।। রিন্টু আনোয়ার ।।
প্রতিবেশীদের ত্যক্ত-বিরক্ত করতে করতে বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত এখন নিজেই কোণঠাসা। পরাশক্তি হওয়ার খায়েশে দেশটি দক্ষিণ এশিয়ার সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে দূরত্ব বাড়িয়ে চলেছে। সব দেশে ভারতের মর্জির বিপরীত সরকার। পাকিস্তান, চীন এবং শেষতক বাংলাদেশও ছেড়ে কথা বলছে না। বিশেষ করে ঢাকাকে পিষে মারতে মারতে এখন গোটা বিশ্বময় ভারতের স্বরূপ উন্মোচন হয়েছে।
একসময় বলা হতো বাংলাদেশের দম ফেলার সুযোগ নেই। এ দেশের তিন দিকে ভারত। আর এখন ভারতের চারদিকে তার প্রতিপক্ষ। শেখ হাসিনা ইস্যুতে বাংলাদেশের সাথে একপেশে নীতি ভারতকে আতঙ্কে ফেলেছে। সেই জেরে ভারত কখন কী করছে, কী বলছে- অনেকটা তালহীন অবস্থা।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু নির্যাতনের নাটক ও অভিযোগ সাজাতে গিয়ে ভারতের চরিত্রের কদাকার দিক প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর ভারতের অযাচিত উদ্বেগ প্রকাশ থেমে নেই। ভারতের নিজের মাটিতে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর অসংখ্য নির্মমতার ঘটনা ঘটে চলেছে। অথচ সেটি নিয়ে তাদের সঙ্কোচ বা অনুশোচনা নেই। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে না পেরে ভারত দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য। এরপরও হাল ছাড়েনি। সাম্প্রদায়িকতার অস্ত্র দিয়ে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশকে ঘায়েলের অপচেষ্টা করছে। হাল না ছেড়ে খেলছে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ বা ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস-ইসকন নিয়ে। এটি মূলত গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতবাদের অনুসারী একটি হিন্দুধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। জন্ম ১৯৬৬ সালে আমেরিকায়। অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ প্রতিষ্ঠাতা।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হিন্দু জাতীয়তাবাদের কথা বলে আশপাশের দেশগুলোতে আধিপত্য বিস্তারের সারথি করেছেন সেসব দেশের হিন্দু সংগঠনগুলোকে।
আমরা দেখলাম হিন্দু সনাতনী জাগরণ জোটের সশস্ত্র কর্মীদের হাতে চট্টগ্রামে নির্মমভাবে প্রাণ দিলেন একজন তরুণ আইনজীবী। সেদিন ইসকনের কোনো কর্মী নিহত হলে ভারত একটি মওকা পেয়ে যেত। পেয়ে যেত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইস্যু। আরো নানা উইংয়ে ইস্যু পয়দার চেষ্টায় ব্যস্ত ভারত। হিন্দু সেনাপ্রধান স্থানীয় একটি আদালতে পিটিশন দাখিল করে দাবি করেছে- আজমির শরিফ দরগার নিচে শিব মন্দির আছে।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার নিয়ে সৃষ্ট বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির পেছনে দেশের ভেতর এবং বাইরের থেকে ইন্ধনের কথা লুকাননি অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) জাহাঙ্গীর আলম। এটি একটি সতর্কবার্তা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা বলেছেন, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার ঘিরে সারা দেশে যে তাণ্ডব চালানো হয়েছে, তা কোনোভাবে স্বাভাবিক প্রতিবাদ নয়। তার ওপর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হিন্দুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে বাংলাদেশে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করতে বিশ্বসংস্থার প্রতি আবেদন জানানোর কথা বলেছেন।
দেশের ভেতরে-বাইরের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হলে জাতীয় ঐক্য গড়ার একটি সূত্রপাত এর মধ্যে হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকার মিরপুর সেনানিবাসের ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ কমপ্লেক্সে ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স ও আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্স সমাপনী অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস সার্টিফিকেট প্রদান শেষে বলেছেন, বর্তমানে বাংলাদেশ কঠিন সময় পার করছে, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকা প্রয়োজন। এরপর সংলাপে বসেছেন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে। তার এই জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। আধিপত্যবাদী মোকাবেলায় প্রয়োজন সামরিক এবং বেসামরিক শক্তির দৃঢ় সেতুবন্ধ। এই সেতুবন্ধ তৈরির তাগিদ আসছিল বিভিন্ন মহল থেকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নেতা ও জাতীয় ব্যক্তিত্বের অংশগ্রহণ একটি ভালো লক্ষণ। ভারত প্রশ্নে একটি অবস্থানে পৌঁছেছে বাংলাদেশ।
