পটুয়াখালীর দুমকি থানার মো. মনির হোসেন গাজীপুরে লেবেন্ডার ফ্যাশন লিমিটেডে কাজ করতেন। গত ২০ জুলাই অফিস থেকে বেরিয়ে গাজীপুর চৌরাস্তায় মিছিলে গেলে হেলিকপ্টার থেকে ওই মিছিলে গুলি চালানো হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন তিনি। এরপর থেকে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর)-এ অর্থাৎ যাকে সাধারণ মানুষ পঙ্গু হাসপাতাল বলেই চেনেন, সেখানে চিকিৎসাধীন আছেন। বর্তমানে তার দুটি পায়ে রড দিয়ে এক ধরনের টানা দিয়ে রাখা হয়েছে। ১১৩ দিন হলো তিনি বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। পাশেই তার তিন বছরের ছোট্ট ছেলে ইসমাঈল হোসেন বাবার কোলে উঠার জন্য, তার বুকে খেলা করার জন্য আকুতি, মিনতি করছে, কিন্তু ছেলেকে তিনি বুকে নিয়ে আদর করতে পারছেন না। তার স্ত্রী ফাতেমা দিন-রাত স্বামীর সেবা করে এখন ক্লান্ত। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। তারপরও স্বামীর সেবায় তিনি নিবেদিত। তিনি চান তার স্বামী যেন আগের মতো আবার হাঁটতে পারেন, কাজ করতে পারেন। তার মতো আরো ৮৫ জন আহত গুলিবিদ্ধ বীর যোদ্ধা এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। জুলাই বিপ্লবের আহত এসব বীর যোদ্ধার বর্তমান অবস্থা জানতে, তাদের চিকিৎসার খোঁজ-খবর নিতে গতকাল জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ পঙ্গু হাসপাতালে যাই। হাসপাতালের চতুর্থ তলায় গিয়ে গুলিবিদ্ধ মো. মনির হোসেনের সাথে কুশল বিনিময় করে কথা বলা শুরু করতেই কয়েকজন আনসার সদস্য ছুটে আসেন। তারা বিনয়ের সাথে বলেন, এখানে রোগীদের সাথে এভাবে কথা বলা যাবে না। কথা বলতে হলে পরিচালকের অনুমতি লাগবে। তাদের কথায় গেলাম দোতলায় ২০৭ নম্বর রুমে। যেখানে পরিচালক ডা. মো. আবুল কেনান বসেন। রুমে ঢুকে তার পিএসের কাছে একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়ে সাক্ষাৎ করার কথা বললাম। তিনি বসতে বলে ভেতরে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বললেন, স্যার একটি মিটিংয়ে আছেন। একটু অপেক্ষা করতে হবে। তখন জোহরের নামাজের আজান পড়েছে। তিনি বললেন, চলেন নামাজ আদায় করে আসি, তারপর আপনাদের সহযোগিতার চেষ্টা করব। নামাজ শেষ করে আবার গেলাম তখন পরিচালকের পিএস বললেন, স্যারের মিটিং শেষ হতে দেরি হবে। আপনার পাশের ভবনে উপপরিচালক ডা. বদিউজ্জামান বসেন, তার কাছে যান। গেলাম তার কাছে। তিনি আমাদের পরিচয় জানার পর কিছুটা রাগান্বিত হয়ে পিএসকে ফোন দিয়ে পরিচালকের অনুমতি নেয়ার কথা বললেন। তিনি বললেন, সব দায়িত্ব তিনি একা পালন করতে পারবেন না। তিনি আবার আমাদেরকে (আমি ও আমাদের মাল্টিমিডিয়ার ক্যামেরাপারসন সাব্বির) পরিচালকের রুমে পাঠালেন। এরই মধ্যে আরো একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টার এলেন। তাকেও একইভাবে হয়রানির শিকার হতে হলো। পরিচালকের রুমে আবার যাওয়ার পর পিএস আবার আমাদের সহায়তা করার জন্য ভেতরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে তিনি জানালেন যে, স্যার এভাবে অনুমতি দিতে পারবেন না। রোগীদের সাথে কথা বলতে হলে এখানকার ছাত্র প্রতিনিধির সাথে কথা বলে অনুমতি নিতে হবে। আমরা বললাম, সেই ছাত্র প্রতিনিধি কে, তার ফোন নম্বর দেন, কথা বলি। পিএস আমাদের সেই ছাত্র প্রতিনিধি রিয়াদ লোদীর নম্বর দিলেন। তার নম্বরে ফোন দিয়ে পরিচয় দেয়ার পর তিনি বললেন, আপনি পরিচালকের রুমের সামনে থাকেন আমি আসছি। দুই মিনিটে মধ্যে তিনি আসলেন। আমাদের সাথে পরিচয় হয়ে বললেন, ঠিক আছে আপনারা বসেন আমি পরিচালকের সাথে কথা বলে দেখি অনুমতি দেয়া যায় কিনা। তিনি ভেতরে গেলেন, কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বললেন স্যরি আজ আমি আপনাদেরকে রোগীদের সাথে কথা বলার অনুমতি দিতে পারছি না। কারণ রোগীরা এখন একটা ট্রমার মধ্যে আছে। তাদের কাউন্সেলিং চলছে। আগামী ছয়-সাত দিন পর আসেন, তখন আমি আপনাদের কথা বলার সুযোগ করে দেবো। আমরা জানতে চাইলাম আপনি কে? আপনাকে কি সরকার এখানে রোগীদের দেখার দায়িত্ব দিয়েছে? তখন তিনি বললেন, আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার, ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে এখানে দায়িত্ব পালন করছি। প্লিজ আপনারা আজকে আসুন, আমি আর কিছু বলতে পারব না। এই বলে তিনি রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। তখন প্রয় ৩টা বাজে। পরিচালকের পিএস বেচারা অপারগতা প্রকাশ করে বললেন, ভাই এখন এটাই নিয়ম হয়েছে, আমাদের করার কিছুই নেই।