।। আলহাজ্ব সৈয়দ জহির উদ্দীন ।।
তাবলীগ জামাআতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইলিয়াস (রাহ.)এর ভাতিজা এবং ফাযায়েলে আমাল গ্রন্থের রচয়িতা হযরত যাকারিয়া (রাহ.) ছিলেন পবিত্র কুরআন এবং হাদীসের জ্ঞানে পারদর্শী কামেল বুজুর্গ। তিনি মাত্র ৭ বছর বয়সে পবিত্র কালামুল্লাহ হেফয করেন এবং মাত্র ১৯ বছর বয়সে দাওরা হাদীস পাঠ্যক্রম সমাপ্ত করেন। অতঃপর পুনঃ দাওরা হাদীসের কিতাবগুলো অধ্যায়ন করেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে মাসিক ১৫ (পনের) টাকা বেতনে ভারতের মাজহারুল উলূম সাহারানপুর মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। বিভিন্ন সময় তিনি বিভিন্ন ব্যাপারে মতামত ব্যক্ত করেন। তাঁর মৌখিক কিছু মন্তব্য সুপ্রিয় পাঠকমহলের উপকারে আসবে ভেবে সংক্ষিপ্তাকারে নিম্নে পেশ করছি-
(১) হযরত মাওলানা হাবিবুর রহমান লুধিয়ানভী (রাহ.) একদা হযরতের খেদমতে উপস্থিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, তাসাওউফ কি এবং তাসাওউফের তাৎপর্যইবা কি? হযরত জবাবে বললেন, কেবল নিয়্যাত বিশুদ্ধকরণ। এ ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি আরও বললেন, যত সাধ্যসাধনা আর ঝামেলা পোহানো সব কেবল এ উদ্দেশ্যেই। যিকির বিল জেহের বা সশব্দ যিকির এ উদ্দেশ্যেই, মুজাহাদা মুরাকাবার উদ্দেশ্যও তাই। আর যাঁকে আল্লাহ পাক এ দৌলত দান করেছেন, তাঁর আর কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
(২) হযরত বলেন, সময় অত্যন্ত মূল্যবান। জীবনের অবসর মূহূর্তগুলোর গুরুত্ব দেওয়া চাই। হাদীসে আছে, বান্দার উচিত তার নিজের জন্য নিজের পাথেয় সঞ্চয় করা। জীবনকালে মৃত্যুর জন্য, যৌবনে বার্ধ্বক্যের জন্য, দুনিয়ায় আখেরাতের জন্য।
(৩) হযরত ফরমান, বন্ধুগণ! মালিকের সম্মুখে নতজানু হয়ে যাও, সর্ব চরাচর তোমার কাছে নতি স্বীকার করবে। সাহাবায়ে কিরাম (রাযি.)গণের এ কাহিনী সর্বজন বিদিত। একদা আফ্রিকার শ্বাপদসংকুল জঙ্গলে মুসলমানদের ছাউনী স্থাপনের প্রয়োজন দেখা দেয়। সেনাপতি হযরত উকবা (রাযি.) জনাকয়েক সাহাবী (রাযি.)কে নিয়ে জঙ্গলের একস্থানে দাঁড়িয়ে হাক দিলেন, হে হিংস্র শ্বাপদ ও সরী-সৃপরাজী! আমরা হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)এর কতিপয় সাহাবী এ জঙ্গলে অবতরণ করেছি। আমরা এখানে অবস্থান করবো। তোমরা অন্যত্র যাও। তারপর আমরা যাকেই সম্মুখে পাবো, তাকেই হত্যা করবো।
ঘোষণা তো নয়, যেন একটা তড়িৎ প্রবাহ। শোনা মাত্র অরণ্যের হিংস্র শ্বাপদগুলো নিজ নিজ শাবকগুলো নিয়ে দ্রুত অন্যত্র গমন করলো। দেখতে দেখতে অরণ্য শ্বাপদশূন্য হয়ে গেল।
শেখ সাদীর বোস্তাঁ কিতাবে একটা কিস্সা আছে, জনৈক বুযূর্গ বাঘের পীঠে সওয়ার হয়ে পথ চলছেন দেখে এক ব্যক্তি ভড়কে গেল। তখন ঐ বুযুর্গ বললেন, ‘খোদার হুকুম থেকে তুমি কভু ফিরায়োনা ঘাড়, তাহলে এ বিশ্বে কেউ হবে না যে অবাধ্য তোমার।
(৪) হযরত বলেন, পাপাচার দুই প্রকার। যথা- পশু সূলভ পাপাচার এবং শয়তানী পাপাচার।
