Home জাতীয় টাকা ছাপতে হবে অর্থনীতির নিয়ম মেনে

টাকা ছাপতে হবে অর্থনীতির নিয়ম মেনে

||সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা||

আমরা যখন কলেজে পড়ি, তখন প্রায়ই একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতাম, তা হচ্ছে বাংলাদেশের এক ও দুই টাকার নোট ছাড়া সব মূল্যমানের নোটে ‘চাহিবা মাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে’ কথাগুলো লেখা থাকে কেন? বিষয়টি জানার জন্য অর্থনীতির অধ্যাপকের দ্বারস্থ হলে তিনি জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলেই ইচ্ছামতো টাকা ছাপাতে পারে না। টাকা ছাপাতে হলে এর বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা বা বৈদেশিক মুদ্রা জমা রাখতে হয়। আর এর সমপরিমাণ মূল্য ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি হিসেবে কথাগুলো লেখা থাকে। আরেক অধ্যাপক বলেছিলেন, টাকা হচ্ছে আইনগত লেনদেনের ভিত্তি, যাকে অর্থনীতির পরিভাষায় লিগ্যাল টেন্ডার বলা হয়।

এ কারণে টাকার সমপরিমাণ মূল্য ফেরত দেওয়ার আইনগত বাধ্যবাধকতা থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার ওপর এমন প্রতিশ্রুতির কথা লিখে রাখে। আরেকজন অধ্যাপক বলেছিলেন, জনগণ যেহেতু সব টাকার মালিক, তাই জনগণকে টাকার সমপরিমাণ মূল্য ফেরতদানের অঙ্গীকার হিসেবে কথাগুলো লেখা থাকে। এর কোন কথাটি যে সঠিক বা বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার ওপর এমন বক্তব্য লেখার আসল কারণ কী, তা আজও নিশ্চিতভাবে জানার সুযোগ হয়নি। তবে এতটুকু নিশ্চিত হয়েছি যে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকই আইনত দেশের অর্থনীতির প্রয়োজনে টাকা ছাপানোর একমাত্র কর্তৃত্বের অধিকারী।

বাংলাদেশ ব্যাংক যেখানে দেশের প্রয়োজনে টাকা ছাপানোর জন্য একমাত্র প্রতিষ্ঠান, তাই বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপাবে, টাকা ছাপতে হবে অর্থনীতির নিয়ম মেনেতাতে কোনো পক্ষ থেকে কোনো রকম প্রশ্ন তোলার কথা নয় এবং প্রশ্ন ওঠেও না। কিন্তু কিছুদিন ধরেই এই টাকা ছাপানোর বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। কিছুদিন আগে স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ মাসের শাসনামলে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ছাপিয়েছে। এই টাকা ছাপানোর বিষয়টি যে অন্তর্বর্তী সরকার শুরু করেছে তেমন নয়।

গত সরকারও এভাবে টাকা ছাপিয়েছে মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। পার্থক্য হচ্ছে এখন যাঁরা ক্ষমতায়, বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বে থেকে যাঁরা টাকা ছাপানোর কাজটি করছেন, তাঁরাই সে সময় এই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছেন। দেশের একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এখন একটি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বে আছেন, তিনি সে সময় তৎকালীন গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে এভাবে টাকা ছাপানোর পদক্ষেপ বন্ধ করতে বলেছিলেন।
আমরা অনেকেই ক্ষমতার বাইরে থাকতে অনেক কথাই বলি, কিন্তু ক্ষমতায় গেলে সেই কথাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই মেনে চলা সম্ভব হয় না। রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে এ রকম কথা একেবারেই নতুন কিছু নয় এবং আমরা সেগুলোতে অভ্যস্ত।

