Home জাতীয় ইন্ডিয়া ফাঁসির খেলাটা খেলছে হাসিনাকে দিয়ে

ইন্ডিয়া ফাঁসির খেলাটা খেলছে হাসিনাকে দিয়ে

পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাতবারের সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। এর আগে তিনি কলেমা পড়তে পড়তে ওই ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয় গিয়েছিলেন। পরে কারা কর্তৃপক্ষ তার লাশ চট্টগ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল।

ওই রাতে জল্লাদ তাকে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে কারা কর্তৃপক্ষ বিধি অনুযায়ী তাকে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে একান্তে কথা বলার সুযোগ দেয়। এর আগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার আবেদন করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি কারা কর্তৃপক্ষের সেই আবেদনে সাড়া না দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি তো কোনো অপরাধ করিনি। আমি কার কাছে মাফ চাইব? ওই দাদাদের কাছে মাফ চাইব? তাদের কাছে চাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না’।

যদিও কারা কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে একজন কর্মকর্তা দাবি করছেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে নিজ হাতে লেখা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রানভিক্ষার জন্য আবেদন করেছিলেন। এমন নথি কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে এমন কথার বিপরীতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাই গিয়াস কাদের চৌধুরী বলছেন, যদি এমন প্রাণভিক্ষার কোনো ধরনের আবেদনের নথি কারা কর্তৃপক্ষের কাছে থাকে তাহলে সেটা তারা দেখাক?

যেভাবে ফাঁসি কার্যকর : ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর। সন্ধ্যার পরপরই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান গেট দিয়ে ঢাকার সিভিল সার্জনসহ প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তার উপস্থিতিতে ফাঁসি কার্যকর হওয়ার কথা তাদের সবাই এক এক করে কারাগারের ভেতরে প্রবেশ করতে থাকেন। ভেতরে যাওয়ার পর তাদের সবার মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। রাত যত বাড়তে থাকে কারাগারের ভেতরে সুনশান নীরবতাও বাড়তে থাকে। বন্দীদের সবাইকে লকাবে আটকে ফেলা হয়। এরপরই কারা কর্তৃপক্ষের ডাকে সাড়া দিয়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সাথে তার স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারের অন্য সদস্যরা কারাগারে প্রবেশ করে সোজা কনডেম সেলের ৮ নম্বর কক্ষে চলে যান। যেটির দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ তিন-ছয় হাত। নেই জানাল। সেখানে তাদের মধ্যে একান্তে শেষ বিদায়ী সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়। অশ্রুসিক্ত স্বজনরা বের হওয়ার পর শুরু হয় তাকে তওবা পড়নোসহ ফাঁসির প্রস্তুতি। ৮ নম্বর সেল থেকে ফাঁসির মঞ্চের দূরত্ব মাত্র কয়েক হাত। জল্লাদ যখন তাকে ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তার মুখে শেষ কথাগুলো ছিল শুধুই কলেমা। মৃদু স্বরে কলেমা পড়তে পড়তে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে যান তিনি। এরপর রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে জল্লাদ লিভার টান দিয়ে তার ফাঁসি কার্যকর করেন। এ দিন তার সাথে একই সময়ে ফাঁসি কার্যকর করা হয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ।

এসব তথ্য জানিয়ে একজন সরকারি কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ দু’জনই নফল নামাজ পড়েছিলেন। দোয়া পড়তে পড়তে তারা দু’জনে পাশাপাশি থাকা ফাঁসির মঞ্চে গেছেন। তিনি বলেন, ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর গোসল করানো হয়। এরপর লাশ কফিনে ভরা হয়। মসজিদের ইমাম সাহেব নামাজে জানাজা পড়ানোর পর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ দু’জনের লাশ পুলিশের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। পরে পুলিশ উনাদের দেয়া ঠিকানায় লাশ পৌঁছে দেয়।