পশুসূলভ পাপাচার হচ্ছে পানাহার ও কামজনিত পাপাচার, আর শয়তানী পাপাচার হচ্ছে অহংকার, অন্যকে হেয় জ্ঞান করা এবং নিজেকে শ্রেয় বা উত্তম জ্ঞান করা। প্রথমোক্ত ধরণের পাপগুলো তো কান্নাকাটির দ্বারা মাফ হতে পারে পক্ষান্তরে দ্বিতীয়োক্ত পাপাচারগুলো থেকে তাওবা খুব কমই নসীব হয়। মানুষ একে পাপাচার বলে মনেই করে না। এর ক্ষমা অনেক বিলম্বে হয়। এর দলীল হচ্ছে হযরত আদম (আ.)কে বৃক্ষের নিকটবর্তী হতে বারণ করা হয়েছিল। কিন্তু ভুলক্রমে তিনি বৃক্ষের নিকটে চলে গিয়েছিলেন। তারপর তওবা করলেন এবং সে তাওবা কবুলও হলো। ইবলীস সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল অহংকার বশে। প্রথম ধরণে আল্লাহ পাকের কাছে বিনীত ভাব এবং দ্বিতীয় ধরণে আল্লাহ পাকের মুকাবিলায় ঔদ্ধত্য প্রকাশ পেলো। আমি স্বচক্ষে অনেক লোককে অনেক ঊর্ধ্বে দেখেছি যাতে ঈর্ষার উদ্রেক হতো, কিন্তু অন্যদের সমালোচনা ও তাদেরকে হেয় জ্ঞান করার কারণে তারা নিজেরাই হতমান হয়ে গেছেন।
(৫) হযরত বলেন, আমাদের বুযুর্গগণের কথা, “যারা আমাদের শেষ জীবনের দিকে তাকাবে তারা অকৃতকার্য হবেন, আর যারা আমাদের শুরুর দিকে তাকাবে তারা কৃতকার্য হবেন”। কেননা জীবনের প্রারম্ভকাল কাটে মুজাহাদা তথা সংগ্রাম সাধনার মধ্য দিয়ে, আর শেষ দিকে বিজয়ের দরজাসমূহ খুলে যায়। এই বিজয়কালকে দেখে যে এটাকেই অনুকরণীয় আদর্শরূপে ধরে নিবে, সে কার্যক্ষেত্রে হতাশ হতে বাধ্য।
তিনি আরও বলেন, “দেখ! মেহদীর পাতাকে যখন পাথর দিয়ে পিষে দেয়া হয়, তখনই তা রঙিন করে দেয়। পাথরে না পিষে এমনিতেই পাতাগুলোকে রেখে দিলে তাতে কিছুই হবে না। হযরত মাদানী (রাহ.) বলতেন, “মসজিদে এ পর্যন্ত যিকির করতে মন চাইতো যে, মসজিদের দেয়ালে মথা ঠুকে ঠুকে মাথা ফাটিয়ে দেই”।
(৬) হযরত বলেন, আমরা তো বলার বা লেখার সময় নিজেদেরকে অধম, পাপীতাপী প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করে বিনয় প্রকাশ করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা একটা প্রথা ছাড়া আর কিছুই নয়। (আসলে তো মনে মনে আমরা নিজেদেরকে সেরূপ মনে করি না)। কিন্তু কেউ যদি ভরা মজলিশে কোনো আপত্তি উত্থাপন করে বসে, মেজাজ চড়ে যায়। অথচ যদি মানবার মতো কথাই হয়, তাহলে আবার অসন্তুষ্টি কেন? তাতো শিরোধার্য করে নেয়াই উচিত। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ ফরমান, “আমি সদাচরণের পূর্ণতা বিধানের জন্যই প্রেরিত হয়েছি”।
বিশেষতঃ যাঁরা যাকেরীন ও ইজাযাতপ্রাপ্ত (খেলাফত প্রাপ্ত) তাঁদের আচার আচরণ অন্যদের হিদায়াত লাভের কারণ হওয়া উচিত। বিদ্বিষ্ট ও বীতশ্রদ্ধ হওয়ার মতো হওয়া উচিত নয়।
(৭) হযরত বলেন, পবিত্র হাদীসে আছে, মৃত ব্যক্তিদেরকে মন্দ বিশেষণে স্মরণ করো না, বরং তাদের গুণাবলীর আলোচনা কর”।
আমরা ভারসাম্য হারিয়ে এমনিভাবে সীমা অতিক্রম করে যাই যে, কাউকে তো প্রশংসা করে আকাশে উঠিয়ে দেই। আবার কারো নিন্দা করতে করতে তাকে পাতালেরও নীচে নামিয়ে দেই; অথচ আল্লাহ পাক ইরশাদ ফরমান, “কারো প্রতি তোমাদের বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে ন্যায় থেকে বিচ্যুত না করে, ন্যায় পন্থা অবলম্বন করো। কেননা, এটাই তাক্বওয়া বা আল্লাহ ভীতির নিকটবর্তী”।
