Home ইতিহাস ও জীবনী কওমী মাদ্রাসা: দেওবন্দ থেকে হাটহাজারী

কওমী মাদ্রাসা: দেওবন্দ থেকে হাটহাজারী

।। কাজী সাইদ ।।

সর্বশেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নেতৃত্বে ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ব্যর্থ হলে তাকে বার্মায় নির্বাসনে পাঠানো হলো। তার পুত্রদের অনেককেই মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত করা হলো। এ আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে পরিণত হয়েছিল উত্তর ভারত। বৃটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের এ রক্তক্ষয়ী সার্বজনীন আন্দোলনের ব্যর্থতার পর ভারতবর্ষের সুশিক্ষিত অভিজাত মুসলমানদের মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মালো, ভারতবর্ষে মুসলমানরা বৃটিশদের গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ থেকে তাদের রাজনৈতিক প্রাধান্য হারাতে বসেছে এবং মুসলমানদের জন্য এক কালো ইতিহাসের সূচনা শুরু হলো। এমনতর পরিস্থিতিতে মাওলানা মুহাম্মদ কাসিম নানৌতভীর নেতৃত্বে উত্তর ভারতের কিছু ইসলাম ধর্মতত্ত্ববিদ এক হয়ে উত্তর প্রদেশের শাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে ২১ মে ১৮৬৬ সালে (হিজরী ১২৮৩ অব্দ) একটি ডালিম গাছের নিচে প্রতিষ্ঠা করেন ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’ বিদ্যালয়।

মাওলানা নানৌতভীর সাথে প্রতিষ্ঠতা আলেম যাদের নাম উল্লেখ না করলেই নয় তাঁরা হলেন, মাওলানা রাশেদ আহমদ গঙ্গোহী এবং হাজী সাইয়েদ আবিদ হোসেন। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক একদা স্বপ্নে আদিষ্ট হয়েই নানৌতভী এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে নানৌতভীর ভাষ্য থেকে জানা যায়। প্রতিষ্ঠাতাদের মহৎ উদ্দেশ্য ছিল ইসলামিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং ছেলে-মেয়ে ও যুবকদের মধ্যে ইসলামী জ্ঞান অর্জনে প্রকৃত শিক্ষা প্রদান। সত্যিকার আলেম-ওলামা মাশায়েখ, ইসলামী চিন্তাবিদ সৃষ্টির কারিগর হিসেবে দারুল উলুম দেওবন্দ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এবং নন্দিত সর্ববৃহৎ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। এ পর্যন্ত দেওবন্দের পনের হাজারেরও বেশী øাতক এবং মাস্টার্স দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেওবন্দের অনুকরণে হাজার হাজার মাদ্রাসা, মক্তব প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ সবই কওমী মাদ্রাসা নামে পরিচিত।

দেওবন্দের শিক্ষাপদ্ধতি

যুগের চাহিদা এবং ইসলামী গবেষণালব্ধ জ্ঞানের উৎকর্ষতার সাথে দারুল উলুম দেওবন্দের সিলেবাস পরিবর্তিত হয়েছে। দেওবন্দের কারিকুলাম সপ্তদশ শতাব্দীর ইন্দো-ইসলামিক সিলেবাস ‘দারস-ই-নিজামী’র অত্যাধুকি সংস্করণকে ভিত্তি করে প্রণীত হয়েছে।

পবিত্র কুরআন এবং এর বিশেষ দিক নিয়ে শিক্ষা কারিকুলামের মূল ভিত্তি। হাদিস এবং তার সমসাময়িক মতামত, ইসলামী আইন শাস্ত্রের বিধিবিধান, রাসুল (সাঃ) জীবনি এবং জীবন ব্যবস্থা, আরবী ব্যাকরণ, বিভিন্ন ভাষা এবং সাহিত্য অধ্যয়ন কারিকুলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্তমানে কারিকুলামের বিভিন্ন স্তর রয়েছে।

প্রাথমিক, মাধ্যমিক, স্নাতক এবং মাস্টার্স (পোষ্ট গ্রাজুয়েট)। দারুল উলুমের আইন অনুযায়ী, আরবী ক্লাস গুলোতে অংশ নেয়ার আগে পাঁচ বছর মেয়াদী প্রাথমিক স্তরের কৃতকার্যতা অপরিহার্য। এ স্তরে উর্দূ, আরবী, হিন্দি ফার্সি সহ অন্যান্য ভাষা শিক্ষায় জোর দেয়া হয়। পোষ্ট গ্রাজুয়েট কোর্সগুলো বাধ্যতামূলক নয়। কেউ কোন বিষয়ে বিশেষ বুৎপত্তি অর্জনের জন্য মাস্টার্স এবং পিএইচডি কোর্সে ভর্ত্তি হতে পারে।