আরও পড়তে পারেন-
- উলামায়ে কেরামের প্রতি মুফতি শফী (রাহ.)এর দরদমাখা নসিহত
- কম্পিউটার চিপ শিল্প: জলবায়ুর উপর ফেলছে ভয়ঙ্কর প্রভাব
- ইরানি বিজ্ঞানীকে যেভাবে হত্যা করে ইসরায়েল
- ব্যতিক্রমী এক ইসলামী আইন গবেষক
- ইবাদতের গুরুত্ব নিয়ে ঠাট্টা-তাচ্ছিল্য জঘন্য গুনাহ
অবিরাম তিক্ততায় বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক মেরামতের জায়গা নষ্ট করে দিচ্ছে ভারত। দেশের সাথে সম্পর্কের বদলে দিল্লি সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করেছে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার সাথে। যে কারণে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক সামনের দিনগুলোতে আরো তিক্ত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা ভর করেছে। আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলা, লুট-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে বাংলাদেশ ও ভারতের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের বাকযুদ্ধ ক্রমান্বয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে। চিকিৎসাসেবা ও সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ থেকে শুরু করে পতাকা পোড়ানো বা পদদলিত করা, বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি, ভিসা বন্ধ বা সীমিত করার ঘটনাসহ সাম্প্রতিক অস্থিরতা ভালো কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে না। এ অবস্থার উত্তরণ জরুরি হলেও অচিরে সে লক্ষণ নেই। যদিও বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুমুখী, এখানে কথা বলার অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। এ সম্পর্ককে শুধু একটি মাত্র বিষয়ে সীমাবদ্ধ করা যায় না।’ কূটনীতির ভাষা এমনি হয় কিন্তু, বাস্তব এমন নয়। ভার্মার এ বক্তব্যের আগে আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে সোমবার হামলার প্রতিবাদ জানাতে তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। তলবে হাজির শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি জানান, তারা সত্যিকার অর্থে একটি গঠনমূলক ও স্থিতিশীল সম্পর্ক চান।
আসলে তারা কী চান, তা প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে। ক্রিয়া-বিক্রিয়াও পরিষ্কার। আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে উত্তাল বাংলাদেশ। আবার নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে সব ধরনের ভিসা ও কনস্যুলার সেবা বন্ধ ঘোষণা করেছে আগরতলার বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন। এ ঘটনায় সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, চার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়েছে ভারত সরকার। এর আগে আগরতলার ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ উল্লেখ করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, কূটনৈতিক ও কনস্যুলার সম্পত্তি কোনো অবস্থায় লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়।
কূটনৈতিক মারপ্যাঁচে যত কথা বলা হোক না কেন, বাস্তবতা ভিন্ন। গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে ভারতের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত নানা স্বার্থ রক্ষা করেছে শেখ হাসিনা সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার এবং বিএনপিসহ যেসব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের রাজনীতিতে এগিয়ে তারা কেউ ভারতের সাথে রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত নয়। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত-বিরোধিতা আগেও ছিল, এখন আরো বেড়েছে। তার ওপর বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে বড় ভূমিকা রাখছে ভারতের উগ্রবাদী ধর্মভিত্তিক দলগুলো। গত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় এবং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো তুলনামূলক ভালো করেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়ন করা হচ্ছে, এমন প্রচার চালিয়ে ভারতের জনগণকে আরো বেশি মুসলিমবিদ্বেষী করার অ্যাজেন্ডায় নরেন্দ্র মোদির বিজেপি। দেশটির আগামী নির্বাচন পর্যন্ত ইস্যুটি জিইয়ে রাখতে চায়। একইভাবে ভারতীয় কিছু গণমাধ্যমে বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়ন সম্পর্কে ভুয়া ও অতিরঞ্জিত খবর প্রকাশ করছে। যা বাংলাদেশে ভারত-বিরোধিতা আরো বাড়াচ্ছে।
ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যের নিরাপত্তা ও কৌশলগত কারণে বাংলাদেশে ভারতের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যশীল নয় এমন ক্ষমতাকে দিল্লি দেখতে চায় না। এ সমীকরণে ভারতের খাস পছন্দ আওয়ামী লীগ। দলটির সভানেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে বলেছেন, ভারতকে তিনি যা দিয়েছেন, তারা তা আজীবন মনে রাখবে। এর মধ্য দিয়ে বিষয়টি আরো আগেই পরিষ্কার হয়েছে। সেখানে গণ-আন্দোলনে শেখ হাসিনাকে পালাতে হয়েছে। ভারত ছাড়া দুনিয়ার আর কোনো দেশ আশ্রয় দেয়নি তাকে। শেখ হাসিনাকে শুধু সুরক্ষা নয়, আবার ক্ষমতাসীন করার চেষ্টা করবে ভারত- এটিই স্বাভাবিক।
নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে, হাসিনা ভারতে বসে ক্ষমতায় ফিরে আসার ষড়যন্ত্র করছেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা ভারতের বিরুদ্ধে এ অভিযোগও তুলেছেন, সুবিধা আদায়ে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর আক্রমণকে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরছে ভারত। ইউনূস সরকারের কর্মকর্তারা সব বাংলাদেশীর জন্য সমান সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তারা বলেছেন, ‘নয়াদিল্লির পছন্দের শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়েছে যে আন্দোলন, তাকে খাটো করে দেখাতে ভারত বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের দুর্দশাকে একটি আবেগপূর্ণ হাতিয়ারে পরিণত করেছে। বিএনপি-জামায়াতসহ ডান-বামের রাজনৈতিক দলগুলোরও একই মত।
এ অবস্থায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কোন পথে এগোচ্ছে তা বুঝতে খুব বড় কূটনীতিক বা বিশেষজ্ঞ না হলেও চলে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস গত সপ্তাহে তা আরো পরিষ্কার করে দিয়েছেন দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে। সেখানে তিনি ভারতের সাথে সম্পর্কের টানাপড়েন স্বীকার করে বলেছেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতির কারণ শেখ হাসিনাকে ভারতের সুরক্ষা দেয়া এবং ভারতের অপপ্রচার।
ভারত বিপজ্জনক পথ বেছে নিয়ে বাংলাদেশের বিষয়টি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানোর চেষ্টা করছে। বাস্তবে এটি পুরোপুরি রাজনৈতিক। যদি ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠে, তাহলে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ নেপালে ভারত-বিরোধিতা কেন বাড়ছে?
ভারতের ভেতরে সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রতি নির্যাতনের বিষয়ে তারা কখনো নজর দেয় না। অথচ বাংলাদেশের মতো একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে ভারতের এমন অভিযোগ তির্যকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এটি এক ধরনের কৌশল, যার মাধ্যমে অপরাজনীতিকে ধর্মের মোড়কে আড়ালের চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা। শুধু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে নয়; এটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চেতনা এবং স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ইচ্ছার প্রতিফলন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নিজস্ব রাজনীতি এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোই এখন ভারতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইমেইল- rintu108@gmail.com
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