।। মো: হারুন-অর-রশিদ ।।
বিভিন্ন সময়ে বিশ্বে বহু স্বৈরশাসক এসেছেন। স্বৈরশাসকদের দুঃশাসন, অত্যাচার-নির্যাতন সম্পর্কে ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে। সমসাময়িক বিশ্বে অত্যাচারী স্বৈরশাসকের দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় হিটলার, মুসোলিনির নাম। যুগে যুগে দুনিয়ার বহু স্বৈরশাসকের জন্ম হয়েছে; যারা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এবং নিজ দেশের নাগরিকদের অনুগত রাখতে হেন অত্যাচার নাই যা করেননি। আমরা যদি হিটলারের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, তার নাৎসি বাহিনী বন্দী ও শ্রমশিবিরে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে। বিরুদ্ধবাদী কাউকে হিটলার জীবিত রাখতেন না।
অনুরূপভাবে ইতালির ফ্যাসিস্ট শাসক বেনিতো মুসোলিনির নাম কে না জানেন? ১৯২২-১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি ইতালির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ইতালির স্বৈরশাসক এবং ফ্যাসিবাদের প্রবক্তা হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ মতবাদ ছড়িয়ে দিতে তিনি প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। এ ছাড়াও স্পেনের স্বৈরশাসক ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো, জাপানের হিদেকি তোজো নিষ্ঠুরতায় যাকে এশিয়ার হিটলার বলা হয়। আমরা উপরোল্লিখিত স্বৈরশাসকদের বর্বরতার ইতিহাস পড়ে তাদের ঘৃণা করি। ইতিহাসের অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশেও তাদের মতো বা তাদের চেয়েও ভয়ঙ্কর স্বৈরশাসক বা ফ্যাসিস্ট শাসকের নির্মম-জুলুম-অত্যাচার প্রত্যক্ষ করতে হবে তা কেউ কল্পনাও করিনি।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এ দেশের মানুষ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের চাক্ষুস সাক্ষী। হিটলার-মুসোলিনির প্রতিভূ হয়ে ওঠেন শেখ হাসিনা। ক্ষমতার মাত্রাতিরিক্ত মোহ যেমন হিটলার-মুসোলিনির পতন ত্বরান্বিত করেছিল, শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছে। তিনি যেকোনোভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিলেন। আরো ক্ষমতা, আরো দুর্নীতি, লুটপাট, ব্যাংক থেকে টাকা পাচার, হত্যা, গুম, বিরোধী মত দমন, এসব হয়ে উঠেছিল শেখ হাসিনার শাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি দম্ভোক্তি করে বলেছিলেন, ‘আমি ক্ষমতা চাই, আমি দেশের উন্নতি করতে চাই। আমি অ্যাবসুউিলট পাওয়ার নিয়ে দেশের উন্নতি করব, এটিই আমার সাফ কথা।’
তার এ কথার মধ্যে স্বৈরশাসনের চরম নিষ্ঠুরতা লুকিয়ে আছে। যে কারণে তিনি জনগণের ভোটের থোড়াই কেয়ার করে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকার খোয়াব দেখছিলেন। ক্ষমতাকে এককেন্দ্রিক করার তার এ খায়েশের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে তাকে অমানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। জেল-জুলুম ছাড়াও কত মানুষকে যে হত্যা এবং গুমের শিকার হতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বিরোধী মতের যে কাউকে তিনি ন্যূনতম ছাড় দিতেন না। ‘আয়নাঘর’ নামক এক অবৈধ বন্দিশালায় বন্দী করে রেখেছেন বহু মানুষ। অনেকের হদিস পাওয়া যায়নি, আবার যারা ভাগ্যক্রমে বেঁচে এসেছেন; তারা যে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন, তা রীতিমতো লোমহর্ষক। কোনো নরপিশাচ ছাড়া মানুষের প্রতি এত নির্দয় হতে পারে না। বছরের পর বছর আয়নাঘর নামক অন্ধকার ছোট্ট ঘরে বন্দী রেখে মানুষের প্রতি যে নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছেন শেখ হাসিনা, ইতিহাসে তা ঘোর কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে।
ফ্যাসিবাদী শাসনকে এ ভূ-খণ্ডের মানুষ কখনো মেনে নেননি। তাই স্বাধীনতা পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী যত স্বৈরাচারী এবং ফ্যাসিবাদী শাসকের উত্থান ঘটে তাদের এ দেশের জনগণ গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে বিদায় করেছেন। স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদ হয়তো বিদায় নিয়েছে কিন্তু বিনিময়ে আমাদের বহু মূল্য দিতে হয়েছে। প্রশ্ন হলো, একবার ফ্যাসিবাদের বিদায়ের পর আবার কোন সুযোগে ফ্যাসিবাদ ফিরে আসে? এর জন্য দায়ী কারা?
