।। মুফতী কামাল উদ্দীন ফারুকী ।।
“ফিরে এলো আজ সেই মুহাররম মাহিনা
ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না”
হিজরী সনের প্রথম মাস হলো মুহাররম। এটি একটি পবিত্র গুরুত্বপূর্ণ ও ত্যাৎপর্যবহ মাস। ধর্মীয় সামাজিক ও ঐতিহ্যগত কারণে এর গুরুত্ব অপরিসীম। মুসলিম উম্মাহর জন্য বহু ঐতিহাসিক ঘটনা দুর্ঘটনার স্মৃতির সাথে বিজড়িত রয়েছে এ মাসের ১০ তারিখ। আরবী ও ইসলামী ইতিহাসে এ দিনটিকে ইয়াওমে আশূরা বা আশূরার দিবস বলে নামকরণ করা হয়েছে।
অনেকের ধারণা, কারবালার শোকাবহ ও মর্মস্পর্শী ঘটনার কারণে এর বিশেষ বৈশিষ্ট। কিন্তু আসলে তা নয়। বরং ১০ই মুহাররমে মানব জাতির ইতিহাসে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। যেমন, এ দিনেই অভ্যুদয় ঘটে এ ধরিত্রীর। আবার এই দিনেই মহাপ্রলয়ের মধ্য দিয়ে পৃথিবীলয় প্রাপ্ত হবে। এ দিনেই আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আ.)এর তাওবা কবুল হয় এবং হযরত নূহ (আ.)এর কিস্তি মহাপ্লাবন থেকে মুক্তি পান এবং হযরত আইয়ুব (আ.) কঠিন রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করেন।
এ দিনেই হযরত ইবরাহীম (আ.) পাপিষ্ঠ নমরূদের অনল কুন্ড হতে নিস্কৃতিপান। এবং বনী ইসরাঈল ও মুসা (আ.) ফিরআউনের হিংস্র ছোবলহতে নিস্তার পান। এই আশূরা দিবসে আসমানে উত্থিত হন হযরত ঈসা (আ.)। অবশেষে এ দিনটিতেই নবী দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রাযি.) স্বপরিবারে ইরাকের মরুময় কারবালা প্রান্তরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন।
ইসলাম আগমনের পূর্ব থেকেই এ মাসকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় বিবেচনা করে লোকেরা অন্যায়-অবিচার, যুলুম-অত্যাচার, ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, রাহাজানী হানা-হানী এবং যুদ্ধ বিগ্রহ এড়িয়ে চলতো। শুধু মক্কার কুরাইশরা নয় বরং মদীনার ইহুদীরাও মুর্হারমের ১০ম তারিখকে বিশেষভাবে উদযাপন করতো। হাদীস শরীফে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিযরত করে দেখতে পান যে, ইহুদীরা আশূরার দিনে রোযা পালন করেছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার! তোমরা আজকের দিনে রোযা রাখছো কেন? তারা বলল, এটি একটি মহান দিবস। এই দিনে আমাদের নবী হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর সম্প্রদায়কে আল্লাহ তাআলা মুক্তি দিয়ে ছিলেন এবং ফিরআউন ও তার কওমকে দরিয়া নিমজ্জিত করেন।
সুতরাং তার শুকরিয়া স্বরূপ হযরত মুসা (আ.) রোযা রাখতেন। আর আমরাও এজন্যই রোযা রাখি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- “মুসা (আ.)এর সাথে তোমাদের অপেক্ষা আমার সম্পর্ক অগ্রাধিকার মূলক ও নিকটতর।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে বললেন, তোমরাই মুহাররমের রোযা রাখ। এবং এ ব্যপারে ইহুদীদের বিরোধীতা কর। অর্থাৎ তোমরা দুটি রোযা রাখো। একটি আগে বা পরে। (বুখারী, মিশকাত)।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা বুঝা যায় যে, এই মুহাররমের তাৎপর্য কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নয় বরং এ দিনে যেসব ঐতিহাসিক ঘটনাবলী বয়েছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে আশূরার মর্যাদা ও গুরুত্ব।
হযরত মুসা (আ.)এর যুগ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত এবং তার তিরোধানের পর সুদীর্ঘ বছর যাবৎ মুহররমের তারিখ আশূরার দিন হিসেবে পালিত হতে থাকে। অতঃপর ৬১ হিজরী সনের ১০ই মুহাররম তারিখে ইরাকস্থ কুফা নগরী থেকে ৬০ কিঃমিঃ দূরে ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে সংঘটিত হয় এক হৃদয় বিদায়ক ও মর্মান্তিক ঘটনা।
