আধখানা স্মৃতি আধখানা বিস্মৃতির মধ্যে ঘুরপাক খায় আছিয়া বেগমের দিনরাত্রি। গা গুলায়, জ্বরজ্বর ভাবটাও ছেড়ে যায় না শরীর থেকে। দিন দিন শরীর আর বিছানার সখ্যও যেন গাঢ় হয়ে উঠেছে। খাবারে প্রচণ্ড অনীহা।
একমাত্র মেয়ে বিলু, নিজের ছেলেমেয়ে, স্বামী-সংসার সামলে মায়ের দেখাশোনাও করে যান্ত্রিক গতিতে। খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সেবাযত্ন, ওষুধ-ডাক্তার সব দায়িত্বই করার আপ্রাণ চেষ্টা।
মায়ের বাড়ি থেকে দুই লেন পরই তার বাড়ি। আবাসিক এলাকা যদিও। রাস্তায় বেরোলে সর্বক্ষণই মানুষের যাতায়াত। এতটুকু রাস্তার জন্য গাড়ি বের করা বড় ঝক্কি। দিনের মধ্যে চার-পাঁচবার আসা-যাওয়া, সেটাও কম ঝক্কির নয়। তাই মেয়ে দুটোকেও দু-একবার পাঠায়। নাতনীদ্বয়ও নানু-অন্তপ্রাণ। একমাত্র ছেলে ফ্যামিলিসমেত বিদেশে সেটেল্ড। বললেই তো আর হুটহাট আসা যায় না। আর এলেও ক’দিন থেকে ফের ছুটতে হয় কাজের জায়গায়।
আজ সকাল থেকেই বমি বমি ভাব। বিলু জোর করে মুখে কিছু দেয়ার চেষ্টা করতেই বমি হয়ে গেল। বিলু নিজ হাতে সব সাফসুতোর করে বিছানায় শুইয়ে নিজের বাসায় গিয়ে ছোট মেয়েকে পাঠিয়ে দিলো নানুর কাছে। আর কড়া করে বলে দিলো ঘোড়ার ডিম ফেসবুক-টেসবুক নিয়ে বসে থাকবি না। নানুর দিকে খেয়াল রাখবি। আমি বাসায় রান্না করে রেখে আসব আর তোর নানুদের জন্য নিয়ে আসব।
আহ মা, এসব তো জানি। সময় নষ্ট না করে যা করার তাড়াতাড়ি করো তো গিয়ে।
ঘণ্টাখানেক পর বিলুর মেয়েটা ফোন দিয়ে বলে, মা তাড়াতাড়ি এসো। নানু কেমন করছে।
হাতের কাজ ফেলে ছুটতে ছুটতে এসে বিলু দেখে মায়ের গলার ভেতর থেকে গড়গড় আওয়াজ বেরোচ্ছে। চোখের তারা ভেতরে গিয়ে সাদা অংশটুকু বের হয়ে আছে। বিলুর হাত-পায়ে কম্পনের সৃষ্টি হয়। হায় আল্লাহ, এ কোন বিপদ এলো? বিলুর বাবা ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। কাছে-পিঠের যে কয়েকজন এলো, এসে কেউ বলছে- মারা গেছে, কেউ বলছে- মারা যাচ্ছে। কেউ বলছে- ডাক্তার আনো, কেউ বলছে- এনে বোধহয় লাভ নেই। তার থেকে হুজুর এনে তাওবা পড়িয়ে দেন, যদি সময় পাওয়া যায়।
এই এলোমেলো অবস্থায় বিলুর মাথায় কোনো কাজ করে না। শুধু বুক ফেটে কান্না আসে। দুই চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। তবুও মনে শক্তি সঞ্চয় করে ফোন দিতে উদ্যোগ নেয় মামাদের। মায়ের ভাই মামা, এরাই তো বড় কাছের; এদেরই তো সর্বাগ্রে খবর জানানো উচিত। কিন্তু মোবাইল কই? খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেল নিজের হাতের মাঝেই।
বিপদে বোধহয় এ রকম দিশেহারাই হয় মানুষ। কিন্তু নাম্বার এনে ডায়াল করতে গিয়ে অস্থিরতা আরো বাড়ে। শেষ পর্যন্ত পারল ছোট মামার নাম্বারে ফোন দিয়ে হড়বড়িয়ে বলতে, মামা মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। বোধহয় মারা যাচ্ছে। কী করব? আপনারা তাড়াতাড়ি আসেন।
বিলুর ছোট মামা কোমল মনের মানুষ। তিনি ছিলেন এক মিলাদ মাহফিলে। একে তো লোকসমাগমের আওয়াজ, দ্বিতীয়ত ভাগ্নির ভীত কণ্ঠস্বর। তিনি শুনতে পেলেন মামা, মা মারা গেছে। বোধহয় যাচ্ছে এটা শুনতেই পেলেন না। আর পেলেই কী, যাচ্ছে মানে যেতে আর কতক্ষণ?
