[গত ১১ নভেম্বর শনিবার উত্তরা ১৪নং সেক্টর মসজিদে আয়েশা সংলগ্ন মাঠে অনুষ্ঠিত ওলামায়ে কেরামের সমাবেশে হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর ও ঢাকা মহানগর সভাপতি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী তাবলীগ জামাতে মাওলানা সা’দ সাহেবকে নিয়ে সৃষ্ট সংকট নিয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন, তার পুণর্বিবরণী উম্মাহ্ ২৪ডটকম-এর পাঠকদের জন্য নিম্নে পত্রস্থ করা হল]
নাহমাদুহু ওয়ানুসাল্লী আলা রাসূলিহিল কারীম। আম্মাবাদ! পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, “ইন্নামা ইয়াখসাল্লাহা মিন ঈবাদিহীল ঊলাম”। অর্থাৎ- নিশ্চয়ই বান্দাদের মধ্যে আলেমগণই আল্লাহ তায়ালাকে বেশী ভয় করে। অপরদিকে হাদীসে মহানবী হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “আল-উলামাউ ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া”। অর্থাৎ- ওলামায়ে কেরাম হলেন আম্বিয়াগণের উত্তরসূরী।
এই উত্তরসূরীর দায়িত্বের মধ্যে তিনটি বিষয় পড়ে- ১। তাফাক্কু ফিদ-দ্বীন তথা দ্বীনের সঠিক জ্ঞান আয়ত্ব করা। দ্বীনের সঠিক জ্ঞান না থাকলে হক্ব-বাতিলের পার্থক্য করা যাবে না, সুন্নাত বিদআতের পার্থক্য করা যাবে না, দ্বীন ও গায়রে দ্বীনের পার্থক্য করা যাবে না। এ জন্য, সঠিক উপায়ে নবীর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য দ্বীনি জ্ঞান আয়ত্ব করা ওলামায়ে কেরামের জন্য অপরিহায্য বিষয়। এই দ্বীনি জ্ঞানার্জনে যদি ঘাটতি থাকে, তাহলে দ্বীনের মধ্যে নানা সমস্যা তৈরি হবে।
পৃথিবীতে গোমরাহী এসেছে দুই কারণে। প্রথমে হল, জেহালাত বা মূর্খতা। আর অন্যটি হল খাহেশাত বা প্রবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত হওয়া। আমরা যে সমস্যার সম্মুখীন হয়ে এখানে জমায়েত হয়েছি, এই সমস্যার মূল কারণ জানতে হবে। এই সমস্যার কারণ আমি যে হাদীসটি শুরুতে পড়েছি, সেই হাদীসে বর্ণিত ‘তাফাক্কু ফিদ-দ্বীন’-এর ঘাটতির কারণে।
ওলামায়ে কেরামের দ্বিতীয় দায়িত্ব হলো, তাহাফফুজে দ্বীন বা দ্বীনের হেফাজত করা। দ্বীনের উপর যখন কোন আঘাত আসে, সেটা ইসলাম, গায়েরে ইসলাম বা নাস্তিকতা ও বে-দ্বীন; যে নামেই আসুক, সেটাকে প্রতিহত করা ওলামায়ে কেরামের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যারা বলে থাকেন, হুজুরগণ কেন দাওয়াত ও তাবলীগে নাক গলাবেন, তারা জানেন না যে, দ্বীনের হেফাজতের জন্য, দ্বীন সংরক্ষণের জন্য সর্বোচ্চ কুরবানীর মাধ্যমে চেষ্টা-সাধনা করা ওলামায়ে কেরামের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
