Home মহিলাঙ্গন ওএমএস লাইনে যে কারণে নারীদের সারি দীর্ঘ হয়

ওএমএস লাইনে যে কারণে নারীদের সারি দীর্ঘ হয়

ওএমএসে নারীদের সারি দীর্ঘ হয়, কারণ সংসারের প্রতি তাদের টান বেশি। মিরপুরের ন্যাশনাল বাংলা স্কুলের পাশে। ছবি- সালেহ শফিক।

।। সালেহ শফিক ।।

কী করবেন বুঝতে পারছেন না হোসনে আরা (৬২)। অবস্থান করছেন মিরপুর–৬ নম্বর বাজারের কাছে। কারণ ওএমএস (ওপন মার্কেট সেল) ট্রাক আসবে।

রূপনগর থেকে সকাল ৭টায় এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়, শেষে দেখা যায় চাউল পাচ্ছেন না। শুধু আটা কিনে বাড়ি গেলে ছেলেপুলের বকা শুনতে হয়।  ভারী শরীর বলে বেশি হাঁটতে পারেন না। রিকশা ভাড়া গুনেছেন ২০ টাকা। কপালের ভাঁজ বাড়ছে, কারণ এতো দেরি তো হয় না। দশটা থেকে সোয়া দশটার মধ্যেই ট্রাক চলে আসে। এখন ১১টা বাজতে চললো ট্রাকের দেখা নেই।

এই জায়গায় সপ্তাহের মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার ওএমএস ট্রাক আসে। চাল পাওয়া যায় ৩০ টাকা ও আটা ২৪ টাকা কেজি দরে; নেওয়া যায় সর্বোচ্চ ৫ কেজি করে। ব্যাগসহ পুরো প্যাকেজের দাম ২৮০ টাকা। বাজার মূল্যের অর্ধেকেরও কম দামে চাল-আটা পাওয়া যায়। তেল, চিনি, লবণসহ আরেকটি প্যাকেজ আছে, যার জন্য সাড়ে পাঁচশর বেশি টাকা লাগে। 

লাইনেও সিন্ডিকেট!

এই অস্থির, লাগামছাড়া বাজারদরের দিনে গরীব মানুষের সহায় হয়ে দেখা দিয়েছে ওএমএস বা টিসিবি ট্রাক। কিন্তু এখানেও ঝামেলা কম নয়। প্রথমত, লাইন ধরতে হয় ফজর নামাজের পর। দ্বিতীয়ত, লাইনে খুব ধাক্কাধাক্কি হয়; দুর্বল শরীরের মানুষেরা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না। তৃতীয়ত, ১০-১২ জনের সিন্ডিকেট থাকে—যারা ট্রাক থেকে জিনিসপত্র কিনে বাজারে বিক্রি করে দেন; এদের প্রতিরোধ করার কেউ নেই। চতুর্থত, ডিলার বা তার প্রতিনিধি স্বজনপ্রীতি করে লাইনছাড়া লোকদের আগে পণ্য পাইয়ে দেন। 

হোসনে আরা জানেন না আটা কেন অবশিষ্ট থাকে আর চাল কেন আগেই ফুরোয়। কারণ হলো, ট্রাকে আটা আনা হয় সাড়ে তিন হাজার কেজি এবং চাল দুই  হাজার কেজি। 

ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য হলেও আটার সরবরাহ কেন বেশি? মিরপুরের ন্যাশনাল বাংলা স্কুলের দেওয়াল–ঘেঁষে একটি ওএমএস ট্রাকের ডিলারের প্রতিনিধি ফিরোজ আলম বললেন,  “এর জন্য কিন্তু সরকার দায়ী নয়। যারা গ্রাহক তাদের কারণেই সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা প্রায়ই বলাবলি করত, আমাদের ডায়াবেটিস, আটা হলেই ভালো হয়। সরকার জানতে পেরে বলেছে, যেমন আপনাদের মর্জি।” 

“অথচ ঘরে তো কেবল ডায়বেটিক রোগী থাকেন না, পরিবারে তরুণ-তরুণী অনেক সদস্যই থাকেন। ভাত সবাই পছন্দ করেন, রুটি খান বেশি হলে এক বেলা,” যোগ করেন তিনি।

হোসনে আরা দিশেহারা

ফিরোজ আলমের কাছে জানতে চাইলাম, একাজে আপনাদের (ডিলারের) প্রফিট (লাভ) থাকে কেমন? 