তিন বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি মেজো বোন। বড় বোনটি বছর দশেক আগেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পরপারে চলে গেছে। মুহূর্তের মধ্যে ভেসে উঠল মেজো বোনের স্নেহ, মমতা, ভালোবাসার কথা। বড় হয়েও ছোট ভাইদের কথার ওপরে একটা কথাও বলেনি। বিপদ-আপদে সাহস আর শক্ত খুঁটি হয়ে পাশে রয়েছে। সে কিনা আমাদের নিঃস্ব করে চলে গেল? আর ভাবতে পারলেন না বিলুর ছোট মামা। বুকে হাত চাপা দিয়ে বসে পড়লেন। তিনি হার্টের রোগী। পাশে বসা লোকেরা কী হলো কী হলো বলে অস্থির হয়ে উঠল। ক্ষীণস্বরে অতি কষ্টে তিনি বললেন, আমার মেজো বোন নাকি মারা গেছে। সবাই জানত বোন অসুস্থ, কিন্তু মারা যাওয়ার মতো এতটা যে অসুস্থ, এটা কেউ জানেনি। কাছের ক’জন বিলুর ছোট মামা খান সাহেবকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল।
এ খবর ঘরের সবাই শুনে বিলাপ শুরু করে দিলো। যার যেই অবস্থা, সেই অবস্থায়ই রওনা হলো।
বড় মামা, ছোট মামা, ছোট খালা সবার ফ্যামিলির লোকজন একই সাথে রওনা হলো যার যার গাড়ি নিয়ে।
গাড়ি চলছে বিলি কেটেকুটে। ড্রাইভার পাকা হাতের কাজ খেলিয়ে সামনে এগোনোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, অথচ গাড়ির যাত্রীদের মনে হচ্ছে গাড়ি জায়গায়ই দাঁড়িয়ে আছে। ছোট মামার মেয়ে দুটো ফুপির জন্য কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। যেখানেই জ্যাম পড়ছে, সেখানেই বলছে চলো আমরা গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে যাই।
সবাই পৌঁছে বিলুদের সাথে কিছুক্ষণ কেঁদে নিলো। বিলু বলল, যে অবস্থা এতক্ষণ চলেই যেত, শুধু আপনাদের জন্যই বোধহয় শিরাটুকু চলছে, তাওবা পড়ানো হয়ে গেছে, দোয়া-দরুদ পড়ছে অনেকে।
কিন্তু মামারা পৌঁছে বললেন, শিরা যখন ক্ষীণ হলেও চলছে, তো ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো।
বিলুর বাবা কেঁদে বলেন, নিয়ে আর কী হবে, নিতে নিতে যদি…।
দৃঢ়তার সাথে ছোট মামা বলেন, যা হওয়ার হবে; ডাক্তারের কাছে আগে নিই। প্রয়োজনে ফিরিয়ে আনব সমস্যা কী?
শুরু হলো দৌড়ঝাঁপ। অ্যাম্বুলেন্সের দেরি আর সহ্য করল না। ছোট মামা নিজের গাড়ির পেছন সিটে শুইয়ে যাত্রা শুরু করলেন।
প্রাইভেট একটি হাসপাতালে নিলে ডাক্তাররা সব দেখেশুনে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন- সম্ভব না, অনেক দেরিতে এনেছেন। করুণস্বরে সবার রিকোয়েস্ট, একটি বার ট্রাই তো করেন। যা হওয়ার হোক, মনে শান্ত্বনা তো পাবো।
স্যরি : কিছুক্ষণের মধ্যেই কিছু একটা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, যদি আপনাদের ইচ্ছে হয় অন্যত্র দেখাতে পারেন। মনে হয় না আশানুরূপ সংবাদ পাবেন।
ডাক্তারেরা অতি বিনীত নম্র ও ভদ্র ভাষায় কথাগুলো বোঝাতে চেষ্টা করলেন। মামারা হাল ছাড়েন না, নিয়ে যান অন্য হাসপাতালে। ওখানেও ডাক্তারদের আশাহীন কথা। তারপরও বলে রোগীর অবস্থা যদিও ক্রিটিক্যাল তবুও ট্রাই করে দেখি। যদি কিছু হয়ে যায় আপনারা আবার জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর-টাঙচুর করবেন না তো?