শুধুমাত্র প্রাথমিক স্তরের কৃতকার্যরাই পরবর্তী ধাপ ‘হিফজে কুরআন’ অথাৎ কুরআন মুখস্ত করণ কোর্সে অংশ নেবে। এতে ২-৪ বছর সময় লেগে যায়। অল্প কিছু সংখ্যক কুরআনে হাফেজ ক্বারী হাফেজ গণ কর্তৃক নির্ধারিত শ্র“তিমধুর কুরআন তেলাওয়াতের কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন। কিছু সংখ্যক ছাত্র পরবর্তী কোর্স ‘সাবা’ এবং ‘আশারা কিরআত’ শিক্ষায় অংশ নেন। সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ৮ বছর মেয়াদী ফজিলত কোর্স যা ‘আরবী আউয়াল’ এর মধ্যমে শুরু হয়ে দাওরা-ই-হাদিস দিয়ে সমাপ্ত। ফজিলত কোর্স সাফল্যের সাথে সমাপ্তির পর উত্তীর্ণরা ‘মাওলানা’ খেতাবে ভূষিত হন। এ কোর্সটি পোষ্ট গ্রাজুয়েট শিক্ষার সমতুল্য। দাওরায়ে হাদিস এর শেষ বর্ষের ক্লাস অনুষ্ঠিত হয় তাজমহলের অনুকরণে নির্মিত বৃহৎ মসজিদ রশিদ এর বেজমেন্টে। ২০১২-১৩ শিক্ষা বর্ষে ১০৬৩ জন ছাত্র দাওরায়ে হাদিস কোর্সে অংশ নিয়েছেন বলে জানা যায়। এ কোর্স সাফল্যের সাথে সম্পাদনকারীদের প্রায় এক চতুর্থাংশ ছাত্র পিএইচডি সমমানের ১৪টি বিশেষায়িত কোর্সে পড়ার সুযোগ পান। এ স্তরের উচ্চমান সম্পন্ন কোর্স গুলোর মধ্যে রয়েছে ‘তাক্লিম ইফতা’ (আইন তত্ত্বে বিশেষজ্ঞ), ‘তাকলিম আদাব’ (আরবি সাহিত্যে বিশেষজ্ঞ) এবং ‘তাকাস্সুল ফিল হাদিস’ (হাদিস বিশেষজ্ঞ)। ‘তাক্মিল ইফতা’ কোর্সে সফলকাম ছাত্ররাই কেবল ‘মুফতি’ খেতাবে সম্মানিত হন।

হাটহাজারী মাদ্রাসা

হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) এর প্রিয় শিষ্য এবং ছাত্র শাইখুল ইসলাম মাওলানা হাবিবুল্লাহ ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দে হাট হাজারী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রতিষ্ঠানটির পুরো নাম হচ্ছে আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনূল ইসলাম। চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত এ মাদ্রাসাটি ১৯০১ সালে বর্তমান হাটহাজারীতে স্থানান্তরিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি পাক-ভারত উপমহাদেশের দ্বিতীয় সর্ব বৃহৎ ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়। বৃটিশ শাসনে এ অঞ্চলে শিক্ষা ব্যবস্থা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক অবস্থা ইসলামী জীবন ব্যবস্থা এবং মুসলমানদের ধর্মীয় ব্যবস্থার সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার ফলশ্র“তিতেই ইসলামি শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যেই এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠে। দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষাপদ্ধতির অনুকরণে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কারিকুলাম প্রণীত হয়ে থাকে। প্রতি বছর এ প্রতিষ্ঠান থেকে শত শত আলেম-উলামা তৈরী হয়ে থাকে। মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ রক্ষণে এ প্রতিষ্ঠানটি নিরন্তন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। হাট হাজারী মাদ্রাসার সহায়তায় দেশের সর্বত্র হাজার হাজার মাদ্রাসা, মসজিদ মক্তব এবং এবাদত খানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ন্যাশনাল ব্যুরো অব এশিয়ান রিসার্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেওবন্দী ধারায় হাট হাজারী মাদ্রাসাটি শিক্ষার মান এবং সুনাম অনুযায়ী উপমহাদেশের প্রধান দশটি মাদ্রাসার মধ্যে অন্যতম।

