Home সম্পাদকীয় গুম-খুনের বিচার দ্রুত করতে হবে

গুম-খুনের বিচার দ্রুত করতে হবে

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে প্রিয় স্বজনদের গুম-খুনের বিচারের দাবিতে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে‘মায়ের ডাক’। এটা রাজনৈতিক বিতর্কের অনেক ঊর্ধ্বে মনুষ্যত্বের মর্যাদা, মানবিক মূল্যবোধ ও মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন। এখনো হাজার হাজার মা সন্তানদের অপেক্ষায় অধীর অপেক্ষায় চোখের পানিতে দিন গুনছেন, অনেক সন্তান তার পিতার জন্য, ভাই-বোন তার ভাইয়ের হদিস হণ্যে হয়ে খুঁজছে। স্বৈরাচারি শেখ হাসিনার তার দু:শাসনের সময় প্রতিবাদি মুখগুলো স্তব্ধ করে কত সংখ্যক মানুষকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ফোর্স ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সের শিকার হতে হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কারো কাছেই নেই। রাষ্ট্রীয় ও ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে অধিকাংশ গুম-খুন ও অপরাধমুলক কর্মকান্ড সংঘটিত হয়েছে।

এ সপ্তাহে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের শেষ ৫ বছরে দেশে ১৬ হাজারের অধিক মানুষ খুনের শিকার হয়েছে। তবে সরাসরি ‘উপরের নির্দেশে’ গুম-খুনের হিসাব আলাদা। হাসিনার শাসনামলে এ ধরণের গুম-খুনের ঘটনা ৫ হাজারের বেশি বলে জানা যায়। অপরাধ ও হত্যাকান্ডের ঘটনা কমবেশি সব দেশে সব সমাজেই আছে। কিন্তু অবৈধ-অনৈতিকভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে বিরোধী মত দমন ও জনমনে ভয় ধরিয়ে দিতে এমন গুম-খুনের নজির সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিরল। বিরোধী মত দমনের নামে, বিচারের নামে, নিজেদের সৃষ্ট ন্যারেটিভে রাষ্ট্রদ্রোহীতার নামে এবং লুটপাটতন্ত্র কায়েম করার জন্য শেখ হাসিনার লাগামহীন গুম-খুনের নেপথ্যে প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততার ঘটনা অনেকটাই স্পষ্ট। পিলখানা হত্যার পূর্নাঙ্গ তদন্ত ও নেপথ্যের হোঁতাদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার উদ্যোগ অর্ন্তবর্তী সরকারকে অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। ঢাকা থেকে, বিশেষভাবে সংরক্ষিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের প্রাঙ্গণ থেকে অপহৃত হওয়ার পর ভারতের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজনের হদিস পাওয়া গেছে। অনেকের হদিস এখনো পাওয়া যায়নি। ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালিয়ে আত্মগোপনে থাকা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

সে সব নিরুদ্দেশ এবং আয়নাঘরে গুম-খুন-নির্যাতনের শিকার হওয়া মানুষগুলোর পরিবারের সদস্যরাই গত এক দশক ধরে ‘মায়ের ডাক’ এর ব্যানারে প্রিয়জনকে ফিরিয়ে দেয়ার আকুতি জানিয়ে এসেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে ওরা বার বার প্রিয় স্বজনের প্রত্যাবর্তন ও অপরাধিদের বিচারের দাবিতে জোরালো দাবি জানিয়েছে। অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৪দিনের মাথায় ১৩ আগস্ট মায়ের ডাকের প্রধান সমন্বয়ক সানজিদা ইসলামের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করে নিজেদের ৩ দফা দাবি তুলে ধরার পর প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস দ্রুততম সময়ে এসব দাবি পুরণের আশ্বাস দিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে আয়নাঘরে আটকদের নির্যাতনের অনেক ঘটনাই ফাঁস হয়েছে। অনেকে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে আটক হওয়া ও নির্যাতনের যে সব বর্ণনা দিয়েছেন তা রোমহর্ষক, অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। কারা , কিভাবে, কেন ও কার নির্দেশে এসব গুম-খুনের ঘটনা ঘটিয়েছিল তা এখন দিবালোকের মত পরিষ্কার।