কিন্তু যখন প্রথিতযশা পেশাজীবীরা এ রকম বক্তব্য দেন, তখন খুবই হতাশ হতে হয়। বর্তমানে দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা ছাপানোর বিষয়টি নিয়ে সে রকম একটি হতাশাব্যঞ্জক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে অনেকের মাঝে। অনেকেই পদক্ষেপটির বিরোধিতা করছেন। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, এই ব্যবস্থা দেশের অর্থনীতির জন্য দীর্ঘ মেয়াদে মোটেই ভালো হবে না। এমনকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) এই ব্যবস্থাকে ভালোভাবে দেখছে না। বিগত সরকারও টাকা ছাপিয়েছে এবং একইভাবে অন্তর্বর্তী সরকারও টাকা ছাপাচ্ছে। এ থেকে একটি বিষয় অন্তত পরিষ্কার যে দেশের অর্থনীতিতে টাকা ছাপানোর প্রয়োজনীয়তা আছে। যেভাবেই সমালোচনা হোক না কেন, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় এভাবে টাকা ছাপানোর ঘটনা এটিই প্রমাণ করে যে অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতায় এই পদক্ষেপ অপরিহার্য এবং আপাতত এর কোনো বিকল্প নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক এভাবে টাকা ছাপাতে পারে কি না এবং পারলে তা অর্থনীতির নিয়মবহির্ভূত ব্যবস্থা হবে কি না। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে কয়েকটি বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পেতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতির কোন থিওরি ব্যবহার করে টাকা ছাপায়, তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশে টাকা ছাপানোর একক মালিক হলেও তারা ইচ্ছামাফিক যত খুশি তত টাকা ছাপাতে পারে না। মুদ্রানীতির নির্দিষ্ট একটি থিওরি অনুসরণ করে এই টাকা ছাপানোর কাজটি করতে হয়। টাকা ছাপানোর জন্য একসময় স্বর্ণমান মেনে চলা হতো, যা পরে বন্ধ হয়ে বৈদেশিক মুদ্রামান ব্যবস্থার প্রচলন হয়। স্বর্ণমান অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ মজুদ রাখার বিপরীতে টাকা ছাপানো বা টাকা সার্কুলেশন করার বিধান ছিল। একইভাবে বৈদেশিক মুদ্রামান অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেখে টাকা ছাপানো বা সার্কুলেশন করা হতো। উল্লেখ্য, টাকা ছাপানো এবং সার্কুলেশনের মধ্যে পার্থক্য আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন টাকশাল থেকে টাকা প্রিন্ট করে আনে, তখন তাকে টাকা ছাপানো বলা হয়। পক্ষান্তরে প্রিন্ট করা টাকার যে অংশটুকু লেনদেন সম্পাদনের জন্য অর্থনীতিতে সরবরাহ করা হয়, তখনই সেই টাকা সার্কুলেশনের অন্তর্ভুক্ত হয়। টাকা ছাপানো নয়, মূলত সার্কুলেশনই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা অর্থনীতি ও মুদ্রানীতির জন্য।

আমরা যতটুকু জানি, টাকা ছাপানোর ক্ষেত্রে স্বর্ণমান ও বৈদেশিক মুদ্রামান, উভয় পদ্ধতির অনুসরণ অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে মুদ্রানীতির কোন সূত্র প্রয়োগ করে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা সার্কুলেশনের কাজটি সম্পন্ন করছে, তা আমাদের মোটেও জানা নেই। বিষয়টি অবশ্য বেশ স্পর্শকাতর এবং অতি গোপনীয়। তাই সাধারণ মানুষের জানার কোনো সুযোগ নেই এবং জানা উচিতও নয়। তবে এই গোপনীয় বিষয়টি না জানলেও একটি বিষয় অন্তত নিশ্চিত যে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দিষ্ট একটি থিওরি অনুসরণ করে টাকা সার্কুলেশনের কাজটি করে থাকে। সেই সূত্র প্রয়োগের মাধ্যমে মুদ্রানীতির প্রয়োজন অনুযায়ী এবং অর্থনীতির সব উপাদান; যেমন—অর্থনীতির আকার, প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, অর্থ জমা বা রিজার্ভের পরিমাণ, লেনদেনের পরিমাণ, অর্থের হাতবদল বা ভেলোসিটি অব মানি প্রভৃতি বিবেচনায় নিয়ে দেশের জন্য সর্বোচ্চ পরিমাণ মুদ্রার সংখ্যা নিরূপণ করে থাকে।

