।। আল্লামা মুফতি খলীল আহমদ কাসেমী ।।
মহান স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলুক হিসেবে সৃষ্টি করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। মানুষ এ দুনিয়ায় এসে মহান স্রষ্টা আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগী করবে, এটাই তার সৃষ্টির মূল রহস্য। যেমনটি এক হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
“আল্লাহ তায়ালা গোটা পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন মানুষের কল্যাণের জন্য এবং মানুষকে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনা মোতাবেক জীবন-যাপন করে চিরস্থায়ী জীবন তথা আখেরাতের কামিয়াবী অর্জন করার জন্য”।
আর এই ইবাদত-উপাসনার পদ্ধতি ও তার নিয়ম-কানুন কী হবে, এর পরিপূর্ণ বিবরণ ও তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে। যারা মানুষকে তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের সকল বিষয়ে সুন্দর ও সুচারুরূপে পালন করার নিয়ম-নীতি ও দিক-নির্দেশনা দিয়ে গেছেন।
মানুষের কাছে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় তুলে ধরা, আল্লাহ তায়ালার দ্বীনের প্রচার-প্রসার করা এবং তাঁর ইবাদতের পথ ও পন্থা বাতলে দেওয়া- এরই নাম হল দাওয়াত ও তাবলীগ। এই দাওয়াত ও তাবলীগের ধারাবাহিকতায় আগমন করেন আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যিনি সর্বশেষ নবী ও রাসূল। উনার পরে আর কোন নবী দুনিয়াতে আসবেন না। তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা এ দ্বীনের পূর্ণতা দান করেছেন।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, অর্থাৎ- “আমি আজ তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম। আর আমার নিয়ামতকে তোমাদের ওপর পূর্ণতা দান করলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসাবে পছন্দ করলাম”। (সূরা- মায়েদাহ, আয়াত-৩)।
সুতরাং নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে এ দ্বীনে ইসলামের পূর্ণতা দেওয়া হয়েছে । যার ফলে কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আর কোনো নবী-রাসূল আসবেন না।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বড় দয়া করে আমাদেরকে সেই আখেরী নবী তাজদারে মদীনা, সায়্যিদুল কাওনাইন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত বানিয়েছেন। যেই উম্মতকে আল্লাহ তায়ালা সর্বদিকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। যেমন- এই উম্মতের আগে অন্য কোন উম্মত জান্নাতে যেতে পারবে না। এই উম্মতের হায়াত হবে অল্প এবং আ’মালও হবে কম। কিন্তু বিনিময় বা সাওয়াব হবে অন্যদের থেকে অনেক বেশী।
যেমনটি এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, অর্থাৎ- “আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- তোমাদের এবং ইহুদী-নাসারাদের দৃষ্টান্ত হল এমন যে, এক ব্যক্তি কিছু মজদুর নিল এবং বলল, কে আছ সকাল (ফজর) থেকে দুপুর (যোহর) পর্যন্ত আমার কাজ করবে এবং তাকে আমি এক ক্বিরাত দিব (উদাহারণ স্বরূপ একশত টাকা) । তো ইহুদীরা সেই এক ক্বিরাতের বিনিময়ে দুপুর পর্যন্ত কাজ করলো। অতঃপর তিনি আবার বললেন, কে আছ যোহর থেকে আছর পর্যন্ত আমার কাজ করবে এবং আমি তাকে এক ক্বিরাত দিব। তো নাসারারা আছর পর্যন্ত কাজ করলো এবং বিনিময়ে এক ক্বিরাত পেল।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা পুনঃরায় বললেন, কে আছ, যে আছর থেকে সূর্য ডোবা (মাগরীব) পর্যন্ত আমার কাজ করবে এবং আমি তাকে দুই ক্বিরাত দিব”। এর রাসূলুল্লাহ (সা.) উপস্থিত সাহাবীগণকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “তো শুনে রাখ! তোমরাই হলে তারা যারা আছর থেকে মাগরীব পর্যন্ত কাজ করেছ। তোমাদের জন্য অল্প সময়ে দ্বীগুণ নেকী দেওয়া হবে”।