আকাবেরে আসলাফে উম্মত দ্বীনের হেফাজত করতে গিয়ে কত জুলুম নির্যাতনের মুখে পড়েছেন, ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলেছেন, জেল খেঠেছেন, বেত্রাঘাত হজম করেছেন এবং আরো নানা অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন, বলে শেষ করা যাবে না। দ্বীনের হেফাজতের জন্য তাঁরা অনেক বড় পর্যায়ের কুরবানী দিয়েছেন। তবুও তারা দ্বীন রক্ষার মিশন থেকে পিছপা হননি কখনো। সুতরাং দ্বীনের উপর যে কোন আঘাত আসলে, সেটা প্রতিহতের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা নবীর ওয়ারেস হিসেবে উলামায়ে কেরামের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বর্তমানে দাওয়াত ও তাবলীগের মধ্যে যেই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং যারা দ্বীনি বিষয়ে নানা বিভ্রান্তিতে আছেন, তাদেরকে সঠিক পথে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া ওলামায়ে কেরামের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এই দায়িত্ব পালন না করলে ওলামায়ে কেরামকে জবাবদেহী হতে হবে আল্লাহর কাছে।
আমি আলোচনা দীর্ঘ করবো না। দাওয়াত ও তাবলীগে বর্তমানে যে সমস্যা চলছে, সে সম্পর্কে সকলেই ওয়াকিফহাল। এই সমস্যা অনেকের কারণে নয়। এই সমস্যার গোড়ায় রয়েছেন মাত্র এক ব্যক্তি। এক ব্যক্তির কারণেই দাওয়াত ও তাবলীগের এই বিশাল ময়দানে আজ সংকট দেখা দিয়েছে। এই এক ব্যক্তিটা হলেন মাওলানা সা’দ সাহেব। মাওলানা সা’দ সাহেব কী সমস্যা করছেন? তিনি সমস্যা করছেন, হযরত মাওলনা ইলিয়াস (রাহ.), হযরত মাওলানা ইউসুফ (রাহ.) এবং হযরত মাওলানা এনামুল হক (রাহ.)এর সময় থেকে তাবলীগ জামাত হক্বের যে উসূল ও ভিত্তির উপরে চলে আসছিল, সেটা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসতে চাচ্ছেন তিনি। দ্বিতীয়তঃ মাওলানা সা’দ সাহেব কুরআন সুন্নাহর পরিপন্থী আক্বিদা বিশ্বাস, কুরআন-সুন্নাহর মনগড়া ব্যাখ্যা ও তাফসীর তাবলীগে চালু করতে চেষ্টা করছেন। এক কথায় মাওলানা সা’দ সাহেব তাবলীগ জামাআতকে গোমরাহীর রাস্তায় নিয়ে যেতে কাজ শুরু করেছেন। তাছাড়া তিনি যুগ যুগ ধরে চলে আসা তাবলীগ জামাআতের শূরা কমিটি এবং গঠনতান্ত্রিক যে নিয়ম-নীতি আছে, সেটাও তিনি মানতে রাজি নন। এমন বিতর্কিত এক ব্যক্তি এই বিশাল দাওয়াত ও তাবলীগ জামাআতের আলমি মুরুব্বী বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পদ গায়ের জোরে দখল করে আছেন। এই এক ব্যক্তির কারণে আজ সারা বিশ্বের তাবলীগী এন্তেজামে অশান্তি তৈরি হয়েছে। মাওলানা সা’দ সাহেবের সকল অনৈতিক মতবাদ ও অনিয়মের সংশোধনের জন্য এ পর্যন্ত মুরুব্বীগণ সকল পন্থা ও প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছেন। কিন্তু তিনি নিজেকে সংশোধন করেননি। এমনকি, দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে ফতোয়া দেওয়ার পর তিনি সেই ফতোয়াও মানতে রাজি হননি।
এখন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ, যেটা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। এই দেশের শতকরা ৯২ জন মানুষ মুসলমান। বিশ্বের মধ্যে দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতের সবচেয়ে বড় মার্কাজ হলো এখন বাংলাদেশে।