আরও পড়তে পারেন-

উচ্চ আদালতের গুরুত্বপূর্ণ রায় থেকে শুরু করে প্রতিটি গুম-খুনের পেছনে শেখ হাসিনার নির্দেশনা ও সম্পৃক্ততার অনেক তথ্য জানা গেছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগেই গুম-খুনের অন্যতম কুশীলব বেনজির আহমেদ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। আয়নাঘরের কুশীলব জিয়াউল আহসান আটক হলেও তারেক সিদ্দিকীর মত ঠান্ডা মাথার খুনিকে এখনো আটক করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা যায়নি। সব গুম-খুন, গণহত্যা ও রাষ্ট্র ধ্বংসের মূল হোঁতা শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গিয়ে এখন দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। তিনি এখনো মোবাইল ফোনকল বার্তায় শত শত মানুষকে হত্যার হুমকি ও নির্দেশনা দিচ্ছেন। তাঁকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার নিশ্চিত না করা পর্যন্ত দেশে ন্যায়বিচারের দাবি পুরণ কিংবা স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।

মায়ের ডাকের সদস্যদের মত দেশের সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যরাও বিগত স্বৈরাচারের হাতে অস্বাভাবিক নিগ্রহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দেশের বিরোধীদলগুলোর নেতাকর্মীদের উপর হাজার হাজার মিথ্যা মামলার হয়রানি, ক্রমবর্ধমান গুম-খুন ছাড়াও বেশ কয়েকটি পরিকল্পিত গণহত্যার ঘটনায় শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। সাবেক সেনা কর্মকর্তারা নিঁেখাজ ও নির্যাতনের শিকার হওয়া সহকর্মীদের বিচারের দাবিতে ‘জাস্টিস ফর কমরেডস’ নামের সংগঠনের ব্যানারে আয়নাঘরের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের দ্রুততম সময়ে বিচার সম্পন্ন করা, পিলখানায় সেনা অফিসার হত্যাসহ সব অন্যায়-অবিচারের বিচার নিশ্চিত করার দাবি তুলেছেন।

সরকারের অন্যায় নির্দেশনার সাথে দ্বিমত ও বিরোধিতার কারণে যে সব সেনা কর্মকর্তারা চাকুরিচ্যুত হয়েছেন, চাকরির বয়েস থাকলে তাদেরকে বাহিনীতে পুর্নবহালের দাবিও জানিয়েছেন তারা। ‘মায়ের ডাক’ এবং ‘জাস্টিস ফর কমরেডস’ এর প্রতিটি দাবিই যৌক্তিক ও সঠিক। এসব দাবি দেশে ন্যায়বিচার, স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের মূল শর্ত। শেখ হাসিনাসহ তার মাফিয়া দোসররা এখন পালিয়ে থেকে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। অন্যদিকে তাদের ১৬ বছরের পৃষ্ঠপোষক ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে ছাত্র-জনতার পরিবর্তনের দাবিকে বানচাল করে পুরনো বন্দোবস্ত পুনর্বহাল করে দেশের ওপর আধিপত্য অক্ষুণœ রাখার অপচেষ্টা ও অপতৎপরতা, হুমকি-ধামকি অব্যাহত রেখেছে।

হাজার হাজার ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আধিপত্য ও ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে সাম্য, সম্প্রীতি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রথমেই ১৬ বছরে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত গুম-খুন ও প্রাতিষ্ঠানিক অন্যায়ের বিচার দ্রুততার সাথে নিশ্চিত করতে হবে। পিলখানায় গণহত্যা, শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম কর্মীদের গণহত্যা, বিএনপির সমাবেশে ক্র্যাক-ডাউনসহ প্রতিটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের সাথে যারাই জড়িত থাকুক, তাদেরকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিচারের আওতায় আনতে হবে। গুমের শিকার হওয়া যে সব ব্যক্তির হদিস এখনো পাওয়া যায়নি, তাদের খুঁজে বের করে স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।