আরও পড়তে পারেন-
- সাদকায়ে ফিতরের মাসাইল
- রমজানে মুমিনের প্রতিদিনের আমল
- মাহে রমযানের সিয়াম সাধনা ও তার আহকাম
- রমযান মু’মিনের জন্য কী প্রতিফল বয়ে আনে?
- ইসলামে শাসক ও শাসিতের পারস্পরিক হক
দেশে গণতন্ত্র, অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও সুশাসন বেষ্টিত করতে সংবিধানের মাধ্যমে সংসদসহ যেসব প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে বাকশালী শাসন আমলে এবং হাসিনার ফ্যাসিবাদী জমানায় ওই সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান স্বকীয়তা হারায়; বরং এসব প্রতিষ্ঠান অপব্যবহার করে হাসিনা নিজের শাসনামলে ফ্যাসিবাদের নির্মমতা এবং ভয়কে জনগণের মনন ও মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে কিছু সংবাদমাধ্যমসহ রাষ্ট্রের কিছু প্রতিষ্ঠান হাসিনাকে বেশি মাত্রায় ফ্যাসিবাদী হতে উৎসাহিত করে। সুবিধাভোগী এ গোষ্ঠী যারা ফ্যাসিবাদের দোসর হয়ে ওঠে এরা রাষ্ট্র, আমাদের সার্বভৌমত্ব এবং জনগণের কথা কখনো আমলে নেননি। আখের গুছিয়ে নেয়াই ছিল তাদের কাজ। হাসিনার নিজের স্বীকারোক্তি তার একজন পিয়নও ৪০০ কোটি টাকার মালিক। এভাবে যারা তাকে ফ্যাসিবাদী হতে উৎসাহিত করেন, তাদের সবাই দুর্নীতির মহারাজ্য বানিয়ে শত শত কোটি টাকার মালিক বনেছেন। দেশের মানুষ না খেয়ে মরলেও বিদেশের মাটিতে সেকেন্ড হোম বানিয়ে আয়েশি জীবনে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েন।
বহু জীবন ও বিপুল রক্তের বিনিময়ে হাসিনার অপশাসনের অবসানের পরও কি আমরা ফ্যাসিবাদী শাসনের আতঙ্ক থেকে মুক্ত? দেশের মানুষের কাছে এটি একটি বিরাট বড় প্রশ্ন। রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন স্তরে হাসিনার নিয়োগ করা যারা এখনো বসে আছেন; তারা রাষ্ট্রকে বিপথগামী করার অপচেষ্টা করছেন প্রতিনিয়ত। তাই তো দেখা যাচ্ছে নাগরিকের নিরাপত্তা এখন খুব দুর্বল। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষের মনে নাভিশ্বাস তুলছে, ঠিক তেমনি আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়েছে। সরকার সে দিকটি তেমন খেয়াল না দেয়ায় মানুষের মনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে, আদৌ আমরা সুশান পাবো কিনা। সন্দেহ আর বাস্তবতার নিরিখে জনজীবন যেন স্বাভাবিক হতে পারছে না। তবে এ কথাও সত্য, যেকোনো বিপ্লবের পর নৈরাজ্য, এমনকি প্রতিবিপ্লবের শঙ্কা তৈরি হয়; সেটি কাটিয়ে উঠতেও কিছুটা সময়ের প্রয়োজন।
