Home ফিকহ ও মাসায়েল হাদীসশাস্ত্রে ইমাম আযম আবু হানিফা (রাহ.)

হাদীসশাস্ত্রে ইমাম আযম আবু হানিফা (রাহ.)

।। হাফেজ মাওলানা নাজমুল হাসান ।।

চার মাযহাবের প্রসিদ্ধ ইমাম আবু হানীফা (রাহ.)এর ব্যক্তিত্ব, কৃতিত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর সমকালীন যুগ থেকে নিয়ে এ যাবৎ সর্বমহলে স্বীকৃত। মুসলিম উম্মাহর বড় বড় মনীষীগণ কুরআন-হাদীসের আলোকে ইসলামী শরীয়ার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে তাঁর অনন্য অসাধারণ কৃতিত্ব ও অবদানের কথা এবং ইলমের ময়দানে তাঁর গৌরবময় ভূমিকার কথা অকপটে স্বীকার করে গেছেন। ইলম ও আখলাকে, জ্ঞানে ও গুণে এবং বোধ ও বুদ্ধিতে এমন বিরল প্রতিভার অধিকারী মর্যাদাবান মানুষ মানব ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে। ইমাম আবু হানীফা (রাহ.) ইলমে ফিক্বহের ময়দানের রাজাধিরাজ, হাদীসের ময়দানে শাহসাওয়ার এবং অন্ধকার রাতের একজন বিনিদ্র সাধক ছিলেন।

হযরত ইমাম আযম আবু হানিফা (রাহ্.) যে যুগে জন্মগ্রহণ করেন, মুসলিম ইতিহাস প্রমাণ করে, সে যুগে কূফা নগর ছিল হাদীস ও ফিক্বাহ্ শাস্ত্রের বিশ্বখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র। তাই ইমাম আবু হানিফা (রাহ্.) কুফার প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন শিক্ষাগুরু থেকে হাদীস ফিক্বাহ্ ও অন্যান্য সকল বিষয়ে জ্ঞানার্জন করে বিদ্যা বিশারদ হতে সক্ষম হন।

কিন্তু বড় পরিতাপের বিষয় আজ সিহাহ্ সিত্তাহ তথা বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবুদাঊদ, নাসাঈ ও ইব্নে মাজাহ শরীফে ইমাম আবু হানিফা (রাহ্.) কর্তৃক রিওয়ায়াত না থাকায় এক শ্রেণীর প্রতারক অল্পবিদ্যার লোক ইমাম আযম আবু হানিফা (রাহ্.)কে হাদীস শাস্ত্রে দুর্বল ছিলেন বলে প্রচার করে থাকে।

এটা নিঃসন্দেহে একটা ভিত্তিহীন মিথ্যা অপবাদ। আসলে এধরনের ভিত্তিহীন মিথ্যা অপবাদ তারাই করতে পারে, যাদের সাথে ইতিহাসের কোন সম্পর্ক নেই। যারা ইতিহাস পড়ে এবং বুঝে তাদের মত জ্ঞানী লোকেরা এধরনের ভিত্তিহীন কথা বলতে পারে না। এসমস্ত প্রতারকরা আরবী পড়েছে ঠিকই, কিন্তু উচ্চারণ ও অনুবাদ দেখে পড়েছে, তাই আরবী ভাষায় ইতিহাসের বই পুস্তক পড়া তাদের ভাগ্যে জুটেনি।

আরও পড়তে পারেন- ‘মহিলা মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে হাফেয মাওলানা নাজমুল হাসানের বিশেষ সাক্ষাৎকার’

আজ দেশ-বিদেশের গ্রন্থাগারে আরবী, ফার্সী, ইংরেজী, উর্দু, বাংলায় ইতিহাসের বই-পুস্তক প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান। কিন্তু অধ্যয়নের অভাবে তারা আবোলতাবোল ভিত্তিহীন কথা প্রচার করে বেড়ায়। দিনাতিপাত করছে অধ্যয়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে।