হেফাজত আমীরের ডাক

মহাপরিচালক দারুল উলূম হাটহাজারী; আমীর- হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ৯মার্চ , ২০১৩ ইসায়ী জাতীয় ওলামা মাশায়েখ সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ থেকে কিছু অংশ উদ্বৃত হলো-

“জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমি আপনাদের কাছে বিনীত ভাবে অনুরোধ করব, মহান আল্লাহ তায়ালা, রাসূলে আকরাম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের বিধান ও প্রতীক সমূহের উপর কাফির, মুশরিক, ইহুদি, নাসারা ও তাদের দোসরদের যেকোন আক্রমন মোকাবেলায় আল্লাহর অস্তে ঐক্যবদ্ধ থেকে কুরআন হাদিসের আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সময়ের অপরিহার্য দাবী। এবং গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সবাইকে সীসাঢালা প্রাচীরের মত ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। নেতৃত্বের মোহ, ক্ষুদ্র স্বার্থ সহ যে কোন সংকির্ণতার উর্ধ্বে উঠে উম্মতে মুসলিমার সংকট কালে আকাবেরিনে ওলামায়ে দেওবন্দ যে ভাবে কোরবাণী ও ত্যাগের নজরানা পেশ করেছিলেন, তা আমাদের জন্য উজ্বল দৃষ্টান্ত। তাদের অনুসারী হিসেবে আমরা প্রত্যেকে দ্বীনের মুজাহিদ হিসেবে নিজেকে আল্লাহর রাস্তায় পেশ করতে হবে। ”

তিনি আরো বলেন, “হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ একটি সামাজিক, আধ্যাত্মিক ও আত্ম সংশোধন মূলক সংগঠন। মূলত: এটি সর্বজনীন অরাজনৈতিক একটি প্লাটফরম। মুসলমানদের ঈমান-আকিদা, সভ্যতা-সংস্কৃতি, ইসলামের বিধান ও প্রতীক সমূহের হেফাজত সম্পর্কে মুসলমানদের সচেতন করে তোলা এবং ধর্মীও ইস্যূতে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন অব্যহত রাখা হেফাজতে ইসলামের প্রধান লক্ষ্য। হেফাজতে ইসলাম মুসলমানদের ঈমান-আকিদা, ও তাহজিব-তমুদ্দুন সংরক্ষনে সর্বাত্মক নিরলস ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। কোন রাজনৈতিক লক্ষ্যে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচি পরিচালিত হয় না। কারো সাথে আমাদের রাজনৈতিক স্বার্থ ভিত্তিক বন্ধুত্ব বা শত্রুতা নেই। কিন্তু রাজনৈতিক ইস্যূও আড়ালে ইসলামকে টার্গেট করা হচ্ছে বিধায় দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে হেফাজতে ইসলাম সর্বস্তরের মুমিন মুসলমান তথা নবী প্রেমিক ইসলাম প্রিয় জনতাকে সাথে নিয়ে কিছু কর্মসূচী ঘোষণা করেছে।” তিনি বলেন, “শতকরা ৯০ শাতাংশ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ। এ দেশ হাজার হাজার আলেম-ওলামা পীর বুজর্গ, মুহাদ্দিস-মুফাসসির, মুফতি, অলি, আউলিয়ার জন্মভুমি। যাদের পদচারণায় বাংলার মাটি ইসলামের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এ মাটির ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহঃ এর উত্তরসূরী, হুজ্জাতুল ইসলাম নানুতুভী রহঃ, ফকিহুল হিন্দ রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রহঃ ও শায়খুল ইসলাম সাইয়েদ হুসাইন মাদানী রহঃ এর লাখো রূহানী সন্তান। এ ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণেই এ মাটির গভীরে প্রোথিত আছে ইসলামের বিস্তৃত শিকড়।”

তিনি বলেন, “সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ইসলামের কিছু দুশমন আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) কে নিয়ে চরম আপত্তিকর ব্যঙ্গ বিদ্রুপে মেতে উঠেছে। তারা অবাধে ও নির্বিঘেœ নবী-রাসূলদের নিয়ে মনগড়া, কুরুচিপূর্ণ , অপবাদমূলক বিভিন্ন মন্তব্য ও কথাবার্তা প্রাচারে দূর সাহস দেখাচ্ছে। এক ব্লগার লিখেছে, আল্লাহ সর্বব্যাপী, তিনি জলাশয়ে আছেন, মলাশয়েও আছেন (নাউজুবিল্লাহ)। তিনি তার দীর্ঘ বক্তব্যে শাহবাগের কথিত জাগরণ মঞ্চের ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ, শাহবাগ আন্দোলনে কাদিয়ানী চক্রান্ত, শাহবাগী ব্লাগারদের ইসলাম অবমাননা সম্পর্কে সরকারী মিথ্যাচার, বাংলাদেশে আক্রান্ত ইসলাম, জাতীয় সংসদে রাসূল (সাঃ) ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন বলে এমপিদের জঘন্য মিথ্যাচার, বর্তমান সরকারের ইসলাম বিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়নে আলেম সমাজ টার্গেট, প্রধানমন্ত্রী বড় না মুহাম্মদ (সাঃ) বড়, মুসলিম বিশ্ব থেকে দেশকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম অবরুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ে সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন।

