।। মুবিন এস খান ।।
আমার স্ত্রীর দাদি ও নানির পূর্বপুরুষের নিবাস ছিল ওপার বাংলায়– যা এখনকার পশ্চিমবঙ্গ। কলকাতায় দাদির বাড়িতে গরমের পুরো ছুটিটা কাটাতো সে; এভাবেই ওর বেড়ে ওঠা। সে আজো এনিয়ে অনেক গল্প আমাকে শোনায়, আলীপুরের সেই বাড়িতে কাটানো ওর ফেলে আসা দিনগুলোর টুকরো টুকরো স্মৃতির রোমন্থন, হাসিকান্নার ছোট ছোট মুহুর্ত।
ওরা যখন বাজার করতে যেত, দোকানি কিছুতেই কেজিতে সবজি বেচতে চাইত না, বিক্রি করতো পিস হিসেবে। বাংলাদেশে এই ধরনের রীতি ভাবাই যায় না। তাছাড়া, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কৃপণতা সম্পর্কে এদেশে প্রচলিত আছে পেটে খিল ধরানো অনেক হাস্যরসের ঘটনা। এমনকিছু কৌতুকের ঘটনা সে-ও বলেছে; যেমন একবার ওঁরা চারজন মিলে গিয়েছিল এক আত্মীয়ের বাড়িতে, সেখানে ভাতের সাথে ওদের মাত্র চার টুকরো মুরগির মাংসই পরিবেশন করা হয়েছিল।
আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের মতো শত শত বাংলাদেশির কাছে কলকাতা, মুর্শিদাবাদসহ পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য স্থান একইরকম স্মৃতিবিজড়িত। নিজস্ব স্মৃতি, পিতৃপুরুষের স্মৃতি, স্মৃতি সেই ঘরদুয়ার আর পারিবারিক জীবনকে ঘিরে— ১৯৪৭’ এর দেশভাগের সময় যা ফেলে আসতে হয়েছে। কারো কারো স্মৃতি বা পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে– ভারতের সেভেন সিস্টার বলে অভিহিত রাজ্যগুলোর বিভিন্ন শহর বা গ্রামের সাথে, কারো বা বিহার অথবা ভারতের আরও দূরতম প্রদেশের সাথেও।
বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মালম্বীদের জন্য এসব বন্ধনের শেকড় তো আরও গভীরে। তাছাড়া, পারিবারিক কোনো সংযোগ নেই– এমন বহু মানুষই ভারতে যান ছুটি কাটাতে বা চিকিৎসাসেবা নিতে। কেউবা ছেলেমেয়েকে পড়ান সেখানকার কোনো বোর্ডিং স্কুলে, কেউবা যাচ্ছেন উচ্চশিক্ষার জন্য, বা কেনাকাটা করতে। আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যও ব্যাপক দু’দেশের মধ্যে। এভাবে উভয় দেশের সংস্কৃতির যে আদানপ্রদান হচ্ছে, সঙ্গতকারণেই তার বন্ধনকে অনেক গভীর বলে মনে হয়।
দিল্লির সাউথ ব্লক তাঁদের সম্পর্কে যা ভাবে (কথিত অনুপ্রবেশকারী) তা নিয়ে এসব বাংলাদেশিরা কেউই কেয়ার করে না। ভারতের একের পর এক কেন্দ্রীয় সরকারের কেবল আওয়ামী লীগকেই তাদের একমাত্র মিত্র হিসেবে দেখা; অথবা বাংলাদেশকে তাদের চিরশত্রু পাকিস্তানের মতো উগ্রবাদী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতীয় গণমাধ্যমের ক্রমাগত অপপ্রচার নিয়েও বাংলাদেশিদের মাথাব্যথা নেই।
কিন্তু, যখন দুই দেশের সীমান্তে শত শত বাংলাদেশিকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়— তখন সঙ্গতকারণেই ক্ষুদ্ধ হয় দেশবাসী। একইভাবে ভারত যখন ষড়যন্ত্র ও কূটচালের মাধ্যমে পাতানো নির্বাচন করে তার মিত্র আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা ধরে রাখতে সাহায্য করেছে— তখন এদেশের মানুষ নিজেদের প্রতারিত, বঞ্চিত বলে মনে করেছে। আওয়ামী সরকার যখন ভারতের সাথে অন্যায্য বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি করে দেশের মানুষের ওপর দেনার বোঝা আরও বাড়ায়; অথচ একইসময় সংরক্ষণবাদী পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ভারতের বাজার প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়— তখনও বাংলাদেশিরা অপমানিত বোধ করেছে। যখন ট্রানজিটের নামে বাংলাদেশের মহাসড়কগুলো দিয়ে ভারতের ভারী ট্রাকগুলোকে অবাধে চলাচল করতে দেওয়া হয়, অথচ আন্তঃসীমান্ত নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা যুগের পর যুগ ধরে পায় না বাংলাদেশের মানুষ— তখন আমরা সংক্ষুদ্ধ হই। আবার যখন বাংলাদেশের মানুষ নিজের বাড়ি থেকেই গুম হয়ে যায়, আর পরে তাদেরকে পাওয়া যায় ভারতের জেলে— তখন আতঙ্কে শিহরিত হই আমরা।
সুতরাং, শ্রী জয়শঙ্কর, বাংলাদেশিরা ভারতের সাথে কোন ধরনের সম্পর্ক চায় বলে আপনি যে প্রশ্ন রেখেছেন— তার উত্তরে হচ্ছে, এটা হতে হবে সেই ধরনের সম্পর্ক যেখানে বাংলাদেশকে আপনারা করদরাজ্য হিসেবে দেখবেন না, যাকে আপনারা পেশিশক্তি খাঁটিয়ে নিয়ন্ত্রণ করবেন– আপনাদের পোষ্য ও প্রক্সি রাজনৈতিক দলের সাহায্যে। বাংলাদেশের মানুষ চায় ভারতের সাথে সমতার সম্পর্ক, যেখানে উভয় দেশের জনগণের মধ্যেকার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের গভীরতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
