।। আজম খান ।।
মহামারী, প্লেগ, মানবজাতির জন্য একটা অভিশাপ হওয়ার পাশাপাশি কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস একটা বড় ধরনের শুদ্ধি প্রক্রিয়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মহামারীর প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ শুধু থমকেই যায়নি বা হতভম্ব হয়নি, সচকিত বা আতঙ্কিতই শুধু হয়নি, একই সাথে তারা একটু স্থিত হয়ে ‘উন্নয়ন’, অর্জন, উচ্চ-প্রযুক্তির অর্জন, অর্থ এবং বড় ব্যবসায়িক জগৎ, ফ্যাশন, রাজনীতি, যুদ্ধ, সামরিক শক্তিবৃদ্ধি এবং অন্যান্য বিলাসিতার বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে চিন্তা করেছে। এই সবকিছু বিশ্বকে কোথায় নিয়েছে? সামনে? উপরে? পিছনে না কি নিচে?
বিশ্বে একটা এমন ঐক্যমত গড়ে উঠেছে যে, মানুষ পৃথিবীর উপর অনেক অত্যাচার করেছে এবং এখন প্রকৃতির প্রতিশোধ নেয়ার সময় এসেছে।
বিশ্বে যখন লকডাউন চলছে এবং মানুষ নিজেদেরকে ঘরে বন্দী করেছে, তখন পাখীরা কলকাকলীতে বেরিয়ে এসেছে, তারা গান গেয়ে, কিচির মিচির করে গাছগুলোর দখল নিয়েছে আবার। গাছেরাও নতুন পাতা দিয়ে তাদের পালক বন্ধুদের অভ্যর্থনা জানিয়েছে। ধুলি, ধোঁয়া, শব্দদুষণ এবং শহর জীবনের সাধারণ দুষণগুলো চলে গেছে। ধুসর আকাশ আবার নীল হয়ে উঠেছে।
ঘরে আটকা পড়া মানুষ প্রকৃতির এই পুনর্জাগরণকে উপভোগ করতে পারেনি। তারা নতুন ঘাস, বৃষ্টি-ধোয়া ঝোপ আর রঙবরঙের ফুলের গন্ধ নিতে পারেনি।
এটা কি কোন শিক্ষা ছিল? মানবজাতি কি শেষ পর্যন্ত তাদের অত্যাচার আর প্রকৃতির অপব্যহারের কলুষ থেকে পবিত্র হচ্ছে? মানুষ কি এটা উপলব্ধি করেছে যে, এই খেলার নাম ‘বাস করা আর বাস করতে দেয়া’? হয়তো করেছে। হয়তো করেছে সামান্য কিছু সময়ের জন্য।
আরেকটি বড় প্রশ্ন সামনে আসছে। দুর্নীতিগ্রস্ত আর অপরাধী মাথাগুলো কি তাদের আর্থিক লুটপাট আর অবৈধ লেনদেনে বিরতি দিয়েছে? চারদিকে অসুস্থ আর মৃত্যুর খবর, এর মধ্যে তাদের কি এই উপলব্ধি হয়েছে যে, হয়তো পুলিশ তাদেরকে ধরতে পারবে না, হয়তো সিসিলিয়ান মাফিয়া ডনদের মতো তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে, কিন্তু করোনাভাইরাসকে কখনও ঘুষ বা অর্থ দেয়া যাবে না? কোন আকর্ষণীয় চুক্তির জন্য কোন মন্ত্রীকে হয়তো আপনি কয়েক মিলিয়ন অর্থ দিতে পারেন, আপনি প্রেসিডেন্টের ক্ষমা নিয়ে জেলের শিক থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন এবং কোন বস্তিকে মুছে দিয়ে সেখানে প্রাসাদ তৈরি করতে পারেন, কিন্তু ওই প্রাসাদ থেকে কি এই ক্ষুদে জীবাণুকে দূরে রাখা যাবে? গুচ্চি ব্র্যান্ডের জুতা বা আরমানি স্যুট কি আপনাকে কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা করবে?
একেবারেই না, কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি- বাংলাদেশে এবং বিশ্বের আরও বহু জায়গায় ধনী আর ক্ষমতাধররাও মহামারীর শিকার হচ্ছে।
দুঃখজনকভাবে, অপরাধ এবং দুর্নীতির কোন প্রতিকার হয়নি। অপরাধী এবং দুর্নীতিগ্রস্তরা আসলে তাদের অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদকে মুক্তির পাসপোর্ট হিসেবে দেখছে। আরও দুর্ভাগ্যজনক হলো, তাদের এই হিসাব কিছুটা হলেও সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
আরও পড়তে পারেন-
বিদ্যুৎ সেক্টরে অপচয় ও গণদুর্ভোগ চরমে
ফেসবুকে ঝগড়া-ঝাঁটিতে কার লাভ হয়?