এখন অল্প সময়ে অল্প মেহনতে এত বেশি নেকী কেন? কারণ হল, একে একে লক্ষাধিক নবী-রাসূল আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। এভাবে নবী-রাসূলদের ধারাবাহিকতা শেষ হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা সর্বশেষ আমাদের নবী তাজদারে মদীনা সায়্যিদুল-কাওনাইন রাহমাতুল লিল-আলামীন হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই দুনিয়ার বুকে পাঠিয়েছেন। যার পরে আর কোন নবী দুনিয়াতে আসবেন না। কিন্তু দ্বীনের এই দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ কিয়ামত পর্যন্ত বাকি থাকবে।
সুতরাং নবীদের যে কাজ ছিল, “মানুষকে আল্লাহ তাআলার দিকে ডাকা এবং মানুষের মাঝে আল্লাহর দ্বীনের প্রচার-প্রসার করা”, নবীর নায়েব হিসেবে এই দায়ীত্ব উম্মতকে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর দ্বীনের দিকে পথপ্রদর্শনের মতো এ মহান কাজের দায়িত্ব এই উম্মতকে দেওয়ার কারণে এই উম্মতের হায়াত অল্প হলেও বিনিময় তথা সাওয়াব বেশী দেওয়া হবে। আর তাই তো এই উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব ও তার কারণ সম্পর্কে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন, অর্থাৎ- “তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। তোমাদেরকে মানুষের কল্যাণের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। কেননা, তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজের নিষেধ করবে”। (সূরা আলে-ইমরান- ১১০)।
এই দাওয়াতের কাজ যারা করবে, কিয়ামতের ময়দানে তারা দেখবে যে, তার আমল নামায় হাজার হাজার হজ্বের সাওয়াব, হাজার হাজার সদকার সাওয়াব, যাকাতের সাওয়াব, নামাযের সাওয়াব, রোযার সাওয়াব লেখা রয়েছে। তখন সে বলবে, হে আল্লাহ! এটা কার আমল নামা আমার কাছে এসেছে, আমি তো একটা হজ্বও করতে পারি নাই। আমি তো গরীব ছিলাম।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
আর এখানে তো অনেক হজ্বের সাওয়াব দেখতেছি। তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করবেন- আজকে কারো উপর জুলুম করা হবে না। অন্য কারো সাওয়াব তোমাকে দেওয়া হয়নি। বরং তুমি যে মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছিলে এবং তোমার দাওয়াতে হেদায়েত পেয়ে তারাও অন্যদেরকে দাওয়াত দিয়েছে। এভাবে কিয়ামত পর্যন্ত ধারাবহিকভাবে চলে এসেছে। আর এই সবই তো তোমার দাওয়াতের কারণে। তাই তারা তাদের সব আমল করে যে নেকী পাবে আজকে তোমাকেও তাদের আমল বরাবর সাওয়াব দেওয়া হবে।
যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ এই দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করেছেন। হযরত নূহ (আ.) সাড়ে নয় শত বছর এই দাওয়াতের কাজ করেছেন। অনূরুপ হযরত ইবরাহীম (আ.) এই দাওয়াতের কাজ করেছেন, হযরত মূসা (আ.) হযরত ঈসা (আ.)… এভাবে সমস্ত নবী-রাসূলরা এই দাওয়াতের কাজ করেছেন। এবং এই দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করতে গিয়ে সব ধরনের ত্যগ-তিতীক্ষা, কষ্ট-মুজাহাদা স্বীকার করেছেন। নিজের ঘর-বাড়ি ছেড়েছেন, পরিবার-পরিজন ত্যাগ করেছেন, মানুষের জুলুম-অত্যাচার সহ্য করেছেন।
