মার্কিন গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ইউক্রেনে সাময়িকভাবে সামরিক সহায়তা স্থগিত করবে যুক্তরাষ্ট্র। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনকে দেওয়া মার্কিন সামরিক সহায়তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষ করে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা এবং এর গোলাবারুদ।
প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষার সবচেয়ে শক্তিশালী উপকরণ। যদিও এটি দশ বছর আগে উন্নত করা হয়েছিল, তবুও এটি যুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর, বিশেষ করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে। প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনে যতটা পরীক্ষিত হয়েছে, ততটা বিশ্বের আর কোথাও হয়নি। রাশিয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে শত শত ড্রোন এবং কয়েক ডজন ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে দেওয়ার সামর্থ্য রয়েছে। প্যাট্রিয়টের কারণে অনেক রুশ আক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে।
প্যাট্রিয়ট একমাত্র ব্যবস্থা যা রাশিয়ার কিজহাল ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করতে সক্ষম, যা ক্রেমলিনের অন্যতম উন্নত অস্ত্র।
এর আগে মস্কো দাবি করেছিল, কিজহাল প্রতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব। প্রতিবেদন অনুযায়ী এই ক্ষেপণাস্ত্রের গতি ১৪ হাজার কিলোমিটার/ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে। তবে ইউক্রেন প্রমাণ করেছে, এটির প্রতিরোধ করা আসলে সম্ভব।
মার্কিন সহায়তা বন্ধ হলে কী হবে?
যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউক্রেনকে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করা বন্ধ করে, তাহলে এর প্রভাব হবে মারাত্মক। ইউক্রেন ইতোমধ্যেই এটি টের পেয়েছে।
২০২৩–২৪ সালে যখন মার্কিন সাহায্য বিলম্বিত হয়েছিল, তখন ইউক্রেন প্রয়োজনীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র পায়নি। এর ফলে দেশটির বেশ কিছু শক্তিশালী অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়, যার মধ্যে ছিল ট্রিপিলিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
সে সময় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছিলেন, ইউক্রেনের কাছে আর আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য গোলাবারুদ ছিল না। ১১টি রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে সাতটি ইউক্রেন আটকাতে পেরেছিল। বাকি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। কারণ ইউক্রেনের কাছে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র অবশিষ্ট ছিল না।
বর্তমানে ইউক্রেনের কাছে ছয়টি প্যাট্রিয়ট ব্যবস্থা রয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের সঠিক অবস্থান গোপন রাখা হয়েছে। কারণ এগুলো রুশ হামলার শীর্ষ লক্ষ্যবস্তু।
তবে ইউক্রেনের সামরিক নেতৃত্ব নিশ্চিত করেছে, প্যাট্রিয়টগুলো সক্রিয়ভাবে ইউক্রেনীয় শহরগুলোকে রক্ষা করছে। তবুও এগুলোর সংখ্যা যথেষ্ট নয়। ধারণা করা হচ্ছে, ইউক্রেনের প্রধান শহর, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো এবং সামরিক স্থাপনাগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে ইউক্রেনের ২৫-৩০টি প্যাট্রিয়ট ব্যবস্থার প্রয়োজন।
কিন্তু ইউক্রেনের সংকট শুধু প্যাট্রিয়টের সংখ্যার দিকে থেকেই নয়, দেশটির ক্ষেপণাস্ত্রেরও অভাবও রয়েছে।
সহযোগী দেশগুলোর মাধ্যমে সমাধান
একটি সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে– যেসব দেশ ইতোমধ্যে প্যাট্রিয়ট ব্যবস্থা চালু করেছে, তাদের সঙ্গে কাজ করা এবং তারা কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনকে সরবরাহ করতে পারে।
যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তা থেকে জানা যায়, আমেরিকা প্যাট্রিয়ট ব্যবস্থা বিক্রি করেছে– ইউরোপের জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, রোমানিয়া, পোল্যান্ড, গ্রিস ও স্পেনের কাছে; এশিয়ার জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের কাছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইসরায়েলের কাছে।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
যদিও এই দেশগুলোর মধ্যে কোনো দেশ তাদের পুরো মজুদ হারাতে চায় না, তবে তারা তাদের মজুদ থেকে কিছু অংশ স্থানান্তর করতে সক্ষম হতে পারে। এটি ইউক্রেনকে কিছু সময়ের জন্য তাদের প্রতিরক্ষা বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
এছাড়াও, ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশগুলো সরাসরি আমেরিকা থেকে প্যাট্রিয়ট মিসাইল কেনে। সেগুলো তারা ইউক্রেনকে সরবরাহ করতে পারে।
আগামী এক থেকে দুই বছরের মধ্যে জার্মানি প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন স্থানীয়করণ করার পরিকল্পনা করছে, যা ইউক্রেনের জন্য সরবরাহ বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। তবে এই সময়ে ইউক্রেন কী করবে– এই প্রশ্নটি অত্যন্ত জরুরি।
কোনো বিকল্প আছে?