না, না আমরা সব জেনে বুঝেই এসেছি। এখন ভাগ্যের ব্যাপার, আর আল্লাহ যদি সহায় থাকেন।
শুরু হলো চিকিৎসা। ডাক্তারেরা প্রথমেই পেলেন ব্লাড প্রেসার ফল্ট করেছে প্রচণ্ডভাবে। হাইপো-গ্লাইসেমিয়ার ভয়ঙ্কর অবস্থা। এ দুটোর চিকিৎসা পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে রোগী নড়েচড়ে উঠল। বাকি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে লাগল। এতটুকুতেই সবাই যেন প্রাণ ফিরে পেল।
আগে থেকে কিছু কিছু রোগ থাকলেও ওষুধপথ্য ঠিকঠাক নেয়নি। অবহেলা করেছে প্রচণ্ড রকমের। যার পরিণাম এ পর্যন্ত নিয়ে ছাড়ল।
বাকি ইনভেস্টিগেশনের পরে জানা গেল দুটো কিডনিরই বেহাল দশা। শ্বাসকষ্টও চেপে ধরেছে, তার ওপরে ব্রেন স্ট্রোকও হয়ে গেল। আর দু’বার হার্ট অ্যাটাক তো আগেই হয়ে গিয়েছিল।
হাসপাতালের ওষুধের কড়া গন্ধ, স্যালাইনের সুই ফোটানো সে বুঝতে পারে যখন, তখন তার মাথার ভেতর কিলবিল করে নানা স্মৃতি। দেখতে পায় তার অতীত।
নদীর কিনারে ফোটা আকন্দ ফুল যেন নদীর রূপের শোভা বাড়িয়ে তুলেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে কচুরিপানায় বেগুনি রঙের থোকা থোকা কচুরি ফুল, ওরা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ওই তো সেই নদী, নদীর পাড়ে আমার দুই বছরের মেয়ে বিলুকে নিয়ে বসে আছি। দুষ্ট মেয়েটা বড় দৌড়ঝাঁপ করছে। যদি পানিতে পড়ে যায়? এ দিকে আয়, আয় বলছি বলে কোলে টেনে নেয়ার চেষ্টা করে। তার হাত নাড়া মুখে ভোঁ ভোঁ উচ্চারণে পাশে বসা বিলু বলে, মা কিছু বলছেন? কিছু প্রয়োজন?
মা আবার ঘোরের মাঝে হারিয়ে যায়।
সম্পূর্ণ রিভাইব করার আগেই জোরাজুরি করে বাড়িতে চলে এলো। না এনে উপায় ছিল না। ডাক্তার-নার্সদের বকাবকি করে গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়ল।
কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়িতে যেতেই মৃত মানুষের নতুন জীবন পাওয়া দেখতে আসা মানুষের ঢল এবং তাদের কথাবার্তা শুনে আছিয়া বেগম অবাক চোখে ভাবে, সত্যিই তাহলে চলে গিয়েছিলাম? বিলুর বড় মামা বলেন, আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমত তোমাকে সময় দিয়েছেন, এখন মন ভরে ইবাদত-বন্দেগি করে নাও। শুকর আদায় করো।
যদিও বেঁচে আছে, আগের মতো সুস্থ জীবন তো নেই। কখন কী করে, কখন কী বলে, নিজেই জানে না। এই তো সেদিন সবার অলক্ষ্যে মাথার চুলগুলো কাঁচি দিয়ে কেটেছেঁটে যাচ্ছেতাই অবস্থা করে ফেলেছে।
তাই দেখে বিলু বলে, মা কী করেছেন? কেউ দেখলে বলবে মুরগি চুরি করে ধরা পড়েছেন।
শুনে অবাক চোখে চেয়ে চেয়ে ভাবে, কী বলছে মেয়েটা, ওর মাথাটাথা খারাপ হয়নি তো?
