।। লোকমান তাজ ।।
সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ ১৯৪৮ সালে বেলারুশ জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি বেলারুশীয় প্রমিলা সাংবাদিক এবং লেখিকা। ২০১৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি বেলারুশের ইতিহাসে একমাত্র ব্যক্তি, যিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ হলেন চতুর্দশ নারী, যিনি সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন। নিজের দেশে আলেক্সিয়েভিচ সরকারের একজন সমালোচক হিসেবে পরিচিত। এই লেখিকা এ মনুমন্টে টু সাফারিং অ্যান্ড করেজ ইন আওয়ার টাইম বইয়ের জন্য এ পুরস্কার পেয়েছেন। নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে আলেক্সিয়েভিচ ১৪তম নারী যিনি সাহিত্যে ১১২তম লেখক হিসাবে এ পুরস্কার পেয়েছেন।
চেরনোবিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে লেখা বইয়ের মাধ্যমেই আলেক্সিয়েভিচ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত অর্জন করেন। এই দুই ঘটনার ভয়াবহতা তিনি প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে আবেগ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তাঁর সেই বইগুলো বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। নোবেল পুরস্কার ছাড়াও তিনি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচের চল্লিশ বছর কেটেছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার পরের সময়ের অসংখ্য মানুষের জীবন কাহিনী শুনে। তবে তার গদ্য কেবল ইতিহাসকে তুলে ধরেনি, ধারণ করেছে মানুষের আবেগের ইতিহাস। প্রায় অর্ধ-শতক পর একজন সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হয়, যিনি মূলত ‘নন-ফিকশন’ লেখক। ২০০৫ সালের পহেলা এপ্রিল Voices from Chernobyl গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ উপলক্ষে লেখিকার একটি সাক্ষাৎকার বেরিয়েছিল Dalkey Archive Press-এর ওয়েবসাইটে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন আনা লুচিচ। সাক্ষাৎকারটির চুম্বকাংশ পাঠকদের জন্য-
আনা লুচিচ: চমকপ্রদ, আবেগময় একটি বই চেরনোবিলের জবানবন্দী। পাঠকের মনে কি ধরনের অনুভ‚তি বা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন আপনি?
সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ: একটি ধারণা চালু আছে যে দুর্ঘটনার এত বছর পর চেরনোবিল সম্পর্কে যা কিছু জানার ছিল, সবই মনে হয় আমরা জেনে ফেলেছি; চেরনোবিল সুদূর অতীতের ঘটনা, ওই পুরনো কাসুন্দি কেউ নাকি আর শুনতে চায় না। কিন্তু সত্যি কথা হলো, সেই দুর্ঘটনা যেমন আমরা ভুলিনি, তেমনই চেরনোবিল নামের প্রপঞ্চটি আজও আমরা সঠিকভাবে বুঝতে সক্ষম হইনি।
আনা লুচিচ: বইটির প্রতি কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করেন?
সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ: অনেক পাঠকের কাছে এই বইটি গোমর ফাঁস করে দেয়ার মত, অজানা সত্যের সহসা উন্মোচন। “বাস্তবে কি ঘটেছিল আমার তো কোনো ধারণাই ছিল না, বিশেষ করে ব্যক্তিপর্যায়ে”। বইটি শুধু চেরনোবিলের দুর্ঘটনা আর তার পেছনের কার্যকারণে সীমাবদ্ধ নয়। বরং চেরনোবিল-পরবর্তী পৃথিবীও এর বিষয়বস্তু। আমজনতার প্রতিক্রিয়া কী ছিল, দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে তারা কিভাবেই বা টিকেছিল? দুর্ঘটনার প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতি আর মানুষের জেনেটিক গঠনের উপর ক্ষতিকর প্রভাব যেমন এই বইতে এসেছে, আমাদের জীবনে আমাদের মননে আর চেতনায় সেই অভিজ্ঞতাগুলো কী প্রভাব ফেলেছিল, তার বর্ণনাও আছে এখানে।
আনা লুচিচ: তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ আর সাক্ষীদের জবানবন্দী গ্রহণ করতে আপনার কত সময় লেগেছিল? বইটি লিখতে কতদিন লাগে? যত তথ্য জড়ো করেছিলেন, তার কতখানি বইয়ে স্থান পায়?
সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ: আমার সব বই-ই সাক্ষীদের জবানবন্দী নির্ভর, জনতার জীবন্ত কণ্ঠের প্রতিধ্বনি। সাধারণত একটি বই লিখতে আমার তিন থেকে চার বছর সময় লাগে, কিন্তু এই বইয়ের জন্যে দশ বছরের বেশি লেগে গিয়েছিল। চেরনোবিলে প্রথম যে কয় মাস ছিলাম, পুরো এলাকা নানা দেশের সাংবাদিক আর লেখকে ঠাসা ছিল, তাদের সবার মুখেই শয়ে শয়ে প্রশ্ন। আমি এই মর্মে নিশ্চিত হয়েছিলাম যে আমাদের ধর্তব্যের বাইরে সম্পূর্ণ অচেনা রহস্যময় এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি আমরা, যদিও সবাই চেষ্টা করে যাচ্ছে সাধারণ প্রচলিত ভাষায় এর বর্ণনা দেয়ার, স্বভাবসিদ্ধ পুরনো ফর্মুলায় একে আটকে রাখার।
হ্যাঁ, ঠিকই আমরা কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার দোষত্রুটি তুলে ধরছি, সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে প্রতারণা আর জোচ্চুরির কথা বলছি। এহেন দুর্ঘটনায় কী করা উচিত বা অনুচিত কাউকে কিছু বলা হয়নি, কবলিত মানুষকে আয়োডিন সরবরাহ করা হয়নি, ইত্যাদি ইত্যাদি। সব অভিযোগই অক্ষরে অক্ষরে সত্য ছিল, তাতেও সন্দেহ নেই। যেহেতু রুশ-চালিত পারমাণবিক চুল্লীতে বিস্ফোরণ ঘটে, প্রতিক্রিয়া স্বরূপ রুশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রবলভাবে দানা বেঁধে উঠেছিল বেলোরাশিয়া এবং ইউক্রেনে। লোকমুখে অভিযোগ উঠে যে তেজস্ক্রিয় রশ্মি দিয়ে রুশরা আমাদের দূষিত করে দিয়েছে।
আনা লুচিচ: চেরনোবিলের জবানবন্দী বইটি লেখার সিদ্ধান্তে কিভাবে উপনীত হলেন? এর পেছনে মূল অনুপ্রেরণা কোত্থেকে এসেছিল?
সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ: চেরনোবিল আমাদের দেখিয়েছে আধুনিক বিশ্বে ক্ষমতার অন্ধ উপাসনা কত বিপজ্জনক। সব কিছুর ঊর্ধ্বে বলপ্রয়োগ আর পেশীশক্তির উপর নির্ভরশীলতা কি ভয়ংকর ত্রুটিপূর্ণ। আমাদের এই আধুনিক জীবনদর্শন আমাদের নিজেদের জন্যেই কতখানি মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তি-মানবের কত পেছনে পড়ে আছে পরহিত-কামী মানব। একদম শুরুর দিন থেকে এই দুর্ঘটনা আমাদের মাথার উপর ঝুলছিল, তেজস্ক্রিয় মেঘের আকারেই শুধু নয় – বিস্ফোরণে নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরের ছাদই শুধু উড়ে যায়নি, চেরনোবিলে উড়ে গিয়েছিল আমাদের সমগ্র বিশ্বচিন্তা, জীবনদর্শন। সোভিয়েত শাসনের ভিতকে নড়বড়ে করে দিয়েছিল সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ, চেরনোবিল এসে সেই পুরো ভিত্তিকে প্রবলভাবে ঝাঁকিয়ে দিয়ে গেল।
এমন শক্তিশালী বিস্ফোরণ যে আমাদের সবার জীবন চুরমার হয়ে গেল। আমার মনে আছে সাধারণ মানুষ এবং তাদের সন্তান-সন্ততির সুরক্ষার প্রতিজ্ঞায় সরকার-বিরোধী সমাবেশ হয়েছিল বেলোরাশিয়ায়, তাতে লক্ষ লোকের জমায়েত হয়েছিল। সেই অনন্য অভিজ্ঞতা আমি বলতে চেয়েছি। হঠাৎ করেই বেলোরাশিয়ার পুরুষতান্ত্রিক সনাতনী সমাজকে ভবিষ্যতের অজানা আশঙ্কার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছিল।
আনা লুচিচ: সাধারণ মানুষের কাছ থেকে যেসব গল্প শুনেছেন, সরকারী ভাষ্য বা মিডিয়া-প্রদত্ত বিবরণ থেকে তা কতটুকু আলাদা ছিল?
সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ: দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। বেলোরাশিয়াতে আমরা সবসময়ই এই পরিস্থিতি দেখে আসছি, রাশিয়াতেও কিছুটা রয়েছে – সাধারণ মানুষ যেভাবে ঘটনা প্রত্যক্ষ করে, সরকারী সংস্করণের সাথে তার কোনো মিলই পাওয়া যায় না। কর্তৃপক্ষের মূল উদ্দেশ্য কি? কর্তৃপক্ষ নিজেদের সুরক্ষায় প্রাণপণে সচেষ্ট থাকে সবসময়। সেই আমলের টোটালিটারিয়ান শাসকগোষ্ঠী এই প্রবণতার জ্বলজ্বলে উদাহরণ: মানুষের মাঝে যে কোনো ধরনের আতঙ্ককে ওরা ভয় পেতো, ভয় পেতো সত্যকেও।
অধিকাংশ মানুষেরই কোন উপলব্ধি ছিল না যে আশপাশে কী ঘটছে। আত্মরক্ষার প্রচেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত কর্তৃপক্ষ তাই জনগণকে অবলীলায় ধোকা দিলো, মিথ্যা বললো। জনগণকে আশ্বাস দিলো যে সবকিছু ঠিক আছে, সব নিয়ন্ত্রণে আছে, বিপদের কোন আশংকা নেই। বাচ্চারা উঠানে ফুটবল খেলছিল, রাস্তা থেকে আইসক্রিম কিনে খাচ্ছিল, ছোট্ট শিশুরা বালু-বাক্সে বসে আনন্দ করছিল, এমনকি বহু লোক সীবীচে গিয়ে সূর্যস্নানও করেছিল নির্ভয়ে। আজকে লক্ষ লক্ষ শিশু পড়ে আছে অসুস্থ-অথর্ব হয়ে, অনেকে মারাও গেছে। পারমাণবিক দুর্ঘটনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষ অবশেষে বুঝতে পেরেছিল যে তারা নেহায়েত একাকী, তাদের পাশে কেউ নেই। বুঝতে পেরেছিল যে ঘটনার প্রকৃত সত্য তাদের কাছ থেকে লুকানো হয়েছে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে কেউ আসবে না, না কোন বিজ্ঞানী, না কোন ডাক্তার। এহেন পরিস্থিতি তাদের জন্যে ছিল নতুন, নজিরবিহীন।
আনা লুচিচ: আপনার বইগুলোতে সাক্ষাৎকারের সাথে কল্পসাহিত্যে ব্যবহৃত কলাকৌশলের সংমিশ্রণ দেখা যায়। সাহিত্যের এক অনন্য ঘরানা বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। একই ধরনের কাজ করছেন, এমন অন্য লেখক আছেন?
সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ: এভাবে গল্প বলার ঐতিহ্য – অর্থাৎ মৌখিক ইতিহাস সংগ্রহ করা, মানুষের জীবন্ত কণ্ঠ রেকর্ড করে রাখা – এই কলাকুশলগুলো আমার অনেক আগে থেকেই রুশ সাহিত্যে চালু আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লেনিনগ্রাদের অবরোধ নিয়ে লেখা গ্রানিন ও আদামোভিচের বইগুলো উল্লেখ্য – যেমন ধরুন জ্বলন্ত গ্রাম থেকে এসেছি আমি গ্রন্থটির কথা। আমার নিজের বইগুলো লেখার পেছনে ওই বইগুলো আমাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আমার বোধোদয় হলো যে, জীবন এত বহুমুখী, একই ঘটনার এত রকম বিবরণ বা ব্যাখ্যা মেলে যে, সেরেফ কল্পসাহিত্য বা দলিল-দস্তাবেজ দিয়ে সেই বৈচিত্র্যকে বেঁধে রাখা আদৌ সম্ভব নয়। তাই গল্প বলার ভিন্ন কৌশল খুঁজে বের করতে বাধ্য হয়েছি আমি।