আমরা জানি, ইমাম আবু হানিফা (রাহ্.) হাদীস ও ফিক্বাহ্বিশারদ ছিলেন। তিনি হাদীসের জ্ঞানার্জন করেন হাম্মাদ ইব্নে সুলাইমান থেকে, তিনি ইব্রাহীম নখয়ী থেকে, তিনি আলকামা থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ্ ইব্নে মাসঊদ থেকে, তিনি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম থেকে। আমরা তাদেরকে জানাতে চাই যে, Deep rivers move with silent majesty, shallow brooks are noisy (গভীর নদীর স্রোত নীরবেই বয়ে চলে, আর অগভীর খালের স্রোত উন্মত্ত ছলছল করে), অথবা A fog cannot be dispelled by a fan (পাখা চালিয়ে কুয়াশা দূর করা যায় না)।

ইমাম আবু হানিফা (রাহ্.) কেন? ইমাম শাফিঈ (রাহ্.)এরও কোন রিওয়ায়াত সিহাহ্ সিত্তায় নেই। এমনকি ইমাম আহমদ ইব্নে হাম্বল (রাহ্.) ইমাম বুখারীর হাদীস শাস্ত্রের উস্তাদ ছিলেন। তাঁর রিওয়ায়াতও বুখারী শরীফের তিন চারটা স্থান ছাড়া তেমন দৃষ্টিগোচর হয় না। তাই বলে কি এঁরাও হাদীস শাস্ত্রে দুর্বল ছিলেন।

ইমাম শাফিঈ (রাহ্.) মক্কায় প্রখ্যাত আলেমগণের নিকট হাদীস, ফিক্বাহ্ ও অন্যান্য সকল বিষয়ে শিক্ষালাভ করেন। এসময় তিনি ইমাম মালেক (রাহ্.)এর বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ “মুআত্তা” সম্পূর্ণ মুখস্থ করে ফেলেন। কুড়ি বৎসর বয়সে তিনি মদীনায় গমন করেন এবং সেখানে দীর্ঘকাল অবস্থান করে ইমাম মালেক ইব্নে আনাস (রাহ্.)এর নিকট থেকে হাদীসসহ ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন।

ইমাম আহমদ ইব্নে হাম্বল (রাহ্.) হাদীসের হাকেম ছিলেন অর্থাৎ তিনি সমস্ত হাদীস, মতন, সনদ, জরহ তা’দীল (সমালোচনা ও পর্যালোচনা) সহ আয়ত্ব করেন। তিনি হাদীসগ্রন্থ “মুসনাদ” সংকলন করেন। ইমাম মালেক (রাহ্.) “মুআত্তা” সংকলন করেন। ইমাম আযম আবু হানিফা (রাহ্.) হাদীস শাস্ত্রে “কিতাবুল আসার” সংকলন করেন।

আল্লামা মুয়াফ্ফাক মক্কী (রাহ্.) বলেন, “কিতাবুল আসার” গ্রন্থটি ইমাম আযম আবু হানিফা (রাহ্.) চল্লিশ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে সংকলন করেন। (মানাকিবুল ইমামিল আযম-১/৯৫)।

আরও পড়তে পারেন-

যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করে গেছেন

ভাইরাস ও ভ্যাকসিন ব্যবসা: এখনি সোচ্চার হওয়ার সময়

গুনাহর ক্ষতি এবং বেঁচে থাকার উপায়

ঢাকার প্রায় অর্ধেক মানুষ বিষণ্ণতায় ভূগছে, সমাধান কী?