তিনি বললেন, “ট্রাকে প্রতিদিনে আমাদের দুই-আড়াই হাজার টাকা থাকে। আমরা নামী প্রতিষ্ঠান বলে মোহাম্মদপুরেরও দু-এক জায়গায় আমাদের ট্রাক আছে। ট্রাক প্রতি আমাদের কমপক্ষে চারজন কর্মী কাজ করেন। সে হিসাবে দুই হাজার টাকা বেশি টাকা নয়। বলতে পারেন আমাদের দিক থেকে এটা একটা মানবিক উদ্যোগ।”

হোসনে আরা জেনেছেন, ন্যাশনাল স্কুলের সামনে ট্রাক আছে, কিন্তু তার কাছে রিকশা ভাড়া ৪০ টাকা বাড়তি নেই। ১০০ টাকা ছিল, আর ধার করেছেন ১৭০ টাকা।  তার ওপর স্কুলে গিয়েও যে লাইনে সুবিধা করতে পারবেন, তা মনে হচ্ছে না। 

হোসনে আরার পরিবার বড়, কিন্তু রোজগেরে কম। স্বামী গত ৪দিন হলো পা ভেঙে ঘরে বসা। বড় ছেলে অটোরিকশা চালায়, কিন্তু গাঁজা খাওয়ার সুযোগ পেলে আর কোনো দিকে তার মন থাকে না। একটা মেয়ে মাদ্রাসায় পড়ে। ছোট ছেলেটি একটি মুদি দোকানে শিক্ষানবীশ। 

আজ হোসনে আরার ঘরে চাল-আটা কিছুই নেই। কী করবেন বুঝতে পারছেন না।

নাম তার সুখী বেগম 

হোসনে আরার পাশে সমান হতাশা নিয়ে বসেছিলেন সুখী বেগম। নাম তার সুখী হলেও জীবনে সুখ পেয়েছেন কমই। চরফ্যাশনে বাড়ি, ছোটবেলায় বাবা মারা গেছেন, অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে, অল্প সময়ের ব্যবধানে দুই কন্যা সন্তানের জন্ম, তারপর স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে ছোট দুই বাচ্চা নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। 

বাসা-বাড়ির কাজকর্ম করে পেট চালিয়েছেন। মেয়েদেরও বিয়ে দিয়েছিলেন তাড়াতাড়ি, এখন তারাও স্বামী পরিত্যক্তা। বাসা-বাড়িতে কাজ করেন। জীবনের এক অদ্ভুত চক্রে বন্দি আছেন, এর মুক্তি আছে কি-না জানা নেই। 

সিরিয়াল দেওয়াই আছে, তাই মানসুরা রীনা (৭০) একটু নিশ্চিন্ত। স্কুলের দেওয়াল–ঘেঁষা ফুটপাথে আধাঘণ্টা জিরিয়ে নিয়ে শোয়া থেকে উঠলেন। বাড়ি তার বরগুনা। সেখানে স্বামী ও ছেলেরা থাকেন। তিনি একাই এখন থাকেন ঢাকায়।

এরশাদের আমলে স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন। একটু সৌখিন মানুষ ছিলেন; স্নো, পাউডার ব্যবহার করতেন নিয়মিত। স্বামীর সঙ্গে সনি হলে গিয়ে ছবিও দেখতেন মাসে দু-তিনবার। নিজে বড়লোকের বাসা-বাড়িতে কাজ করতেন, স্বামী সড়কে ইট বিছানোর কাজ করেছেন। তার স্বামী ও সন্তানেরা সবাই এখন বরগুনা থাকেন। স্বামীর কিডনি দুটিতেই সমস্যা। নিজে হাপানির রোগী, ডান চোখে ছানি পড়েছে। রীনাও ঢাকায় বেশিদিন থাকবেন না, কারণ তার কোনো কাজ করার সামর্থ্য নেই। 