(৮) হযরত বলেন, আজ আমাদের মাদ্রাসা সমূহে ধর্মঘট প্রভৃতি যাবতীয় অনর্থের মূল কারণ হচ্ছে, “খানাকাহী যিন্দেগীর অভাব। পবিত্র হাদীস শরীফে আছে “ধরাপৃষ্ঠে যখন, আল্লাহ, আল্লাহ বলার লোক শেষ হয়ে যাবে, তখনই কিয়ামত আসবে”। মাদ্রাসাগুলোর অস্তিত্বের ব্যাপারেও একথাটি প্রযোজ্য। আল্লাহ পাকের নাম যতই অমনোযোগিতার সাথে নেয়া হোক না কেন, তার একটা আছর বা প্রভাব থাকবেই। আমাদের মধ্যে আজ ইখলাস ও নিষ্ঠার অভাব ঘটেছে। আল্লাহ আল্লাহ করার সিলসিলাকে প্রসারিত করো। যেখানে অধিক হারে আল্লাহ পাকের নামের যিকির হবে, সেখানে ফেতনা থাকবে না। ফিতনা ফাসাদের প্রতিরোধে আল্লাহ পাকের যিকির বাঁধের মতো কার্যকরী। পুরাকালে দাওরায়ে হাদীসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচুর সংখ্যক যাকেরও থাকতেন।
(৯) হযরত বলেন, পবিত্র হাদীসে শরীফে আছে, অনেক এলোকেশী, আলুথালু বেশধারী ধূলাচ্ছন্ন ব্যক্তি, যাদেরকে গলাধাক্কা দিয়ে দরজা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়, এমনও আছেন, তাঁরা যদি আল্লাহ পাকের উপর কসম খেয়ে বলেন, তবে আল্লাহ পাক তাঁদের কসমের মর্যাদা রক্ষা করেন। রিয়াযাত ও মুজাহাদা দ্বারাই মানুষ মর্যাদায় উপনীত হতে পারে।
অপর এক হাদীসে আছে, মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ ফরমান, “আমার বান্দা নফল ইবাদতের দ্বারা ক্রমেই আমার নিকট থেকে নিকটতর হতে থাকে, এমন কি শেষ পর্যন্ত আমি তাকে মাহবুব বা প্রেমাস্পদরূপে গ্রহণ করি”। তারপর হাদীসের সংক্ষিপ্ত সার হলো, তারপর তার হাত, পা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গাদির দ্বারা যা কিছুই করে, তা আল্লাহ পাকের মর্জি মোতাবেকই হয়।
অতঃপর হযরত বলেন, আল্লাহ পাকের পথ বড়ই সহজগম্য। নিজের অভিজ্ঞতায়ও তাই জেনেছি এবং অন্যদেরকে প্রত্যক্ষ করেছি।
তিনি আরও বলেন, ভাই দেখ যাই করো না কেন, আল্লাহ পাকের মর্জি অনুযায়ী করবে। নিজের মর্জিও অভিরুচি অনুযায়ী করবে না। কিছু করে নাও। রমযানুল মুবারকে এর অনুশীলন করে নাও। আমাদের বুজর্গগণের মধ্যে কেউ একথা বলেন না যে, চাকুরী বাকুরী বা ব্যবসা বাণিজ্য করো না।
উপরোক্ত মূল্যবান বাণীসমূহের মাঝে বর্তমান পথভোলা উম্মতদের জন্য বহু শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে। উপরোক্ত আলোচনার আলোকে আমাদের স্ব স্ব ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করণার্থে সকল শ্রেণীর পাঠকদের খেদমতে বিনীত আহ্বান জানাচ্ছি।
আসুন, বর্তমানে দ্বীনের সন্ধিক্ষণে আমরা পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ আঁকড়িয়ে ধরার লক্ষে বুজুর্গদের বাণী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করতে সাধ্যমত চেষ্টা করি।
আল্লাহ পাক মেহেরবানী করে বুজুর্গদের উপদেশের মান্যতার উছিলায় পবিত্র কুরআন ও হাদীসের সঠিক অনুসারী হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন॥
লেখক: প্রকাশক- উম্মাহ ২৪ ডটকম, সিইও- এম.জেড. ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরস এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক- আল-বাশার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, পুরানা পল্টন, ঢাকা।