মহানবী (সা.)এর মহিয়সী সহধর্মীনীগণ

“কিতাবুল আসার” হাদীসগ্রন্থটি ইমাম আযম (রাহ্.) নিজেই সংকলন করেন। কিন্তু মুসনাদে আবি হানিফা নামক হাদীসগ্রন্থগুলো আবু নাঈম ইস্পাহানী, হাফেয ইব্নে আসাকের, হাফেয আবুল আব্বাস, হাফেয ইব্নে আদি প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ কর্তৃক ইমাম আযম (রাহ্.)এর রিওয়ায়াতগুলোর একত্রিত রূপ।

এই মুসনাদ কিতাবগুলোর সংখ্যা ত্রিশের কাছাকাছি। এগুলোকে আবার আল্লামা ইব্নে খসরু একত্রিত করে নাম দিয়েছেন জামে মাসানিদিল ইমামিল আযম। (দরসে তিরমিযী-১/৯৮)।

আল্লামা আলী আল্ ক্বারী (রাহ্.) মুহাম্মদ ইব্নে সামাআহ্-এর বরাত দিয়ে বলেন, আবু হানিফা (রাহ্.) তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোয় সত্তর হাজারের উর্ধ্বে হাদীস বর্ণনা করেছেন। আর “আসার” গ্রন্থটি চল্লিশ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে লিখেছেন। (আল-জাওয়াহিরুল মুযীআহ- ২/৪৭৪)।

ইয়াহ্ইয়া ইব্নে নসর বলেন, একদিন আমি ইমাম আবু হানিফা (রাহ্.)এর ঘরে প্রবেশ করি, যা কিতাবে ভরপুর ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এগুলো কি? তিনি বললেন- এগুলো সব হাদীসের কিতাব, এর মধ্যে সামান্য কিছুই আমি বর্ণনা করছি, যেগুলো ফলপ্রদ। (আস্ সুন্নাহ- ৪১৩ পৃঃ, উকুদুল জাওয়াহিরিল মনীফাহ- ১/৩১)।

বিশিষ্ট হাদীসবিশারদ মক্কী বিন ইব্রাহীম (রাহ্.) ইমাম আযম আবু হানিফা (রাহ্.) সম্পর্কে বলেছেন, তিনি তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন। (তাহ্যীবের টিকা- ১/৪৫১, দরসে তিরমিযী- ১/১০২)।

আল্লামা হাফেয ইব্নে হাজার আসকালানী (রাহ্.) বলেন, ইমাম আযম আবু হানিফা (রাহ্.)এর মৃত্যুর খবর শুনে হযরত ইব্নে জরীহ্ (রাহ্.) গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, আহ্, ইল্মের কি এক অফুরন্ত খনি আজ আমাদের হাতছাড়া হলো। (তাহযীবুত তাহযীব- ১/৪৫০)।

এক হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার উম্মত বা সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন একলোকের অভ্যূদয় হবে, যিনি হবেন জাতির প্রদীপ। জ্ঞান-বিজ্ঞান যদি সপ্তর্ষিমণ্ডলস্থ ণক্ষত্রের মধ্যস্থ হয়ে থাকে তবুও তিনি সেই জ্ঞানার্জন করবেন।

জালালুদ্দীন সযয়ূতী (রাহ্.) বলেন, এতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু হানিফা (রাহ্.) সম্বন্ধে বভিষ্যদ্বাণী করেছেন। (আওজাযুল মাসালিকের ভূমিকা-১/৫৬, মাবাদিয়াতে ফিক্বাহ্- ৩৬ পৃষ্ঠা)। [চলবে]

লেখক:ভাইস প্রিন্সিপাল ও মুহাদ্দিস, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা, প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল- ঢাকা উত্তরা রওজাতুস সালিহাত মহিলা মাদ্রাসা, খতীব-উত্তরা ১২নং সেক্টর বায়তুন নূর জামে মসজিদ, উপদেষ্টা- উম্মাহ ২৪ ডটকম এবং সাংগঠনিক সম্পাদক- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।

মাদরাসা শিক্ষক এবং মসজিদের ইমাম-খতীবগণ বেতন-ভাতা বৃদ্ধির জন্য কেন আন্দোলন করেন না?