কাজেই বাংলাদেশের জমিন যদি সা’দ সাহেবের গোমরাহীতে আক্রান্ত হয়, তাহলে বাংলাদেশের জনগণের ঈমান-আক্বীদা হেফাজত করাও মুশকিল হয়ে যাবে। হাদীস মতে জনগণের ঈমান-আক্বিদার উপর মাওলানা সা’দ সাহেবের কারণে যেই হুমকি তৈরি হয়েছে, সেটা থেকে জনগণকে হেফাজত করা ওলামায়ে কেরামের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ওলামায়ে কেরাম সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, সা’দ সাহেব নিজেও গোমরাহীর মধ্যে আছেন এবং দাওয়াত ও তাবলীগের নেতৃত্বের পদ অবৈধভাবে দখল করে তার গোমরাহী মতবাদ এই বিশাল জামাতের মধ্যেও চালু করতে চাচ্ছেন। যেহেতু তাকে কোনভাবেই সৎপথে ফিরে আনা যাচ্ছে না, সুতরাং বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমানদেরকে ফিতনা ও গোমরাহী থেকে বাঁচানোর জন্য এই লোককে কোনভাবেই বাংলাদেশে আসতে দেওয়া যাবে না। মাওলানা সাআদকে বাংলাদেশে আসতে হলে আগে তাকে দারুল উলূম দেওবন্দের ফতোয়া মেনে নিয়ে সেই মতে চলার প্রকাশ্য ঘোষণা দিতে হবে। এবং ভারতের নেজামুদ্দীনে আগে যে সকল মুরুব্বী ছিলেন, তাদের সাথে সাআদ সাহেবকে নিয়ে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, সেটার পূর্ণ সমাধান বা সমঝোতা হতে হবে।
সাআদ সাহেব যদি যুগ যুগ ধরে চলে আসা তাবলীগের শৃঙ্খলার আওতায় আসেন এবং হক্বের উপর চলার বিষয়ে সকলের সন্দেহ তিনি দূরে করেন, তবেই তিনি বাংলাদেশে আসতে চাইলে আমরা কোন আপত্তি করবো না। এর আগে বাংলাদেশে তার আসার কোনই সুযোগ নেই। গত বছরও উলামায়ে কেরাম সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন যে, এসব সংকটের সমাধান ছাড়া মাওলানা সা’দ সাহেব যেন বাংলাদেশে না আসেন। কিন্তু কিছু মুষ্টিমেয় ব্যক্তি ষড়যন্ত্র করে গত বছর সা’দ সাহেবকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন। আমরা এজন্য কাকরাইলের সকলকেই দোষারোপ করবো না। কাকরাইলের অনেক মুরুব্বী এখানেও উপস্থিত আছেন। তারাও গত বছর সা’দ সাহেবের বাংলাদেশে আসার বিষয়ে সম্মত ছিলেন না। কিন্তু আমার জানা মতে হাতে গোনা দুই তিন জন লোক এই কাজটা করেছেন। কাকরাইলের সকল সাথী ও উলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্তে একমত। বাকী হাতে গোনা দুই তিনজন লোক চক্রান্ত করে সা’দ সাহেবকে বাংলাদেশে এনেছেন। যে দুই তিন জনের কারণে বাংলাদেশে এই ফিতনা ছড়াচ্ছে, তাদের বিষয়েও আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। সুতরাং কাকরাইলকেও এই দুই-তিন জন ফিতনাবাজ থেকে মুক্ত করতে হবে।
মুধুপুরের পীর মাওলানা আব্দুল হামিদ সাহেব সা’দ সাহেব ও কাকরাইলের দুই তিনজন ফিতনাবাজকে উৎখাত করার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া সম্পর্কে যে কথা বলেছেন, সঠিকই বলেছেন। এই ফিতনা থেকে অবশ্যই কাকরাইলকে মুক্ত করতে হবে। শবগুজারির ইজতিমা হোক, তিন দিনের বা পাঁচ দিনের ইজমিতা হোক, এদেরকে কোথাও স্থান দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশে মুষ্টিমেয় যারা সা’দ সাহেবের পক্ষাবলম্বন করেছেন, তারাও গোমরাহ। সা’দ সাহেব যেমন ফেতনা ছড়াচ্ছেন, তেমনি বাংলাদেশের মুষ্টিমেয় তার সমর্থকরাও এই দেশে গোমরাহ ছড়াতে চাচ্ছেন। এদেরকে কোনভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। শুধু সাআদ সাহেবের বাংলাদেশে আগমন বন্ধ করাই যথেষ্ট নয়, বরং তার