ডাক্তার বলেন, ভাগ্য ভালো আপনাদের, তাই শুধু চুল কেটেছে। এ রকম প্যাসেন্টরা এর থেকেও মারাত্মক কিছু করে ফেলতে পারে। অনেক সময় এরা নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে দিতে পারে, এমনকি পরের গলায়ও। এটা এক ধরনের হ্যালুসিনেশন।
এর পর থেকে সবার নজরদারিতেই থাকে সর্বক্ষণ।
যৌবনের সতেজ তারুণ্যের কথাগুলো বড় বেশি মনে পড়ে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেগুলোই বলে যান, বিলু, টিনের চালে মুষলধারে শব্দ করে বৃষ্টি হচ্ছে না রে? চাদর গায়ে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে। দে তো গায়ে চাদর টেনে, একটু ঘুমাব।
বিলু হেসে বলে, বিল্ডিং বাড়িতে টিনের চালের শব্দ! গরমে ঘেমে-নেয়ে উঠলাম। মাথার ওপর ফ্যান চলছে ননস্টপ, রাতে এসি ছাড়া চলে না আর আপনি বলছেন চাদর দেবো?
হ্যাঁ রে, বর্ষার ব্যাঙের ডাক শুনতে পাচ্ছিস না?
না মা পাচ্ছি না।
ও ও ও ব্যাঙরা এখন ডাকে না, না? ডাকবে কী করে? ওরা তো সব কার্টনে বসে প্লেনে চড়ে বিদেশে চলে যায়। যেগুলো যেতে না পারে, সেগুলো যায় চায়নিজ রেস্টুরেন্টে। তাই বোধহয় ওদের ডাক শোনা যায় না।
বিলু দেখেছিস, পাতা ভরা শিউলী গাছটায় কেমন শিউলী ফুটেছে।
যা তো কোচর ভরে তুলে নিয়ে আয়, মালা গাঁথব।
বিলু চুপ করে শুনে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের দিকে তাকিয়ে ভাবে, মেদযুক্ত ভরভরান্ত শরীরটা মেদমুক্ত হয়েছে, যদিও বড় মায়া হয় শরীরের দিকে চেয়ে। শরীর বলে মনেই হয় না। মনে হয় চুপসে যাওয়া একটা বেলুন মাত্র।
ভালো গৃহিণী ছিলেন মা, রান্নার হাত ছিল প্রচণ্ড রকমের ভালো। বাড়ার হাত ছিল তার চেয়েও ভালো। যে একবার খেয়েছে ভোলেনি সে কখনো। যেমন তেমন বাজারে মন ওঠেনি। ভালো জিনিসটা যে কিভাবে চিনতেন, আমি অবাক হয়ে ভাবতাম। এখনো তো তাই ঘোরের মধ্যে বলেন, বিলু ফ্রিজে ২০টা মুরগি কেটে, ধুয়ে পরিষ্কার করে রেখেছি, একদম ডেকি মুরগি ভালো করে রাঁধবি।
চ্যাপা শুঁটকি এনেছি বেছে বেছে, বড় বড়, ঘ্রাণ অনেক। ভালো করে ধুয়ে ভর্তা বানাবি। কাঁচা মরিচেরটা, শুকনা মরিচেরটাও।
এই বিলু দেখ, কচুর লতিগুলো তোর বাবা খুব সুন্দর এনেছে। চিকন, সবুজ লকলক করছে। কুটে বেছে দেই। ইলিশ দিয়ে রান্না করবি তেলতেলে করে।
অতীতের দুঃখ, ক্ষোভ, ব্যর্থতার স্মৃতি বড় বিধ্বস্ত করে তোলে মাঝে মধ্যেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে আর গৃহকর্ম করে জীবন কাটিয়ে দিলাম। কী রেখে গেলাম পৃথিবীতে। মানব জনম বৃথাই গেল বুঝি। আবার যদি জীবনটাকে প্রথম থেকে সাজাতে পারতাম, তবে যে ভুলগুলো এ জীবনে হয়ে গেছে, সেগুলোকে শুদ্ধ করে ফেলতাম। কিন্তু সে তো হওয়ার নয়।