এটি এমন সম্পর্ক হবে, যেখানে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান ও স্বীকৃতি দেবে ভারত, এবং কোনো পুতুল শাসকগোষ্ঠী চাপিয়ে দিতে হস্তক্ষেপ করবে না, যারা বাংলাদেশিদের বাদ দিয়ে শুধু ভারতের স্বার্থ রক্ষা করবে। আমরা এদেশের মানুষ এমন সম্পর্ক প্রত্যাশা করি, যেখানে প্রকৃত অংশীদারত্বের ভিত্তিতে উভয় দেশের বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো হবে— যা থেকে দুই দেশের জনগণই উপকৃত হয়।
এটি সেই ধরনের সম্পর্ক হতে হবে, যেখানে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) নামের কোনো অপমানকর আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ করবে না ভারত, অথবা বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঞ্চনে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টা করবে না। এটি সেই ধরনের সম্পর্ক হওয়া উচিৎ, যেখানে নিজ দেশের মানুষকে অবাধে হত্যাকারী বাংলাদেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে আপনাদের দেশে গিয়ে আশ্রয় নিতে এবং তারপর সেখানে বসেই বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করতে পারবে না।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা গণহত্যার শিকার হচ্ছে— ভারতীয় গণমাধ্যমের এই বয়ান গত এক মাস ধীরে কিছুটা থিতিয়ে পড়ার বিষয়টিও লক্ষ্যণীয়। এতে মনে হতেই পারে, সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক করতে ভারত সরকার আগ্রহী হয়েছে।
দুই দেশের জনগণের মধ্যেকার প্রকৃত সম্পর্কের গভীরতা ও ব্যাপ্তি রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, বর্তমানে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের যে ভাটা পড়েছে– সেটি অনির্দিষ্টকাল অব্যাহত রাখা উভয় দেশের স্বার্থের জন্যই টেকসই হবে না। কারণ, ভৌগলিক, ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে আমাদের বন্ধন অনেক গভীর।
মি. জয়শঙ্কর – সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আপনি দৃশ্যত আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন, (যদিওবা তা ছিল মিশ্র ইঙ্গিতপূর্ণ) – কিন্তু এখনই সময় আপনার বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের সম্পর্কে কিছুটা বোঝাশোনার— যে দেশটিকে নিয়ে আপনারা সবাই বলেন, এদেশ স্বাধীন করতে সাহায্য করেছিল ভারত, এবং সেটি সঠিকও।
কিন্তু, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশিরা সংগ্রাম করেছিল– এইজন্য যে তাঁরা কোনো ধর্মীয় পরিচয়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে শোষিত হতে চায়নি। একইভাবে তাঁরা ভারতের পদপিষ্ট হওয়ার জন্যও করেনি স্বাধিকার সংগ্রাম।
বাংলাদেশিরা এমন রাষ্ট্রের নির্মাণ চান, যেখানে এপার বাংলার বাঙালির অর্থনৈতিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত প্রতিফলন ঘটবে। যেসব আকাঙ্ক্ষাকে বার বার ব্যাহত করা হয়েছে, এবং তা কেবল আপনার সরকারই করেনি, এতে ভূমিকা রাখে অন্যান্য আন্তর্জাতিক পক্ষ ও কুশীলবরা (তবে গত ১৫ বছরে আপনার দেশের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে জ্বলজ্যান্ত)।
ঠিক একারণেই স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও আমাদের আরও একবার সামাজিক চুক্তিগুলোকে নতুন করে চিহ্নিত করতে হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবারো গড়ে তুলতে হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া বিশৃঙ্খলাপূর্ণ তাতে সন্দেহ নেই, এবং সেখান থেকে আসা কিছু শোরগোল আপনাদের কাছে হয়তো উদ্বেগজনকও মনে হবে। কিন্তু, সেটা যেমনই হোক, বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয়— সেটি আমাদেরই দেখতে দিন। এইবার আপনাদের বরং উচিৎ প্রতিবেশীর আকাঙ্ক্ষা, অভিপ্রায়গুলোকে বুঝতে আন্তরিক হওয়া, এবং বড়দাদাসুলভ আচরণ না করা— যাতে আপনারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তাহলেই দেখবেন, যে জায়গায় আপনাদের স্বার্থ, যেমন বাংলাদেশের চারপাশে আপনাদের সেভেন সিস্টার্সের নিরাপত্তার বিষয়— সেখানে বাংলাদেশও আপনাদের নিরাশ করবে না।
উম্মাহ২৪ডটকম: আইএ