দেশীয় মুষ্টিমেয় সমর্থকদেরকেও তাবলীগ জামাআত থেকে উচ্ছেদ করার বিষয়ে আমাদেরকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গত বছরও আমরা ধৈয্য ধরেছি শান্তির স্বার্থে। কিন্তু তারা সংশোধিত না হয়ে গোমরাহী ছড়ানো অব্যাহত রেখেছে। এমনকি, সাআদ সাহেব ও তার সমর্থকরা দারুল উলূম দেওবন্দের ফতোয়া না মেনে বরং দারুল উলূম দেওবন্দ ও ওলামায়ে কেরামকে কটাক্ষ করে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কাজেই এই বিষয়ে আর চুপ থাকার বা মেনে নেওয়ার কোনই সুযোগ নেই।
সম্মানিত উপস্থিতি, আজকের এই সম্মেলন থেকেই আমাদেরকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তাবলীগ জামাআত যুগ যুগ ধরে আকাবীরদের দেখানো যেই নিয়মে পরিচালিত হয়ে আসছে, সেই নিয়ম বহাল রাখার বিষয়ে কোন ছাড় দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরাম যদি এই ফিতনাবাজদেরকে উৎখাতে সফল না হন, তাহলে বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমানদেরকে এরা গোমরাহ করে ছাড়বে। পরম করুণাময় আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর মর্জি মতো হক্বের উপর চলার তাওফীক দান করুন। আমীন।
হযরত মাওলানা আরশাদ মাদানী (হাফি.) এই মাওলানা সা’দ সম্পর্কে পরিষ্কার বলেছেন, “ইয়ে আদমী জাহেল হায়”, অর্থাৎ- এই লোক পথভ্রষ্ট। হযরত আরেকটা কথা বলেছেন যে, বাংলাদেশে আসার আগে তিনি নেজামুদ্দীন গিয়েছিলেন। পৌনে এক ঘণ্টা আলোচনা করেছেন সা’দ সাহেবের সাথে। এই আলোচনার শেষ পর্যায়ে হযরত আরশাদ মাদানী সাহেব সা’দ সাহেবকে শুধু একটা প্রশ্ন করে জবাব চাইলেন যে, আপনার উস্তাদ মাওলানা ইবরাহীম সাহেব, মাওলানা ইয়াকুব সাহেব কেন আপনাকে পরিত্যাগ করেছেন? মাওলানা ইবরাহীম ও মাওলানা ইয়াকুব সাহেব আপনার উস্তাদ, আপনার বাবার উস্তাদ। এই বুযুর্গ আলেমগণ কেন নিজামুদ্দীন ছেড়ে চলে গেলেন জবাব দিন? কিন্তু মাওলানা সা’দ এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারেননি। এ সময় সা’দ সাহেবের শ্বশুর মাওলানা সালমান সাহেবও সেখানে বসা ছিলেন। তিনি বললেন, এই প্রশ্ন বাস্তবিকই। এই প্রশ্নের সন্তোষজনক কোন জবাব নেই।
তাহলে প্রমাণিত হল, এই লোক পথভ্রষ্ট। তার পথভ্রষ্টতায় বাংলাদেশের কয়েকজনও আক্রান্ত হয়ে এটাকে বাংলাদেশে ছড়িতে দিতে চাচ্ছেন। সুতরাং এই বিষয়ে আলেম সমাজের নমনীয় হওয়ার বা ছাড় দেওয়ার কোনই সুযোগ নেই। আমাদের চূড়ান্ত দাবী দু’টিই। এক. নিজেকে সংশোধন করে হক্বের উপর ফিরে আসার বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়া মাওলানা সাআদকে বাংলাদেশে কোনভাবেই ঢুকতে দেওয়া যাবে না। দুই. কাকরাইল মার্কাজ থেকেও পথভ্রষ্ট মাওলানা সাআদের অনুসারী যে কয়জন আছেন, তাদেরকে উচ্ছেদ করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মানুষকে নতুন এই ফিতনা ও গোমরাহী থেকে বাঁচানোর জন্যই নেওয়া হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সকলকে সহীহ বুঝ দান করুন এবং সকলপ্রকার গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা থেকে হেফাজত করুন। আমীন। #