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় হাসপাতালগুলোতে ভর্তি রোগীদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ রোগীর সংখ্যাই বেশি। এসব রোগীর শরীরে নানান জটিলতা দেখা দিচ্ছে। তাদের সারিয়ে তুলতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। গুলিবিদ্ধ এসব তরুণ যুবকের অধিকাংশই কর্মজীবী মানুষ। তাদের কেউ ধরেছিলেন পরিবারের হাল, কারো স্বপ্ন ছিল বিদেশে গিয়ে ঘুচাবেন সংসারের অভাব-অনটন। তাদের সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিলো আন্দোলনে বন্দুকের গুলি। এসব রোগী ও তাদের স্বজনদের দাবি, তারা পথচারী ছিলেন। কেউ কর্মস্থল থেকে ফিরতে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাদের চোখেমুখে হতাশার ছাপ। গতকাল দুপুরে সরেজমিন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র-পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি-২ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, শরীরের বিভিন্ন অংশে গুলির জখম নিয়ে কাতরাচ্ছেন রোগীরা। কর্তব্যরতরা গুলিবিদ্ধ রোগীদের ক্ষতস্থানে ড্রেসিং করে দিচ্ছেন। এ সময় রোগীদের কেউ কেউ ব্যথায় চিৎকার করছেন, কেউ অঝোরে চোখের পানি ছাড়ছেন। অনেকের চোখে গুলি লেগেছে। তারা এখন চোখে দেখতে পান না। তাদের গোটা জীবনই এখন অন্ধকারে ঘিরে ফেলেছে। জুলাই ফাউন্ডেশন আশার আলো হয়ে ইতোমধ্যে অনেকের পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেককে এক লাখ করে টাকা
আরও পড়তে পারেন-
- ইবাদতের গুরুত্ব নিয়ে ঠাট্টা-তাচ্ছিল্য জঘন্য গুনাহ
- উগ্র হিন্দুত্ববাদ এবং মুসলিমবিদ্বেষ ভারত ও বাংলাদেশের জন্য হুমকি
- ‘ইবাদুর রাহমান’ বা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বিশেষ ১২টি গুণ
- মৃত্যুর স্মরণ জীবনের গতিপথ বদলে দেয়
- যে কারণে হিন্দুত্ববাদের নতুন নিশানা ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’
দিয়েছে। যারা পাননি তারাও এ সহায়তা পেয়ে যাবেন। হাসপাতাল থেকে এখন তাদের বিনামূল্যে ওষুধ দেয়া হচ্ছে। তারপরও তাদের প্রতি এক ধরনের অবহেলা হচ্ছেÑ এমনটা সবাই মনে করছেন। তাদের অনেকের দ্রুত উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না। হাসপাতালের রোগীরা এ জন্য হতাশ ও ক্ষুব্ধ। গত মাসে তারা স্বাস্থ্য উপদেষ্টার গাড়ি আটকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। এরপর তাদের চিকিৎসার বিষয়ে কিছুটা মনোযোগী হলেও এখনো অবহেলা রয়েছেÑ এমনটা অনেকে মনে করছেন। তাদের এই ক্ষোভের কথা যাতে মিডিয়াতে বলতে না পারেন এ জন্য মিডিয়াকে সেখানে যেতে দেয়া হচ্ছে না। তাদেরকে অনেকটা বন্দি করে রাখা হয়েছে। পঙ্গু হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় আহত প্রায় ১৭শ রোগী চিকিৎসা নিয়েছিলেন এই হাসপাতালে। তাদের মধ্যে ২৭৫ জন ছিলেন গুলিবিদ্ধ। তাদের কারো পা হারিয়েছে, কারো চোখ হারিয়েছে। কিন্তু তাদের এই হারানো বেদনা বর্তমানে যারা ক্ষমতা উপভোগ করছেন তারা বুঝতে পাছেন কিনা, এমন প্রশ্ন অনেকের মনে।
পা হারানো, চোখ হারানো গুলিবিদ্ধ মানুষগুলো এখন প্রতিদিন মানুষের ভালোবাসা, মায়া, মমতা, অনুভূতি, সহানুভূতি, সহমর্মিতা প্রত্যাশা করছে। কিন্তু আমরা যেন সেই ফেসিস্ট স্বৈরাচারের মতো, অর্থ-সম্পদ, অবৈধতা, রং, নেশার মোহে ডুবতে ডুবতে খুব গভীরে ডুবে যাচ্ছি। মন-মগজে পচন ধরছে। পচনশীল মন ভাবছে, এগুলোই বুঝি সুখ, অথচ এগুলোই তো বড় অসুখ। যে অসুখের কোনো ওষুধ নেই, চিকিৎসা নেই।
উম্মাহ২৪ডটকম: আইএ