সর্বশেষ আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দাওয়াতের কাজ করতে গিয়ে কি পরিমান কষ্ট সহ্য করেছেন তা আমরা কম-বেশী সকলেই জানি এবং উম্মত হিসেবে জানা থাকাও জরুরী। এই দ্বীনের খাতিরে নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করেছেন। কাফেরদের গালি-গালাজ শুনেছেন। পাথরের আঘাতে নিজের শরীরের তাজা রক্ত প্রবাহিত করেছেন। যেই শরীরে মশা-মাছি পর্যন্ত বসা হারাম ছিল, সেই শরীরে কাফেররা পাথর মেরে রক্তাক্ত করেছে শুধুমাত্র এই দ্বীনের দাওয়াতের জন্য।
এমনিভাবে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর সাহাবায়ে কিরাম (রাযি.) এই দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে দুনিয়ার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। আর তাই তো তাঁদের কবর আজকে সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তাঁরা তো এই কাজের জন্য সর্বাবস্থায় তৈরী থাকতেন এবং কে কার থেকে বেশী করতে পারেন আর কে কার থেকে আগে বাড়তে পারেন, সে জন্য প্রতিযোগিতা দিতেন। অতএব, ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল উম্মাতের জিম্মাদারী হল, এ দাওয়াতের কাজ। সমস্ত উম্মতকে সরল-সঠিক পথ দেখানোর জিম্মাদারী ও দায়িত্ব হল এ উম্মতে মুহাম্মাদীর প্রত্যেকের ওপর।
যুগে যুগে বিভিন্ন পদ্ধতিতে দ্বীনি দাওয়াতের এ গুরুদায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে আসছেন এ উম্মাতের মুখলেসীনরা। বর্তমানে দাওয়াত ও তাবলীগের নামে যে মেহনত সারা পৃথীবি ব্যাপী চলছে, তা কেবল মাত্র উম্মাতের এ মহান যিম্মাদারী আদায় এবং সর্বস্তরের মানুষের কাছে দ্বীন পৌঁছানোর জন্যেই। দাওয়াত ও তাবলীগ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি উম্মাতের জন্যে তার ইলম ও সামর্থ্য অনুযায়ী আদায় করা আবশ্যক। ওলামায়ে কিরাম এ কাজের প্রথম স্থান ও প্রথম কাতারের দায়িত্বশীল দ্বিনী মাদারেসে দরস-তাদরিস প্রদান, লেখালেখি ও বয়ানের মাধ্যমে এই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এরপর সাধারণ মুসলমানগণ। প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষকে কালিমা, নামায, রোযা, যিকির, তিলাওয়াত, মুয়ামালাহ-মুয়াশারাহ লিল্লাহিয়াত ও খুলুসিয়্যাতের দাওয়াত দেওয়া জরুরী।
এজন্য এ দাওয়াতের কাজ সকল মুসলমানকে অনবদ্যভাবে করতে হবে। আখেরী নবীর উম্মত হিসেবে আমাদের সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল, মানুষকে আল্লাহ তায়ালার দ্বীনের দিকে ডাকা ও দাওয়াত দেওয়া এবং মৃত্যু পর্যন্ত এ কাজের সাথে লেগে থাকা। মুসলিম বিশ্বের এ মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়ার কাজটি যেমন উলামায়ে কেরাম আদায় করে যাচ্ছেন, তেমনি লেখক, সাংবাদিক, ইমাম, খতীব এবং তালেবুল ইলমগণও স্ব স্ব অবস্থান থেকে পালন করে যাচ্ছেন। এই দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ অত্যন্ত গুরুত্ববহ।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে স্ব স্ব অবস্থান থেকে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ আরো উত্তমভাবে আঞ্জাম দেওয়ার তাওফীক দান করুন; আমীন।
– আল্লামা মুফতি খলীল আহমদ কাসেমী কুরাইশী (দা.বা.), মহাপরিচালক- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মু্হঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
অনুলিখনে- মুনির আহমদ
উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