একজন ধনী ব্যক্তি তার চিকিৎসা খরচ যোগাবেন বলে আশ্বাস্ত করায় তিনি ঢাকায় থাকছেন আর ওএমএসের চাল-আটায় দিন পার করছেন। 

ভালোবাসার বিয়ে তার

এবার রৌশন আরার গল্প কিছু বলা যাক। তার বয়স ৩৫ অথবা ৩৬ হবে। বিয়ে হয়েছে ১৮-১৯ বছর আগে। ঢাকায় এসে মিরপুর–৭ নম্বরে উঠেছিলেন। চাকরি নিয়েছিলেন গার্মেন্টে। ভাব-ভালোবাসার বিয়ে তার। স্বামীও একই গার্মেন্টে কাজ করতেন। তাই দেখা হতো প্রতিদিন। মন দেওয়া–নেওয়া হয়ে গিয়েছিল অল্প দিনেই। তারপর বিয়ে হলো। 

শশুরবাড়ি মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানায়। তার নিজের বাড়ি পিরোজপুর। তাদের দুই সন্তান, দুজনেই বাংলা স্কুলে পড়ে। স্বামী এখন একটি গার্মেন্টের কাটিং মাস্টার তবে বেতন কম, ওভারটাইম নেই। কোনো কোনো দিন রাত ১০টা পর্যন্তও কাজ করেন, কাজ শুরু হয় কিন্তু ওই সকাল আটটাতেই। সঙ্গে থাকেন শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ ও এক দেবর। 

রৌশন আরা তাই বলছিলেন, “আট জনের সংসার আমার। সবাইকে নিয়ে গুছিয়ে থাকতে ভালোই লাগে। টুকটাক ঝগড়াঝাটি হয়, তবে তা বেশিক্ষণ কেউ মনে রাখেন না।” 

রৌশন আরা গর্বের সঙ্গে বললেন, “আমার শাশুড়ির রান্নার হাত ভালো। যে একবার খায়, সে ভোলে না। ননদ নিজে আমার বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়ায়। আমি যতটা পারি ঘর সাফ রাখা, হাড়ি পাতিল ধোয়া, রান্না-বান্না ইত্যাদি কাজ করি। আমার শ্বশুর একজন দিনমজুর। দেবর এখনো কোনো কাজে ঢোকেনি।”

আরও পড়তে পারেন-

মনে হলো, রৌশন আরা তার পরিবার নিয়ে ভালোই আছেন, তবে সংসারে অভাব আছে। তাই সময় পেলে ওএমএস লাইনে দাঁড়ান। কম টাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনেন। কিন্তু ওএমএসের চাল কখনো ভালো পড়ে, কখনো খারাপ। অনেক সময় ভাত গলে যায়, চুলায় গ্যাস কম থাকলে ওপরে দেখা যায় সিদ্ধ হয়েছে, কিন্তু ভিতরে শক্ত থাকে। 

মাসে দুইবার তিনি ওএমএসের লাইন এসে দাঁড়ান। সময় লাগে তবে এতদিনে অনেকের সঙ্গে চেনাজানা হয়ে গেছে, তাই গল্প করেও সময় পার হয়। 

মেয়ে ফিরে আসে মায়ের কাছে

অদ্ভুত জীবন সখিনা বেগমের। স্বামী তাকে  ভালোবাসত। স্বচ্ছলতা ছিল না, কিন্তু অশান্তিও ছিল না। তাদের সন্তান হয় অনেক দেরিতে, লোকজন কটু কথা বলত, হাসি-ঠাট্টা করত; তবে স্বামীর দিক থেকে কখনো বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হননি। শেষে অনেক সাধ্যি সাধনা, তাবিজ-কবচ, পড়াপানির পর এক কন্যা সন্তান হলো। সংসারে তখন আরো সুখ, আরো শান্তি। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন।  