কারবালার সারকথাঃ হযরত আমীর মুয়াবিয়া (রাযি.)এর ইন্তিকালের পর তার জৈষ্ঠ পুত্র ইয়াযিদ মুসলিম রাষ্ট্রের শাসনভার গ্রহণ করেন। অথচ, তার জন্য সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত ছিলেন হযরত হোসাইন (রাযি.)। ইয়াযিদ ক্ষমতায় আরোহণ করেই হিংস্র হায়েনার মত জুলুমের হাত প্রসারিত করে। ফলে সর্বত্র বিদ্রোহ ও অশান্তির দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। হযরত হোসাইন (রাযি.) ইয়াযিদের এই কু-শাসন বরদাশত করলেন না। ফলে বেঁধে গেল সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্ব।
ইতোমধ্যে ইয়াযিদ মদীনার গভর্ণরকে এই মর্মে আদেশ পাঠাল যে, ইমাম হোসাইন (রাযি.) যেন ইয়াযিদের প্রতি বাইয়াত গ্রহণ করে। এ সংবাদ শুনে হোসাইন (রাযি.) মক্কায় হিজরত করেন। এদিকে কুফার একটি বিরাট জামায়াত ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ থেকে বিরত থাকল এবং তারা ইমাম হোসাইন (রাযি.)এর হাতে বাইয়াত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তাই তারা ইমাম সাহেবের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন এবং কুফায় আগমনের আহবান জানিয়ে ইমাম সাহেবের নিকট দেড় শতাধিক চিঠি প্রেরণ করেন। তাদের চিঠি মোতাবেক ইমাম সাহেব ৭২ জন নারী পুরুষের এক কাফেলা নিয়ে মক্কা থেকে কুফার দিকে রওয়ানা হন।
যাত্রা পথে ভুল পথে তিনি ফোরাত নদীর তীরে কারবালা নামক মরুভূমিতে ইয়াযিদ বাহিনী কর্তৃক ঘেরাও হন। ইমাম হোসাইন (রাযি.) ইয়াযিদের সেনা বাহিনীকে অনেক অনুরোধ করলেও তারা ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত অথবা যুদ্ধ ছাড়া অন্য কিছু মানতে অস্বীকার করে। অবশেষে ৬১ হিজরী সনের ১০ই মুহাররম তারিখে কারবালা প্রান্তরে ৪ হাজার ইয়াযিদ সৈন্যের মোকাবেলায় হোসাইন (রাযি.)এর নিঃস্ব ৭০ জনের কাফেলা ইয়াযিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য দাঁড়িয়ে যান। ইমাম বাহিনীর সবাই বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে দুশমনের মোকাবেলায় একে একে সবাই শাহাদাত বরণ করন।
অতঃপর হোসাইন (রাযি.) নিজেই ময়দানে অবতীর্ণ হন এবং দীর্ঘক্ষণ শত্রুর মোকাবেলায় যুদ্ধ করতে করতে অবশেষে করবালার শুকনো জমিনকে করেন পবিত্র রক্তে রঞ্জিত। হিজরী ৬১ সনের ১০ই মুহাররম শুক্রবার দিন ৫৬ বছর ৫ মাস ৫ দিন বয়সে এই আত্মত্যাগী বীর শাহাদাত বরণ করেন।
নিষ্ঠুর ইয়াযিদের সৈন্যরা ইমামের শাহাদতের পরও নির্মম ব্যবহার করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। সেনান ইবনে আনাস নাখয়ী ইমামের দেহ থেকে শীরকে দ্বিখন্ডিত করে ফেলে। জাহার ইবনে কাব ইমামের জামা এবং কাইস কোমরবন্দ খুলে নেয়। আসওয়াদ আবদী জুতা ও বনী দারাম গোত্রের এক লোক তলোয়ার খুুলে নেয়। আর এই দিন থেকেই রচিত হয় ইতিহাসের নির্মম অধ্যায়।
মুহাররমের গূড়তত্ত্বত
প্রথমে এ কথাটি নির্ধারণ করতে হবে যে, মুহাররম মাসটি কি মর্যাদাশীল, না-কি অলূক্ষণে ও বরকত শূন্য। শিয়া সম্প্রদায় এ মাসকে মানহুস বা হতভাগ্য মনে করে। কারণ, শিয়াদের নিকট শাহাদাত অত্যন্ত খারাব কাজ। যেহেতু হোসাইন (রাযি.) এ মাসে শাহাদাত বরণ করেন, তাই তারা এ মাসকে বরকতহীন মাস মনে করে। এবং এ মাসে বিবাহ শাদী ও এধরনের অনুষ্ঠান করে না। হযরত হোসাইন (রাযি.)এর শাহাদত যদিও সীমাহীন হৃদয় বিদারক, কিন্তু শিয়া সম্প্রদায় এ ব্যাপারে সীমা লংঘন করছে। তারা পহেলা মুহাররম হতে ১০ই মুহাররম পর্যন্ত ১০ দিনের কর্মসূচী শরীয়াতের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে পালন করে যাচ্ছে। যার মাঝে হাজারও বিদআত এমনকি শিরকী কর্মকান্ড পর্যন্ত রয়েছে।