আমাদের করণীয় কী?

হেফাজত আমীর চারটি করণীয় নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন-

১. আমি মনেকরি, বর্তমান নাজুক সময়ে আলেম সমাজের কর্তব্য হলো, দেশের সাধারণ মুসলমান, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ, সরকারি কর্মকর্তা সহ সর্বস্তরের মানুষকে বোঝানো মহান আল্লাহ তায়ালা ও রাসূল (সাঃ) কে গালি দেয়া হলে, ইসলামের বিধান ও প্রতীক গুলো অবমাননা করা হলে কোন মুসলমান নিরবে ঘরে বসে থাকতে পারে না। এসবের মোকাবেলা না করা হলে আল্লাহর আজাব এবং গজব থেকে আমরা কেউ রেহাই পাব না।

২. আমাদের মাদরিসে দ্বিনীয়ার প্রধান লক্ষ্যগুলোর অন্যতম হলো, রাসূল (সাঃ) ও শানে রিসালাত সম্মূনত রাখা। আমরা এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কাল কিয়ামতের ময়দানে রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর সামনে আমাদের লজ্জিত হতে হবে।

৩. বাংলাদেশে নাস্তিক-মুরতাদ ও ইসলাম বিদ্বেষী বামপন্থীদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যত প্রজন্ম ধর্মহীন হয়ে পড়বে। যার কারণে সর্বত্র ইসলাম বিরোধী ধ্যাণ ধারণা প্রসার লাভ করবে। ঘরে ঘরে আল্লাহ ও রাসুলের শত্রু জন্ম নেবে। আমরা কিছুতেই এরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ দিতে পারি না।

আরও পড়তে পারেন-

৪. আমাদের আকাবিওে দেওবন্দের আদর্শ অনুসরণ করে ইলায়ে কালিমাতুল্লাহর ঝান্ডা হাতে নিয়ে সব বাতিল ফিতনার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

(সূত্রঃ ‘বাংলাদেশে ইসলাম আক্রান্ত’, আল্লামা শাহ আহমদ শফী, নয়াদিগন্ত ১০ মার্চ ২০১৩)

হেফাজতে ইসলামের আমীর শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী কর্তৃক যে সব করণীয়ের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, দেশ কাল পাত্র ভেদে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস স্থাপনকারী কোন ব্যক্তির পক্ষেই তা অনুসরণ না করে উপায় নেই। এ প্রসঙ্গে, একটি হাদিস এর উদ্বৃতি এখানে প্রাসঙ্গিক মনে করছি। হযরত ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “নেতার কথা শোনা ও আনুগত্য করা প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য, তা তার পসন্দ মতো হোক বা অপসন্দনীয়, যতক্ষন তাকে গুনাহের কাজের নির্দেশ না দেয়া হয়। তবে তাকে গুনাহের কাজ করার নির্দেশ দেয়া হলে তা না শোনা এবং না মানাই তার কর্তব্য।” (সিয়াহ সিত্তার পাঁচটি গ্রন্থ। সিহাহ সিত্তাহ সংকলন- তাইসীরুল ওসূল ইলা জামিইল উসূল, হাদিস নং ১৫০৬)

বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্ম

সর্বশেষ সংশোধনীসহ অক্টোবর ২০১১ মুদ্রিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের শুরু হয়েছেঃ- বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে)/ পরম করুনাময় সৃষ্টিকর্তার নামে। এ বন্দনার পরেই রয়েছে প্রস্তাবনা। অনুচ্ছেদ ২(ক) তে বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।” সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি অংশে “ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা” প্রসঙ্গে অনুচ্ছেদ ১২ তে বলা হয়েছে, “ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাপ্রদায়িকতা , (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, (ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন, বিলোপ করা হইবে। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’ প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ- অনুচ্ছেদ ৪১ (১) আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা – সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে; (খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে। ৪১ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেঃ- ‘কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী কোন ব্যাক্তির নিজস্ব ধর্ম-সংক্রান্ত না হইলে তাঁহাকে কোন ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কিংবা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহন বা যোগদান করিতে হইবে না।’