ওই কর্মকর্তা দাবি করেন, ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজ হাতে প্রাণভিক্ষার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছিলেন। যদিও তিনি এ ব্যাপারে বিস্তৃত কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তার বক্তব্য হচ্ছে এই বিষয়টি খুবই সেনসিটিভ। তার পরিবারের পক্ষ থেকে কী বলা হচ্ছেÑ সেটাই আগে শোনা দরকার বলে জানান তিনি। তবে তার প্রাণভিক্ষা চাওয়ার আবেদন কারা কর্তৃপক্ষের কাছে এবং মন্ত্রণালয়ে সরকারের নথিতে আছে বলে দাবি করেন তিনি।

কারা অধিদফতরের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি হওয়ার আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকের বিরুদ্ধেই তিনি বেশ জোরেশোরে কথা বলতেন। এর মধ্যে ফাঁসি দেয়া প্রসঙ্গে একদিন শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে এই টুকুই বলতে শুনেছিলাম, ‘এখানে আমার বইনের কিছু করার নাই, এটা তো অন্য জায়গার খেলা’। কাশিমপুর কারাগারে থাকা অবস্থায় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রায় কাছের লোকজনের কাছে বলতেন, তিনি কোনো অপরাধ করেননি, তাহলে তিনি কী কারণে প্রাণভিক্ষা চাইবেন? বরং তিনি তার পরিবারের মাধ্যমে দেশবাসীর উদ্দেশ মেসেজ দিয়ে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলার বিচার কার্যক্রম থেকে শুরু করে ফাঁসির রায় হওয়া পর্যন্ত পুরোটাই ছিল শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের বিচারালয়ের একটা সাজানো নাটক। তিনি এ-ও বলতেন, ফাঁসি হলে হবে, তবুও তিনি শেখ হাসিনা বা তার ‘প্রভু’ ভারতের দাদাদের কাছে নতি স্বীকার করবেন না। আর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা কেন চাইবেন? যদি প্রাণভিক্ষা চাইতেই হয়, তাহলে তিনি মহান রাব্বুল আলামিনের কাছেই চাইবেন, অন্য কারো নয়’।

উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অপরাধ সংগঠনের দায়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যে ছয়জন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সামাজিক ব্যক্তিত্বকে শেখ হাসিনার সরকারের বিচার বিভাগ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে তাদেরই একজন হচ্ছেন চট্টগ্রামের জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগ পর্যন্ত শেষ তিন দিন অথবা চার দিন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির মঞ্চের কয়েক হাত দূরের ৮ সেলের একটি (কনডেম সেল) কক্ষে রাখা হয়েছিল। এর আগে অবশ্য বেশির ভাগ সময়ই তাকে কাটাতে হয়েছিল কাশিমপুর কারাগার পার্ট-১ এর ১/৩ নম্বর (হাসপাতালের পাশে) একটি কক্ষে। সেখানে পাশাপাশি তিনটি রুম রয়েছে। তার একটিতে তিনি থাকতেন। অবশ্য ধানমন্ডির সেইফ হাউজ থেকে গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে কয়েক মাস পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের (বর্তমানে পরিত্যক্ত) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল। সেখানে যাওয়ার পর তাকে দফায় দফায় তখনকার গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্যরা কারাগারের গেটের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। ওই সময় সাক্ষাৎ কক্ষে কারা গেটের সামনে তার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে অনেকের সামনেই তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন, এই সব যুদ্ধাপরাধ মামলা টামলার নাটক শেখ হাসিনার গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব মিথ্যা মামলায় তার কিচ্ছুই হবে না বলেও তিনি তার মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন।

