতর্কতার নামে মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, দোকানপাট, কলকারখানা ও যানবাহন বন্ধ করে মানুষের রুজি-রোজগার খতম করা এবং মানুষকে ঘরে আবদ্ধ রেখে মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা সতর্কতা নয়, বরং এটা মনবতা বিরোধী, ইসলাম বিরোধী, বিবেক ও সভ্যতা বিরোধী প্রোগ্রাম।
এতো বড় মারাত্মক জুলুম নির্যাতন ও সংক্রমণের মত এক অবাস্তব কথার উপর সারা পৃথিবী ঐক্য মত হয়ে যাওয়া অতীতে কখনো হয়নি।
খেলাফতে রাশেদার যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত অনেক এলাকায় মহামারীর আক্রমণ হয়েছে। সে সময় অফিস আদালত, ব্যবসা বাণিজ্য ও শিক্ষা দীক্ষাসহ সবই স্বাভাবিক ছিল। তখন শুধু একটুকু সতর্কতা অবলম্বন করা হতো যে, এক শহরের লোক অন্য শহরে যাতায়াত থেকে বিরত থাকত।
অনেক উলামায়ে কেরাম বিশ্ব ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রাসূল (সা.)এর হাদীস (لاعدوى)
(সংক্রমণ বলতে কিছুই নেই) এর অনুবাদ করছেন’ আল্লাহ তা’আলার হুকুম ছাড়া সংক্রমণ হয় না’ “এটা ভুল”। যদি কোন হাদীসে সংক্রমণ হওয়ার কথা উল্লেখ থাকত, তাহলে দুই হাদীসের তাতবীকে উল্লেখিত অনুবাদ ঠিক হত, কিন্তু لاعدوى এর বিপক্ষে এধরণের কোন হাদীস নেই।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন- فر من المجذوم فرارك من الاسد এবং لا يورد ممرض على مصح
দ্বারা তো সংক্রমণের ওজুদ বুঝা যায়। কিন্তু না তা নয়, বরং মাহামারীতে অনেক লোক আক্রান্ত হয়ে থাকে। তাই কেউ যদি রোগীর নিকট বা লোক সমাগমে গিয়ে আক্রান্ত হয়, তাহলে দুর্বল ঈমানদার ব্যক্তি মনে করবে যে, আমি সংক্রমণের কারণে আক্রান্ত হয়েছি। এই বাতিল আক্বিদা যেন অস্তিত্ব লাভ না করে, তাই বলা হয়েছে- فر من المجذوم فرارك من الاسد
এবং لا يورد ممرض على مصح
তিরমিজি শরীফের হাদীসের আলোকে ঐ ভুল ব্যাখ্যার কোন অবকাশই থাকে না। হাদীসটি হল এই-
عن عبدالله بن مسعود رضي الله عنه قال قام فينا رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال لايعدى شىء شيا فقال اعرابى يارسول الله البعير اجرب الحشفة بدبنه فيجرب الابل كلها فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم فمن اجرب الاول لاعدوى ولاصفر خلق الله كل نفس فكتب حياتها و رزقها و مصاءبها,(ترمذى-٢-،٣٨)
সারাংশঃ হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাযি.) বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, কোন রোগব্যাধি সংক্রমনের কারণে হয় না। তখন এক গ্রাম্য সাহাবী (রাযি.) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! অনেক সময় এক অসুস্থ উট পালে আসলে সব উট অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাঁর উত্তরে রাসূল (সা.) বললেন, প্রথম উটটাকে কে অসুস্থ বানিয়েছিল? এরপর বলেন- لاعدوى “কোন সংক্রমণ নেই”।
আল্লাহ তা’আলা সব জীবকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তাক্বদীরে তার হায়াত, রিজিক ও মসীবত লিখে দিয়েছেন।
উল্লেখিত হাদীসের ব্যাখ্যা তীবী, নওভী, আওজয ও ফতহুল বারীসহ অনেক ব্যাখ্যাগ্রন্থে জমহুর উলামায়ে উম্মতের অভিমত যাহিরে হাদীসের পক্ষে। এই হাদীস দ্বারা রাসূল (সা.) জাহেলী যুগের ও বর্তমান ডাক্তারদের “সংক্রমণ” এর ভুল আক্বিদাকে খন্ডন করেছেন। فمن اعدى الاول দ্বারা পরিষ্কার ভাবে বুঝা যায়।
বুখারী শরীফের এক হাদীসে বর্ণিত রয়েছে যে, নাওয়াস নামের জনৈক ব্যক্তি দুইজন মিলে তারা উটের ব্যবসা করত। একদিন তার সাথী মহামারীতে আক্রান্ত এক উট বাজারে নিয়ে আসলে হযরত ইবনে উমর (রাযি.) সেটা তাঁর থেকে খরিদ করে নেন। অতঃপর নাওয়াস সাথীর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, উটটি কোথায়? তাঁর সাথী আনন্দে বলল, আমি বিক্রি করে ফেলেছি। তখন নাওয়াস জিজ্ঞেস করলেন কার কাছে বিক্রি করেছ? সাথী বলল, এই ধরনের অবয়ব বিশিষ্ট এক লোক খরিদ করেছেন। তখন নাওয়াস বললেন, সর্বনাশ তুমি এটা কি করেছ, তিনি তো ইবনে উমর (রাযি.)। নাওয়াস তাড়াতাড়ি ইবনে উমর (রাযি.)এর বাড়ীতে গেলেন। বললেন, হযরত! আমার সাথী আপনাকে চিনেনি। এই উট মহামারীতে আক্রান্ত। ইবনে উমর (রাযি.) বললেন, “ঠিক আছে নিয়ে যাও”। যখন নাওয়াস উট নিয়ে যেতে লাগলেন, তখন ইবনে উমর (রাযি.) বললেন, উটটি রেখে যাও, আমি রাসূল (সা.) এর ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট; لاعدوى তথা কোন সংক্রমণ নেই।
হাদীসটি এই-
তারিক ইবনে শিহাব (রাহ.) বলেন, আমরা কুফায় আবু মুসা আশআরী (রাযি)এর কাছে হাদীস পড়তে গেলাম। তিনি বললেন, চলে যাও এখানে মহামারী আছে, পরিবেশ ভালো হলে পরে এসো! কারণ, তোমাদের কেউ যদি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাও, তাহলে বলবে, যদি এখানে না আসতাম তাহলে আক্রান্ত হতাম না। তবে তোমাদের কারো যদি এই ধারণা না থাকে, তাহলে তাঁরা থাকো, যাওয়ার প্রয়োজন নেই। (আল-বেয়াদা, খন্ড ৭, পৃষ্ঠা ৯০)।
এধরণের অনেক প্রমাণ রয়েছে যা এই সংক্ষিপ্ত লিখনীতে তুলে ধরা সম্ভব নয়। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে হাদীসের অপব্যাখ্যা থেকে হেফাজত করুক। আমিন।
[আগামী কিস্তিতে সমাপ্য]
— আল্লামা উবায়দুল্লাহ ফারুক, প্রখ্যাত আলেমে-দ্বীন, ভূগোল-বিশারদ, সহসভাপতি- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ এবং শায়খুল হাদীস- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা।
উম্মাহ২৪ডটকম: আরএএম
উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com