ইউক্রেনের বিভিন্ন আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। তবে তাদের সক্ষমতা সীমিত। এসব ব্যবস্থা ড্রোন এবং আকাশপথের কিছু লক্ষ্যবস্তুর প্রতি কার্যকর হলেও, উন্নত ক্রুজ এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে অকার্যকর। উদাহরণস্বরূপ, এনএএসএএমএস ব্যবস্থার পরিসীমা ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত, যেখানে প্যাট্রিয়ট ব্যবস্থা ১৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত হুমকি প্রতিহত করতে সক্ষম এবং আরও বিস্তৃত ধরনের হুমকিকে লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারে।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন এক মাসে ১০টিরও বেশি রুশ বিমান ভূপাতিত করেছে, যা একটি চমকপ্রদ অর্জন। যদিও সরকারিভাবে নিশ্চিত করা হয়নি, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সাফল্য প্যাট্রিয়ট ব্যবস্থার সাহায্যে সম্ভব হয়েছে, যা রুশ বিমানবাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে।
ইউরোপের একমাত্র ব্যবস্থা যা প্যাট্রিয়টের সাথে তুলনা করা যেতে পারে, তা হলো এসএএমপি/টি। এটি ইউরোপীয় প্রস্তুতকারক ইউরোসামের তৈরি। ইউক্রেন বর্তমানে দুটি এসএএমপি/টি ইউনিট ব্যবহার করছে। তবে এটি যথেষ্ট নয়।
প্যাট্রিয়টের মতো ফলাফল অর্জন করতে, ইউক্রেনের অনেক বেশি ইউনিটের প্রয়োজন। তবে, উৎপাদন একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। এই প্রোগ্রামের এক প্রস্তুতকারক থ্যালেস জানিয়েছে, ইতালি ও ফ্রান্সের যৌথ মালিকানায় মাত্র দশটি এসএএমপি/টি সিস্টেম রয়েছে এবং তাদেরও ঘাটতি রয়েছে।
এসএএমপি/টি সিস্টেম অ্যাস্টার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে, যার উৎপাদনের জন্য দীর্ঘ সময় লাগে। আগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, একটি অ্যাস্টার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে ৪০ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তবে ২০২৫ সালের মধ্যে এটি ১৮ মাসে নামিয়ে আনার প্রচেষ্টা চলছে।
কিছু ব্যক্তি ইসরায়েলি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিকল্প হিসেবে প্রস্তাব করেছেন। তবে ইসরায়েল এখন পর্যন্ত ইউক্রেনকে কোনো সামরিক সহায়তা দেয়নি।
বিকল্প খোঁজা ভুল পন্থা কেন?
প্যাট্রিয়ট এবং এসএএমপি/টি ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলার সময় এটা শুধু ভূ-রাজনৈতিক বা সামরিক কৌশলের বিষয় নয়, এটা ইউক্রেনের শহর এবং সেখানকার মানুষের সুরক্ষার প্রশ্ন।
রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের তিন বছরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইউক্রেনের ৮০ শতাংশ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস হয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেনের প্রাকৃতিক গ্যাস অবকাঠামোকেও নিয়মিতভাবে লক্ষ্যবস্তু করছে। এসব হামলা শুধু বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণ নয়, এগুলো বড় ধরনের শিল্প দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করছে। যেমন, দনিস্তার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস হলে মলদোভার কিছু অংশে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের জন্য প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখা অত্যন্ত জরুরি। বিকল্প খোঁজার বদলে এসব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একে অপরের পরিপূরক হওয়া উচিত। কারণ, রাশিয়া তার আক্রমণ শুধু বাড়িয়েই চলেছে। ২৩ ফেব্রুয়ারির রাতে রাশিয়া ২৬৭টি শাহেদ ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্রের সমন্বিত আক্রমণ চালায়।
ইউক্রেনের আত্মরক্ষার সক্ষমতা নির্ভর করছে ধারাবাহিক আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর। এই সহায়তা বন্ধ হলে পরিণতি হবে ভয়াবহ।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়।
উম্মাহ২৪ডটকম: আইএ