কাশিমপুর কারাগারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই কারাগারের হাসপাতালের ১/৩ নম্বর একটি সেলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ তিনজনকে রাখার ব্যবস্থা করেন কারা কর্তৃপক্ষ। তিন রুমের একটিতে ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির এবং যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল মামলায় আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া আসামি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। অপরটিতে ছিলেন ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার অন্যতম আসামি উইং কমান্ডার (অব:) সাহাবুদ্দিন আহমেদ। ওই কারাগারে বন্দী থাকার সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন এমন একাধিক কারারক্ষীর সাথে সালাহউদ্দিন কাদের মন খুলে কথা বলতেন। বলতেন তার জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক আলোচিত কথা ও গল্প। প্রায় সময়ই তিনি শেখ হাসিনা (সাবেক প্রধানমন্ত্রী) এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নাম ধরেই নানা কথা বলতেন। তবে যুদ্ধাপরাধ মামলায় তার ফাঁসি হচ্ছেÑ এটা তিনি কখনো বিশ্বাসই করতেন না। উল্টো সেলে থাকা অন্যদের কাছে শতভাগ কনফিডেন্স নিয়ে বলতেন, ‘শেখ হাসিনা তাকে জেল খাটালেও শেষ পর্যন্ত তাকে ফাঁসি দেয়ার সাহস দেখাবে না। দিতে পারবেও না। কারণ হাসিনার সাথে তার পরিবারের যেমন সম্পর্ক তেমনি রয়েছে ব্যক্তিগত সম্পর্কও।’

কারাগারের একজন দায়িত্বশীল সদস্য নয়া দিগন্তকে বলেন, কাশিমপুর কারাগারে থাকার সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রতিদিন নামাজ পড়তেন। রোজা রাখতেন এবং নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করতেন। বাকি সময় দেশের রাজনীতি, পারিবারিক ইতিহাস, সামাজিক কাজ নিয়ে আলোচনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে খোশ গল্প করতেন। এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ইন্ডিয়া সরকারের বেশি বেশি সমালোচনা করতেন তিনি।

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর থাকা, খাদ্য পরিবেশন এবং নজরদারির দায়িত্বে ছিলেন এমন একজন কারারক্ষী সম্প্রতি নয়া দিপ্রন্তর কাছে নিজের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, এই কারাগারে আসার পর থেকেই আমি তার সমন্ত দেখভাল করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সুযোগ পেলেই তিনি আমার সাথে পারিবারিক, রাজনৈতিকসহ সব বিষয়ে খোলামেলা কথা বলতেন। মাঝেমধ্যে ভালো খাবার খেতে চাইতেন। আমিও সেটি পূরণের যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম। তিনি বলেন, ফাঁসির আগের দিন দেশী মুরগির গোশত খেতে চেয়েছিলেন তিনি। আমি বাইরে রান্না করে সেটি তাকে দেয়ার চেষ্টা করেছি। ওই রক্ষী বলেন, যখন পাশের রুমের বন্দীদের সাথে গল্প করতেন তখন তিনি শুধু ইন্ডিয়ার নাম উল্লেখ করেই বেশি গালাগালি দিতেন। বলতেন, এই ইন্ডিয়ার কারণেই তো আজকে আমরা জেলের মধ্যে আছি। ইন্ডিয়াই তো ফাঁসি দেয়ার খেলাটা খেলতেছে হাসিনাকে দিয়েই। আবার এ-ও বলতেন, শেখ হাসিনা আমাকে ফাঁসি দেয়ার ক্ষমতা রাখে না!