দুর্যোগে মানুষকে সহায়তার রাজনীতি
সফল জীবন ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ার সহজ উপায়
হাদীসশাস্ত্রে ইমাম আযম আবু হানিফা (রাহ.)
সেটা না হলে কিভাবে কুখ্যাত সিকদার ভাইয়েরা আনন্দচিত্তে একটা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে থাইল্যাণ্ডে পালিয়ে যেতে পারে, অথচ তারা হত্যা চেষ্টা মামলায় অভিযুক্ত। এই দুই ভাই – রন আর রিক – সিকদার গ্রুপের জয়নুল সিকদারের ছেলে, এবং তারা তাদের ইচ্ছেমতো যে কোন কিছু পাওয়ার জন্য তাদের অর্থ আর প্রভাবকে ব্যবহার করেছে। তারা নিজেরা লাম্পট্যের জীবন যাপন করেছে এবং হঠাৎ ধনী হয়ে ওঠা এই পরিবারের অন্যান্য বংশধরদের কাছেও তারা রোল মডেলের মতো। এই পরিবারটি তাদের সম্পদ অর্জন করেছে প্রতারণা, দুর্নীতি আর অপরাধের মাধ্যমে। এরা হলো রবিনহুডের ঠিক বিপরীত – গরিবদের থেকে চুরি করে নিজেদেরকে তারা ধনী করেছে।
দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি এবং দ্রুত বর্ধনশীল ধনিক শ্রেণীর দিক থেকে বাংলাদেশ রেকর্ড করেছে। নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক গবেষণা ফার্ম ওয়েলথএক্সের তথ্য অনুসারে, গত ১০ বছরে পাঁচ মিলিয়ন ডলার রয়েছে, এ ধরনের মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে ১৪ শতাংশ বেড়েছে। দুঃখজনক বিষয় হলো, এই অর্থগুলো দেশে থাকেনি। এই অর্থগুলো সুইস পার্বত্য এলাকার ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় উড়ে গেছে বা প্রবাসী বাংলাদেশী বিলিয়নেয়ারদের কাছে আশ্রয় পেয়েছে।
ইতোমধ্যে, ধনী আর গরিবের মধ্যে পার্থক্য আরও বেড়ে গেছে। এই পার্থক্য নজিরবিহীনভাবে বেড়ে গেছে এবং ধনী আরও ধনী এবং গরিব আরও গরিব হয়ে উঠেছে, এবং এমনকি করোনাভাইরাস মহামারীর সাথে সাথে এটা আরও বেড়েছে। বাস্তবে, যে মধ্যবিত্ত মাত্র ব্যাংককে ছুটি কাটানোর স্বাদ পেয়েছে, ব্যাংক ঋণ নিয়ে একটা কার কিনেছে, শহরে একটা ছোট অ্যাপার্টমেন্ট হয়েছে এবং ক্রেডিট কার্ডের এক ঘসায় দারুণ ভোজ সেরেছে, তারাও এখন আবার কয়েন গুনতে বসেছে, একটা ভাল চাকরি আর বেকারত্বের মাঝখানের সরু রেখার উপর এখন বিচরণ করছে তারা। আর গরিবদের জন্য এক বেলা ভালো খাবার পাওয়াটাই এখন ভাগ্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে, সবকিছুই অবশ্য হতাশাজনক নয়। মহামারী এবং এরপর বিপর্যয়কর সাইক্লোন আম্ফানের সাথে এসেছে প্রচুর সহায়তা, সাহায্য, স্বেচ্ছাসেবী, ত্রাণ ও মানবিক দয়া। বিভিন্ন ব্যক্তি, গ্রুপ, সংস্থা, সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা জীবিকা হারানো মানুষের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে, এবং এখনও আসছে।
স্বাস্থ্যকর্মী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, পরিচ্ছন্ন কর্মী, মিডিয়ার সাথে জড়িত ব্যক্তিসহ আরও অনেকেই এই দুর্যোগের সময় শক্তভাবে দাঁড়িয়েছে, এবং জনগণকে তাদের সেবা দেয়ার জন্য সব ধরনের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত হয়ে গেছে। তাদের ভূমিকা এবং অবদানকে কখনই খাটো করে দেখা যাবে না বা ভোলা যাবে না।
তবে, এর উল্টা দিকে, সেই অশুভ কীটও রয়ে গেছে যেটা প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেদের বিচরণ জারি রেখেছে। সেটা হলো দুর্নীতির কীট। অসৎ রাজনীতিবিদ, কুখ্যাত সরকারী কর্মকর্তা এবং যে সব ব্যক্তি যে কোন মূল্য দ্রুত সম্পদ গড়তে চায়, এ ধরনের ব্যক্তিরা যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। তাদের কথাও ভুলে যাওয়া যাবে না। উন্নয়নের অবশ্যম্ভাবী অংশ হিসেবে তাদেরকে অবজ্ঞা করা যাবে না বা তাদেরকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। না, তাদেরকে শাস্তি এড়াতে দেয়া যাবে না।
ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে এমন রাজনৈতিক নেতারা রয়েছেন, যারা গরিবের ত্রাণ চুরি করে সেগুলো নিজেদের বাড়িতে জমা করছেন। প্রতিদিনই খবর প্রকাশিত হচ্ছে যে, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের বাড়িতে ত্রাণের চাল খুঁজে পাওয়া গেছে। সরকারী কর্মকর্তারাও গরিবের তহবিল চুরির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। কিভাবে তারা চালের বস্তার উপর বসে থাকতে পারে, যেখানে হাড্ডিসার শিশুরা তাদের শূন্য পেট ভরতে সামান্য একটু ভাতের জন্য দারিদ্র-পীড়িত বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে?