আইন বিচার ও সংসদ বিষয় মন্ত্রনালয় লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের মুদ্রন ও প্রকাশনা শাখা থেকে মুদ্রিত এ সংবিধানের শুরুতে সেই মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রী ব্যারিষ্টার শফিক আহমদের ২০-১০-২০১১ ইং এর একটি উপক্রমনিকা ছাপা হয়েছে। তাতে তিনি দাবী করেছেন, ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধন) আইন, ২০১১-এর মাধ্যমে ১৯৭২ সালে গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত সংবিধানের প্রস্তাবনা সহ মূল চেতনা অর্থাৎ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ ফিরিয়া আসিয়াছে। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ খ্রীষ্টান সহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পালনে সমান অধিকার ও মর্যাদা সুনিশ্চিত করা হইয়াছে।’

যখন শাহবাগে কতিপয় ইসলাম বিদ্বেষী ব্লগারদের ইসলাম বিরোধী প্রচারণার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে আওয়ামী এবং বামপন্থী সরকার দেশের ৯০ ভাগ মুসলমানদের ঈমান আকীদার উপর নির্লজ্ব আঘাত হানলো, তখন কওমী মাদরাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম দেশব্যাপী প্রথম প্রতিবাদ প্রতিরোধে সোচ্চার হয়ে উঠল। ৫মে ঢাকার শাপলা চত্ত্বরে রাষ্ট্রযন্ত্রের বর্বরতায় প্রাণ দিলেন অসংখ্য প্রতিবাদী মুমিন মুসলমান। কারাগারে নিক্ষেপ করা হলো অসংখ্য আলেম ওলামাকে। ইতিহাসের স্বাক্ষ্য, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সর্বাগ্রে ছিলেন মুসলমানরা, ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধেও নেতুত্ব দিয়েছিলেন বাহাদুর শাহ জাফর, ফারায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হাজী শরিয়ত উল্লাহ সৈয়দ আহমদ বেরীলভী, শহীদ তীতুমীর এক একটি উজ্জল নক্ষত্র। বর্তমান ইসলাম বিরোধী শক্তির আতংক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন আল্লামা আহমদ শফী। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে তার নেতৃত্বকে কবুল করে নিন, আমীন।

জঙ্গী উৎপাদনের আখড়ার অপবাদ দিয়ে বর্তমান সরকারের কেউ কেউ দেওবন্দী ধারায় পরিচালিত দেশের সকল কওমী মাদ্রাসার শিক্ষাকে দোষারোপ করে মাদ্রাসা শিক্ষা সরকারী নিয়ন্ত্রনে এনে এর গতিপথ রুদ্ধ করে দেয়ার মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বলে মনে হয়। কওমী মাদ্রাসাগুলো ব্রিটিশ আমলেও সরকারী নিয়ন্ত্রনের কোন তোয়াক্কা করেনি, দেওবন্দ ও ভারত সরকারের অনেক অযাচিত বিল, আইন কানুনের বিরুদ্ধে বরাবরই বিরোধীতা করে এসেছে। স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবেই কওমী মাদ্রাসা গুলোর যাত্রা শুরু। সরকারী নিয়ন্ত্রণে নিয়ে অযোগ্য অপদার্থ ইসলাম বিদ্বেষী ব্যক্তিদের হাতে কওমী মাদ্রাসার যে কোন দায়িত্ব ভার অর্পণ ইসলাম ধ্বংসের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবেই আমরা মনে করি।

আরেকটি হাদিসের উদ্বৃতি দিয়ে শেষ করছি। হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “মুমিনের উপমা হলো ক্ষেতের শস্যের মত, যাকে বাতাস সর্বদা আন্দোলিত করতে থাকে। মু’মিনের উপর সর্বদা বালা-মুসীবত লেগেই থাকে। আর মুনাফিকদের উদাহরণ হলো পাইন গাছের মত, যা বাতাসে দোলায় না, বরং সমূলে কেটে ফেলা হয়।”- বুখারী ও তিরমিযী। (সিহাহ সিত্তাহ সংকলন (উপরোক্ত), হাদিস নং ৪৮)।

লেখক: প্রাবন্ধিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
ইমেইল- Kazi_sayed@yahoo.com

উম্মাহ২৪ডটকম: আইএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।