আরও পড়তে পারেন-

গতকাল সোমবার দুপুরের পর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছোট ভাই গিয়াস কাদের চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার ভাইয়ের ফাঁসি হওয়ার বিষয়ে প্রথমেই বলেন, আমার ভাইকে তো আওয়ামী লীগ সরকার পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। আমরা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে তার ডেথ সার্টিফিকেট চেয়ে আসছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা আমাদেরকে তার ডেথ সার্টিফিকেটটা পর্যন্ত দিতে পারেননি। এখন আবার মিথ্যা অপপ্রচার করছে, সে নাকি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিল। কোথায় আবেদন করেছে, কার কাছে করেছে, সেটার প্রমাণ দিক না তারা? যদি আবেদন করতো তাহলে অবশ্যই আওয়ামী লীগ সরকারের পত্রিকাগুলো তখনই চিঠিসহ প্রকাশ করে দিত। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ওই মার্সির কপি তো জেল কর্তৃপক্ষের কাছে থাকার কথা, রাষ্ট্রপতির দফতরে থাকার কথা। তাহলে কোথায় সেই কপি ? এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার ভাইকেসহ যাদেরকে বিনা দোষে ফাঁসি দেয়া হয়েছে, তাদের সবার জাজমেন্টই কিন্তু ওই সময় লেখা হয়েছিল হোম মিনিস্ট্রি থেকে। আর এই জাজমেন্ট জানাজানি হওয়ায় আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুলসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে জেলও খাটানো হয়েছিল। আমার ভাইকে হত্যা করার পর এখনো তাকে সবার সামনে ছোট করার জন্য আওয়ামী চক্র লেগে আছে। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার ভাইয়ের ছেলে হুম্মাম কাদেরকে ওই সময় গ্রেফতার করে গুম করা হয়েছিল। এরপর তখনকার ডিজিএফআইয়ের ডিজি এবং কাউন্টার টেরোরিজমের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তৌহিদ তাকে আয়নাঘরে আটকে রেখেছিলেন। এখন সে মুক্ত হলেও অনেকটা ট্রমায় আছে।

গতকাল সন্ধ্যার পর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নির্যাতিত ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীর সাথে বারবার যোগাযোগ করার পর তাকে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, আমার আব্বুকে আওয়ামী লীগ সরকার একদম পরিকল্পিতভাবেই ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছে। ফাঁসি যেদিন হবে সেই রাতে আমরা তার সাথে শেষবারের মতো দেখা করতে গিয়ে জানতে পারি, কারা কর্তৃপক্ষ আজ রাতেই যে তার ফাঁসি কার্যকর হচ্ছেÑ সেটা তাকে জানায়নি। পরে আমরা যখন তার সেলে যাই, তখন দেখি তিনি ঘুমিয়ে আছেন। জাগানোর পর তিনি আমাদের কাছে জানতে চান তোমরা এখানে? তখন আমি বলি, আব্বু যা হওয়ার আজ রাতেই তো হবে। তখন তিনি আমাদেরকে তার সেলের ভেতরে ডেকে নিয়ে জড়িয়ে ধরেন। আমি আব্বাকে বললাম, তোমার বিরুদ্ধে তো ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। তুমি বলে ক্ষমা প্রার্থনা করছ। তখন আব্বু বলেন, তোমাদের কি মনে হয় আমি মার্সি পিটিশন করব? আমি তো দুনিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছি, এখন কত মানুষ কত কথা বলবে। আমার তো আর কিছু করার নাই। ওটা তোমাদেরকেই সামাল দিতে হবে। মার্সি পিটিশন করার প্রশ্নই উঠে না। তোমাদেরকে আমি বলে যাচ্ছি, তোমরা যতদিন বেঁচে থাকবা ততদিন মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকবা।

ডেথ সার্টিফিকেট প্রসঙ্গে হুম্মাম কাদের চৌধুরী নয়া দিগন্তকে বলেন, সন্তান হিসেবে আমরা আব্বুর ডেথ সার্টিফিকেট পাওয়ার অধিকার রাখি। কিন্তু এটা পেতে কার কাছে আমি যাইনি। কিন্তু কেউ আজ পর্যন্ত দেননি। প্রাণভিক্ষা চাওয়ার নথি কারা কর্তৃপক্ষের কাছে থাকা প্রসঙ্গে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, যদি তাদের কাছে থাকে তাহলে সেটা দিতে বলেন। সেই নথি তো আমাদেরও দরকার আছে। আমরাও দেখতে পারব সেখানে তিনি কি লিখে গেছেন।

লাশ দাফন করা প্রসঙ্গে হুম্মাম কাদের বলেন, যেখানে উনি দাফন হতে চেয়েছিলেন ওটা উনাদেরকে (জেল কর্তৃপক্ষ) বলেছিলাম। আব্বু রাঙ্গুনিয়াতে দাফন হতে চেয়েছিলেন। আমরাও বের হয়ে প্রিপারেশন নিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদেরকে জেল অথরিটি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর আদেশে তাকে রাউজানে দাফন করা হবে, রাঙ্গুনিয়ায় নয়।