এটাই শেষ নয়। মহামারীর সময়ে গৃহনির্যাতন বাড়তে দেখাটা দুঃখজনক, নিন্দনীয় এবং এমনকি ট্রাজিক একটা বিষয়। এটা একটা বৈশ্বিক বিষয়, এবং বাংলাদেশে যেখানে এমনিতেই ধর্ষণ আর যৌন নির্যাতন বাড়ছে, সেখানে এই অশুভ বিষয়টি টিকে আছে। এটা শুধু গৃহনির্যাতন নয়, নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সাধারণভাবে নির্যাতন বাধাহীনভাবে চলছে। প্রতিদিনই ধর্ষণ, নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের খবর পাওয়া যাচ্ছে। কে জানে, আরও কত ধরনের বর্বরতা চলছে, কারণ করোনাভাইরাসের কারণে একটা অন্যায় ব্যবস্থার কাছে ন্যায় বিচার চাওয়াটাও এখন কঠিন হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে আইনের শাসন কখনই সেভাবে ছিল না এবং করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পুলিশ নিজেরাই, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামে (পিপিই) সজ্জিত হয়েও ধসে পড়ছে। জনগণের সুরক্ষার ব্যাপারে তাদের সামান্যই আগ্রহ রয়েছে (কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে), এবং এই মহামারীর মধ্যে ন্যায় বিচারের যারা আকাঙ্ক্ষী, তারা তো পুলিশকে কাছেই পাচ্ছে না।
তৈরি পোষাক শিল্পে শ্রমিকদের সাথে অনেকটা একবার ব্যবহারোপযোগী পণ্যের মতো ব্যবহার করা হয়েছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণের মধ্যেই তাদেরকে তলব করা হয়েছে, তাদেরকে আবার ফেরত পাঠানো হয়েছে, আবার তলব করা হয়েছে, আংশিক বেতন দেয়া হয়েছে, ছোট্ট একটা স্যানিটাইজার থেকে সামান্য স্প্রে করে দিয়ে তাদেরকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। শ্রমিকদের বেতন দেয়ার জন্য সরকার গার্মেন্ট কারখানাগুলোকে মোটা অংশের প্রণোদনা দিয়েছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, তারা এত দ্রুত কারখানা খুলেছে, যদিও তারা বলছে যে বিদেশী ক্রেতাদের কাছ থেকে কোন অর্ডার নেই তাদের। প্রণোদনার অর্থ পকেটে নেয়ার পর তাদের মানিব্যাগগুলো ফুলে উঠার পরেই শ্রমিকদেরকে বিদায় বলে দিয়েছে তারা।
বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট এক ভার্চুয়াল কনফারেন্সে, নিজের বাড়িতে ফাঁকা হলের নিরাপত্তায় বসে ঘোষণা দিয়েছেন যে, শ্রমিকদেরকে তারা আর রাখতে পারছেন না, এবং সে কারণে গণহারে ছাটাই করা হবে। এটাকে কি বলা যায়? অপরাধ? দুর্নীতি? অপব্যবহার? নৈতিকতা আর মূল্যবোধের প্রশ্ন? নিজেদের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা দিতে পারবে গার্মেন্টস ওয়ালারা, কিন্তু তাদেরকে তাদের মার্সিডিস, অডি, এবং জাগুয়ার গাড়িগুলো থেকে নেমে হেঁটে তাদের শ্রমিকদের বাড়িতে যেতে দিন যাতে তারা শ্রমিকদের অসহায় শিশুগুলোকে বলতে পারে যে, তারা যেন ক্ষুধার্ত থাকে যাতে তাদের নিজেদের মেদবহুল শিশুরা নিজেদের প্রাইভেট বিমান চড়ে মিলানে গিয়ে খাবার খেতে পারে বা ব্যাংককে গিয়ে জন্মদিন উদযাপন করতে পারে।
না, করোনাভাইরাস আমাদেরকে কিছুই শেখায়নি। অন্তত এখন পর্যন্ত নয়।
উম্মাহ২৪ডটকম:এমএমএ
উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com