স্নেহের সুরে বিলু বলে, মা সবাই কি সব কিছু করতে পারে? মানুষ চলে যায়, থাকে তার কর্ম। মানুষকে ভালোবেসেছেন, অভাবীদের দান করেছেন, অভুক্তকে খাইয়েছেন, এমনকি চোর বা কাউকে আঘাত করতে দেখলে আগলে দাঁড়িয়ে রক্ষা করেছেন- এই বা কম কিসে? ফ্যালফ্যাল করে মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকেন আছিয়া বেগম।
দিনকে দিন শরীর খারাপের দিকেই যেতে লাগল। পা দু’খানা পাথরের মতো ভারী। পেটে পানি থইথই, সুন্দর মুখখানায় পানিতে টইটম্বুর, নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। ওষুধপথ্য সামনে দেয়া, বাথরুমে নেয়া, গোসল করানো, কাপড় চেঞ্জ করা, চুলে শ্যাম্পু করে তেল দিয়ে কাঁটা দিয়ে বেঁধে দেয়া, হাত-পায়ের নখ কাটা, মশারি টানিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়া- সবই করছেন তার ৪৫ বছরের বিবাহিত জীবনের স্বামী। তার পরও যত মেজাজ, যত রুক্ষতা সবই পড়ে তার ওপরে, মাঝে মধ্যে ইচ্ছেমতো বকাঝকা, অভিমান বিলুর ওপরও ঝাড়েন। ওরা জানে, ডাক্তার বলেছেন, এ পেসেন্ট এরকমটাই করবে। তিনি জেনেবুঝে করেন না। আপনাদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবেন যত দিন বেঁচে থাকেন।
এ বেলায় শরীর ভালো থাকে তো ও বেলায় খারাপ। ডাক্তার বলেছেন, এভাবেই থাকবে যত দিন ওপরওয়ালা হায়াত দিয়েছেন। আজ সকাল থেকে শরীর প্রচণ্ড খারাপ। আছিয়া বেগম স্বামীর হাতখানা ধরে বলেন, কখন কী হয়ে যায় ঠিক তো নেই। কিছু কথা বলে যাই। জীবন বড় ছোট। মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। আসলে জীবন থেকে এতগুলো বছর কোন দিক দিয়ে চলে গেল, টেরও পেলাম না। জন্ম মানেই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। এটাই চিরসত্য, এটাই মানতে হবে। জীবনে একসাথে চলার পথে সবারই কোনো-না-কোনোভাবে ভুল হয়ে যায়। মনে রেখো না, ক্ষমা করে দিও আমায়।
ছলছল চোখে বিলুর বাবা বলেন, আমাকেও ক্ষমা করে দিও তুমি। মৃদু হেসে আছিয়া বেগম বলেন, না করে উপায় আছে? যা করেছ আমার জন্য। হেলায়-ফেলায় জীবনটাকে পার করেছি। অসুখ-বিসুখ গায়ে মাখিনি। আজ বেলা শেষে এসে জীবনের জন্য বড় মায়া হয়। বড় বাঁচতে সাধ হয়। মনে মনে ভাবি, ঘুম থেকে উঠে যদি দেখি জীবনটা আগের মতো হয়ে গেছে। শরীরের রোগব্যাধি নিষ্কৃতি দিয়েছে। কিন্তু হায়, এ কখনো হওয়ার নয়। তোমার এত আদর, ভালোবাসা, মায়া-মমতায় বড় ভয় হয়। ও জিনিস থাকলে পৃথিবী ছেড়ে যেতে বড় কষ্ট হয়। মনটা ব্যথায় টনটন করে ওঠে। ডুকরে কেঁদে ওঠে বিলুর বাবা বলেন, এমন করে বলো না। নিঃস্ব মনে হয় নিজেকে, আমাকে একা করে কোথায় যাবে তুমি? বেঁচে থাকো দীর্ঘ দিন, এটাই আমার মনপ্রাণের বড় চাওয়া। ঠোঁটে হাসি চোখে কান্না নিয়ে আছিয়া বেগম বলেন, কবি কী বলেছেন শোনোনি?
যেতে নাহি দিবো হায়
তবু যেতে দিতে হয়।
তবু চলে যায়।