জন্ম ও পারিবারিক পরিচিতি : সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ১৯৪৯ সালের ১৩ মার্চ গহিরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাউজান উপজেলার একটি রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য ছিলেন। তার পিতা, ফজলুল কাদের চৌধুরী, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে সময়ে সময়ে পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রগতি ছিলেন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তিনি পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুরের বোর্ডি স্কুল, সাদিক পাবলিক স্কুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন।

রাজনৈতিক পরিচিতি : সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বাংলাদেশের সাত মেয়াদে সংসদের সদস্য ছিলেন এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময় রাউজান রাঙ্গুনিয়া অথবা ফটিকছড়ির প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রাম-৭ নির্বাচনী এলাকা দিয়ে সংসদীয় জীবন শুরু হয়। তিনি ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম-৬ আসন থেকে নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯৬ সালে আবার চট্টগ্রাম-৭-এর জন্য নির্বাচিত হন, ২০০১ সালে আবার নির্বাচিত হন । তার চূড়ান্ত মেয়াদ, যেটিতে তিনি ২০০৮ সালে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তা ছিল চট্টগ্রাম-২ এর জন্য।

যুদ্ধাপরাধের বিচার : সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ২০১১ সালে ধানমন্ডিতে তার ‘সেফ হাউজ’ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এরপর তাকে পুলিশের বিশেষ শাখায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যেখানে তাকে নির্যাতন করা হয়। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ গণহত্যায় তার জড়িত থাকার জন্য ২০১১ সালের আগস্টে বিচার শুরু হওয়ার কথা ছিল।

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিচার চলাকালীন প্রসিকিউশন ৪১ জন সাক্ষীকে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য তলব করেছিলেন এবং তার আত্মপক্ষ সমর্থনে চারজনকে ডাকা হয়েছিল। বিচারের বিষয়ে মন্তব্য করে যুদ্ধাপরাধবিষয়ক সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত-অ্যাট-লার্জ, স্টিফেন র‌্যাপ বলেছিলেন, যে এটা ‘বিরক্তকর’ যে প্রতিরক্ষা সাক্ষ্যের উপর সীমাবদ্ধতা রাখা হয়েছিল। হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাকিস্তানে ছিলেন এবং অপরাধের সময় পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পেশায় অধ্যয়নরত ছিলেন। পাকিস্তানের একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং একজন প্রাক্তন আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে প্রতিরক্ষামূলক সাক্ষ্য আদালত কর্তৃক অনুমোদিত হয়নি। ১ অক্টোবর ২০১৩ তারিখ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে তার বিরুদ্ধে আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে ৯টির জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়। তার দল বিএনপি যুক্তি দিয়েছিল, এই বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ১৮ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোট মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আপিল খারিজ করে দেন।

হুম্মাম কাদের চৌধুরী গ্রেফতারের পর নিখোঁজ : ২০১৬ সালের আগস্টে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অভিযোগ করে যে হুম্মামকে ৪ আগস্ট ২০১৬-এ গ্রেফতার এবং নিখোঁজ করা হয়েছিল। অ্যামনেস্টি বলেছিল তাকে ১২ আগস্ট ঢাকার র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন সদর দফতরে রাখা হয়েছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাকে হেফাজতে রাখার কথা অস্বীকার করেছে। হুম্মাম ২০১৭ সালের মার্চ মাসে দেশে ফিরে আসেন। হুম্মাম শিল্পপতি এ কে খানের নাতনীকে বিয়ে করেন।

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাই, গিয়াস কাদের চৌধুরী , বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সংসদ সদস্য ছিলেন অন্য দুই ভাই সাইফুদ্দিন ও জামালউদ্দিন ব্যবসায়ী। শিল্পপতি সালমান এফ রহমান এবং সোহেল রহমান ছিলেন খালাতো ভাই।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।