সখিনা বেগম বোবা হয়ে ছিলেন কয়েকদিন, কিন্তু সন্তান ছোট, পেট তো চালাতে হবে। একটি চায়ের দোকান চালিয়েছেন বেশ কয়েক বছর। এরইমধ্যে মেয়ে বড় হয়েছে, মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। যদিও মেয়ের কাছ থেকে কিছু নিতে তিনি চাননি, তবু মেয়ে মাঝেমধ্যে এটা-সেটা দিয়ে যেত। শেষে মেয়ের জামাই আরেক মেয়ের সঙ্গে সংসার পাতে। সখিনার মেয়ে মায়ের কাছে ফিরে আসে। 

খুব দুঃখের দিন শুরু হয় সখিনার, এখন বয়সও অনেক হয়েছে। চেয়ে-চিন্তে (ভিক্ষা করে) দিন কাটান। মেয়েটার মন সেই যে ভেঙেছে, আর জোড়া লাগেনি; কোনো কিছুতে তার মন বসে না, একরকম পাগল পাগল অবস্থা। মায়ের ভিক্ষা করে আনা  টাকা-পয়সার ওপরই নির্ভর করেন। 

সখিনা বেগম ২৭০ টাকা জমিয়ে আজকে সিরিয়াল ধরতে এসেছেন। ওই টাকা জমাতে তার দুই সপ্তাহ লেগেছে। দুই জন মানুষের খাবার খরচের পর আর জমানো যায় না কিছু। সখিনা ১০, ২০ টাকা করে জমিয়েছেন, রাত ১১টা পর্যন্ত রাস্তায় বসে থেকেছেন। কিন্তু সিরিয়াল তার পিছনে, চাল পাবেন কি-না চিন্তায় আছেন। 

নারীদের সারি দীর্ঘ

ডিলারের প্রতিনিধি ফিরোজ আলম বললেন, “সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের ওপর কোনো নির্দেশনা নেই। এটা ওপন মার্কেট। যে কেউ দাঁড়াতে পারেন, আমি  দিতে বাধ্য।” 

“যদিও জেনেছি, তিনি টানা তিনদিন ধরেই চাল-আটা নিচ্ছেন, তার বা তাদের দাপটে অন্যরা দাঁড়াতেও পারছেন না, আগে এসেও খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে কাউকে কাউকে। আমি-আমরা নিরুপায়, কারণ কর্তৃপক্ষ আমাদের এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেনি। দিলে তবে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারব।,” যোগ করেন তিনি।

প্রতিদিন অন্তত চারশ লোক ওএমএস সার্ভিস নিয়ে থাকেন। পুরুষ লাইন ও নারী লাইন আলাদা। সাধারণত নারীদের লাইন তুলনামূলক দীর্ঘ হয়। কী এর কারণ?

৭-৮ জন নারী ও পুরুষের সঙ্গে আলাপ করে নিচের কারণগুলো খুঁজে পাওয়া গেল—

১) পুরুষরা লাইনে দাঁড়াতে লজ্জা পান বেশি 
২) নারীদের হম্বিতম্বি করে লাইন ধরতে পাঠান বাড়ির পুরুষরাই 
৩) সংসারের প্রতি নারীর দায়িত্ব ও মমতা বেশি বলে তারা নিজে থেকেও এ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন 
৪) অনেক পরিবারে পুরুষ সদস্য নেই। 

তবে সব এলাকার চিত্র এক রকম নয়। যেমন— ইস্কাটন গার্ডেন এলাকায় কয়েকবারই পুরুষ সারি দীর্ঘ দেখেছি। কারণ সম্ভবত এখানকার রিকশাওয়ালা, দারোয়ান, ফুটপাথের দোকানদারেরা মেসে থাকেন, তাদের পরিবার থাকে গ্রামের বাড়িতে। তাই এলাকাভেদে চিত্র ভিন্ন হতে পারে। 

“গরীব মানুষের জ্বালা অনেক”, বলছিলেন সখিনা বেগম। ওএমএস লাইনে দাঁড়ানোও বড় জ্বালা। কিন্তু গরীব হলে তো কিছু করার নেই। 

গরীবের জীবন তার নিজের হাতে যতটা থাকে, তার চেয়ে বেশি থাকে কর্তৃপক্ষের হাতে। কর্তৃপক্ষ যদি সজাগ না হয়, তবে গরীবের জ্বালা বাড়তেই থাকে এবং বাড়তে থাকবে।

সূত্র- টিবিএস।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।