আমাদের সমাজে তথাকথিত কিছু নামধারী মাওলানা সাহেবগণও মুহাররম মাসের প্রথম ১০ দিনের কর্মসূচী হাতে নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হচ্ছে। জানি না, শিয়া সম্প্রদায়ের সাথে এদের কোন গোপন সংযোগ আছে কি-না? শহীদে কারবালা হোসাইন (রাযি.) যেখানে বলে গেলেন আমি শহীদ হলে তোমরা আমার জন্য উহ আহ করো না, আঁচলছিড় না, বরং ধৈর্য ধারণ করে থাকবে, সেখানে তারা কাকে উপেক্ষা করে হোসাইন প্রেমের দাবীদারগণ আশূরার দিনে মাতম করার দিন হিসেবে বেছে নিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে শাইখ (আ.) কাদের জিলানী (রাহ.) বলেন- হোসাইন (রাযি.)এর শাহাদত দিবসকে যদি শোক ও মাতমের দিন হিসেবে পালন করতে হয়, তাহলে ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার মুসলমানদের জন্য শোক দিবস হওয়ারই অধিক যুক্তিযুক্ত ছিল। কেননা, এ দিনটি মুসলমানদের জন্য একটি বেদনাময় দিন। এদিনেই আমাদের প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়া হতে বিদায় নিয়েছেন এবং এ দিনেই প্রথম খলিফা আবু বকর (রাযি.) ইন্তেকাল করেন। (গুনিয়াতুত তালেবীন-২/৩৮ পৃষ্ঠা)।
বস্তুতঃ আশূরা মাতম করার দিন নয়। বরং শুকরিয়া আদায় করার দিন। রোযা, নামায, দান খয়রাতের মাধ্যমে শহীদি আত্মার মাগফিরাত কামনার দিন, আশূরা আদর্শিক বিজয়ের দিন। শোককে যুলুমের বিরুদ্ধে শক্তিতে রূপান্তরিত করার দিন। যে আদর্শকে সমুন্নত করার লক্ষে কারবালার লৌমহর্ষক ও হৃদয় বিদায়ক ঘটনা সংঘটিত হল, সে আদর্শ সত্য ন্যায় ও ইসলামী মূল্যবোধকে জাগ্রত করার শপথ গ্রহণের দিন আশূরা। কারবালায় আশূরার আত্মত্যাগে মুসলিম জাতিকে সোনালী যুগের সোনালী আসনের সন্ধান দিয়েছে। এ জাতি যে বিশ্বে সত্য ও ন্যায়ের শাসন কায়েম করেছে, নেতৃত্ব দিয়েছে শিক্ষা, সাংস্কৃতি ও আদর্শ রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে, তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কারবালার ইতিহাস।
কিন্তু আজ একবিংশ শতাব্দীতে এ জাতির অবস্থান কোথায়? কেন এ জাতি আজ অপশক্তির দাবার গুটি সেজেছে? কেন ফিলিস্তিনিরা মাতৃভূমিহারা? কেন চেচনিয়া, বসনিয়া হারজেগোভিনিয়া, কসোভো ও ইরাকের মুসলমানদের উপর চলছে মিথ্যার জুলুম? কেন মুসলিম মা বোনেরা হচ্ছে স্বামী সন্তান ও ইজ্জত হারা? কেন তাদের করুণ নিনাদে আকাশ বাতাস হচ্ছে প্রকম্পিত? এসব প্রশ্নের কি কোন উত্তর নেই?
উত্তর একটাই, তাহলো আমরা হারিয়ে ফেলেছি আশূরার রক্তস্নাত পথ। আশূরাকে রূপান্তরিত করেছি মাতম আর আহাজারীর অনুষ্ঠানে। হারিয়ে ফেলেছি ঈমানী যোশ ও ঈমানী বিক্রম। আশূরা বারেবারে আসে মুসলিম জাতির হৃত ঐতিহ্য তথা জ্ঞান-বিজ্ঞান, শৌর্য-বীর্য, শিক্ষা-সাংস্কৃতি পূর্ণ-জাগরণের অনুপ্রেরণা যোগাতে। আশূরা আসে সমাজ দেহে বিরাজিত নৃশংসতা দূর্নীতি, অনাচার, অত্যাচার, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষা রোধের আহবান জানাতে।
তাই তো আজ হতেই আমাদেরকে আশূরার ক্ষুরধার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে। ১০ই মুহাররমের প্রতিবাদী খুন আহবান জানাচ্ছে, আর মাতম নয়! আসুন, এই পবিত্র চেতনা ধারায় অবগাহন করি। ঈমানী জোশ ও ঈমানী বিক্রমে আবার উদ্বেলিত হই। প্রতিবাদের ঝড়তুলে জালেমের তখতে তাউস করি খান খান।
আল্লাহ আমাদের বুকের রক্তকে শহীদী রক্ত হিসেবে কবুল করুন। আমীন॥