ফ্যাসিবাদী শাসনের সবচেয়ে বড় ত্রুটি এরা নিজেদের ভুলত্রুটি কখনো ধরতে পারে না বা স্বীকার করে না। যেমন শেখ হাসিনা গত ১৫ বছরে ফ্যাসিবাদের চরম সীমায় পৌঁছার পরও কী পরিমাণ অপরাধ করেছেন তা বুঝতে পারেননি। এখনো তার বক্তব্যে অপরাধবোধ বা অনুশোচনার কোনো বালাই নেই। আয়নাঘরের নির্মম নির্যাতন তার কাছে খুব স্বাভাবিক ছিল। ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে দুই হাজারের বেশি মানুষকে গুলি করে হত্যা এবং হাজার হাজার মানুষকে পঙ্গু করার পরও শেখ হাসিনার ন্যূনতম অপরাধবোধ কাজ করেনি। বাস্তবতা হলো একজন ফ্যাসিস্টের কাছে গণহত্যা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। স্বৈরশাসক বা ফ্যাসিবাদী শাসকদের এ নির্মমতার ফল হিসেবে তাদের জীবনের শেষ পরিণতি খুব দুর্বিষহ হয়। দুনিয়ার স্বৈরশাসকদের শেষ জীবন বড়ই মর্মান্তিক হয়ে থাকে। যেমন হিটলার আত্মহত্যা করেছেন, মুসোলিনি গণপিটুনিতে মারা গেছেন, চসেস্কু ও তার স্ত্রীকে মাত্র কয়েক মিনিটের বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, জাপানের হিদেকি তোজোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়, সাদ্দাম হোসেন, মুয়াম্মার গাদ্দাফির পরিণতি আমাদের চোখের সামনে এখনো ভাসছে। শেখ মুজিবকে হত্যা করা হলেও তার কন্যা শেখ হাসিনা ৪৫ মিনিট সময় পেয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে জীবন রক্ষা করেছেন।
এ দেশের মানুষ এক বুক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে জীবনের মায়া ত্যাগ করে ফ্যাসিবাদ, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লাড়াই করে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনতে নেয়েছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব একনায়ক আইয়ুব খানের শাসনের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ লড়াই-সংগ্রাম করেছেন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আকাক্সক্ষায়, তা পূরণ না হওয়ায় পাকিস্তান কাঠামো ভেঙে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করেন এ দেশের মানুষ। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মাথায় জাতির ঘাড়ে চেপে বসে একদলীয় শাসনব্যবস্থা। পঁচাত্তরে তা থেকে মুক্তি পান দেশের মানুষ। কিন্তু এর পর জাতির ঘাড়ে চেপে বসে স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামল। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই স্বৈশাসনের অপসান হয়। আর চব্বিশে হাসিনার ফ্যাসিবাদী জমানার অবসান ঘটিয়েছেন এ দেশের ছাত্র-জনতা। দেখা যাচ্ছে, দেশের মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের আত্মবিশ্বাস জেগেছে বারবার। কিন্তু স্বপ্ন বারবার হোঁচট খেয়েছে। যেকোনো কায়দায় গণতন্ত্রের পোশাক পরে স্বৈরতন্ত্র ফিরে এসেছে। হাসিনাও একই কায়দায় বিগত ১৫ বছরে জনগণের এ ফ্যাসিবাদবিরোধী আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করতে কোনো অপচেষ্টাই বাদ দেননি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। চূড়ান্তভাবে হাসিনা পরাজিত হয়েছেন। হাসিনার পতনের পরও জনগণের মনে এখনো ভয় দূর হয়নি। তারা এখনো শঙ্কায় রয়েছে, আবারো ভিন্ন কোনো মোড়কে অপশাসন ফিরে আসে কিনা!
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