আরও পড়তে পারেন-

সর্বোচ্চ সীমার মধ্যে থেকে টাকা ছাপানো বা সার্কুলেশন করা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত এবং প্রথাসিদ্ধ কাজ। এই পদ্ধতিতে টাকা ছাপানো হলে কোনো রকম বিরূপ সমালোচনা হওয়ার কথা নয়। বিপত্তি ঘটে তখনই, যখন অনুসৃত সূত্র বা থিওরির তোয়াক্কা না করে দেশের তারল্য সংকট দেখা দেওয়া মাত্র বা সরকারের অর্থের প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছামাফিক টাকা ছাপিয়ে ফেলে। এই পদ্ধতি অর্থনীতির জন্য মোটেই ভালো নয়। কেননা এভাবে টাকা ছাপানো অর্থনীতির নিয়মে পড়ে না এবং এই পদক্ষেপ দীর্ঘ মেয়াদে দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো ফল বয়ে আনে না।

সরকারের প্রয়োজনে এভাবে টাকা ছাপানোর ধারণা আলোচনায় আসে মাত্র কয়েক বছর আগে, যখন মডার্ন মনিটারি থিওরির (এমএমটি) প্রবক্তারা বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদসহ যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এই এমএমটি উপস্থাপন করেন। মডার্ন মনিটরি থিওরির প্রবক্তাদের মধ্যে নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ এবং এমআইটির (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) অধ্যাপক ড. অভিজিৎ ব্যানার্জিও আছেন। এই এমএমটির প্রবক্তারাই বলার চেষ্টা করেছেন যে সরকার ঋণ না নিয়ে শুধু টাকা ছাপিয়েই তাদের অর্থের চাহিদা মেটাতে পারে। এমএমটির প্রবক্তারা কোনো একটি নির্দিষ্ট সূত্র বা তত্ত্ব ব্যবহার করে এভাবে অর্থ ছাপানোর সুপারিশ করেছেন, নাকি যখন প্রয়োজন তখনই টাকা ছাপানোর কথা বলেছেন, তা এখনো সেভাবে বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়নি। বিশ্বের কোনো দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এই এমএমটি প্রয়োগ করে ডলার ছাপানো শুরু করেছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। অবশ্য করোনা মহামারির সময় কিছু দেশ, এমনকি দু-একটি উন্নত দেশও এই এমএমটি প্রয়োগ করে অর্থ ছাপিয়েছে মর্মে আলোচনা ছিল, যদিও তার সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তা ছাড়া এই এমএমটি নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে প্রচণ্ড বিরোধিতা এবং সমালোচনা আছে। এ কারণেই সরকারের অর্থের প্রয়োজন হলেই যে এমএমটির নাম ব্যবহার করে ইচ্ছামতো টাকা ছাপাতে পারবে, সেই বাস্তবতা এখনো তৈরি হয়নি।

দেশের অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ বা মানি সাপ্লাই ঠিক রাখার স্বার্থে সময় সময় টাকা ছাপতে হবে। এই টাকা ছাপার কাজটি যে এককভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে টাকা ছাপার কাজটি করতে হবে একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বা অর্থনীতির সূত্র প্রয়োগ করে। সেটি বহুল প্রচলিত ‘কোয়ানটিটি থিওরি অব মানি’ হতে পারে বা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব সূত্রও হতে পারে। এভাবে অর্থনীতির নিয়ম মেনে টাকা ছাপলে, তা একদিকে যেমন দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো, তেমনি এ নিয়ে কারো কোনো বক্তব্যও থাকবে না। এমনকি আইএমএফও বিষয়টি নিয়ে কিছু বলার সুযোগ পাবে না। এর বিপরীতে কোনো রকম নিয়ম বা সূত্রের তোয়াক্কা না করে সরকারের অর্থের প্রয়োজন মেটাতে ইচ্ছামাফিক টাকা ছাপলে, সেটি দেশের অর্থনীতির জন্য যেমন ভালো হবে না, তেমনি এর বিরুদ্ধে আলোচনা-সমালোচনা থাকবে। বিষয়টি আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যেহেতু জানে, তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের আরো ভালোভাবে জানার কথা। মূলকথা হচ্ছে, দেশে টাকা ছাপাতে হবে অর্থনীতির নিয়ম মেনে এবং এর কোনো বিকল্প নেই।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।