ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকারের ভয়াবহ পতন ঘটলেও এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন আওয়ামী লীগ আমলের আমলারা। গত ৫ আগস্টের পর পতিত সরকারের প্রভাবশালী আমলারা চাকুরিচ্যুতির আশঙ্কায় থাকলেও বেশির ভাগই নমনীয়নীতিসহ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে অবস্থান পোক্ত করে নিয়েছেন। সেই সুবাধে কিছু দিনের জন্য কোনঠাসা হয়ে পড়া আমলারা আরো বেশি দাপট দেখাচ্ছেন। যদিও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের সাথে এসব আমলার যোগাযোগ এখনো অব্যাহত রয়েছে। তাদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী আর্থিক থেকে সেবাখাত, শিক্ষা থেকে সুরক্ষা খাত, প্রশাসনিক থেকে আইনশৃঙ্খলা সবখানেই একটি অস্থিরতা তৈরির মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য কৌশলে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন বলে সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সাথে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের মধ্য দিয়ে ৮ আগস্ট নোবেল লরিয়েট ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর থেকেই একের পর এক বিভিন্ন খাতে শুরু হয় অস্থিরতা, যা এখনো চলমান রয়েছে। আর্থিক খাতকে দুর্বল করার জন্য দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন দাবির ধুয়া তুলে পোশাকশ্রমিকরা আন্দোলন করছে। ওই সময় সরকার তাদের দাবি মানলেও দু-একদিন পর পর থেমে থেমে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ব্যবসায়ীদের পোশাক কারখানার শ্রমিকরা রাজপথ আটকিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যান। গতকালও রাজধানীর মিরপুর ১৪ নম্বরে যৌথ বাহিনীর সাথে পোশাকশ্রমিকদের ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে আন্দোলনরত পোশাকশ্রমিকরা পুলিশের একটি ও সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেন। সেখানকার পরিস্থিতি এখনো থমথমে। শিক্ষাঙ্গনেও অস্থিরতা থেমে নেই। সর্বশেষ সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি আদায়ের জন্য গেল কয়েকদিন রাজধানীর সায়েন্সল্যাব সড়ক বন্ধ করে আন্দোলন করছে। তাদের আন্দোলনের ফলে রাজধানীতে ভয়াবহ যানজট দেখা দেয়। আগামী রোববারও দাবি বাস্তবায়নে তাদের রাজপথে নামার কথা রয়েছে। বিদ্যুৎখাতেও চলছে রীতিমতো নৈরাজ্য। দেশের গ্রাম ও মফস্বল শহরে হুটহাট করে বিদ্যুৎ চলে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এখনো লোডশেডিং থাকে। ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা-উপজেলায়ও একই অবস্থা। প্রায়ই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা বলে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত টানা বিদ্যুৎপরিচালন বন্ধ রাখে কর্তৃপক্ষ। আবার রাতের বেলায়ও থেমে থেমে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়- যা নিয়ে জনমনে তীব্র অসন্তোষ কাজ করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। শাকসবজিসহ কিছু পণ্যের দাম কিছুটা কমলেও আলু, আদা, পেয়াজ, রশুন ও মুরগী-মাছের দাম সেই চড়ামূল্যেই বিক্রি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলায়ও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেই।
মাঠপর্যায়ের প্রশাসনের বদলি, নিয়োগ, পদোন্নতিতেও সেই আওয়ামী লীগ আমলের আমলাদের আধিপত্য রয়ে গেছে। তাদের পছন্দ অনুযায়ী বেছে বেছে আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের বদলি পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। ৫ আগস্টের পর জনপ্রশাসনের কয়েকটি পর্যায়ে বিতর্কিতদের পদোন্নতি দেয়া নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি ইউএনওদের বদলি নিয়েও ব্যাপক বিতর্ক দেখা দেয়। ঢাকার এক ইউএনও এ প্রতিবেদককে জানান, মাঠ প্রশাসনের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছাড়াই বিভাগীয় কমিশনার বানানো হয়েছে। কমিশনার হিসেবে যোগদান করে ৩ দিনেই পতিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী অফিসারদের বিভিন্ন উপজেলায় ইউএনও এবং এসিল্যান্ড হিসেবে তিনি পদায়ন করেছেন। অভিযোগ আছে, শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হিসেবে সুপরিচিত চট্টগ্রাম এবং ঢাকার সাবেক ডিসি মোমিনুর রহমানের ইচ্ছে মোতাবেক এসব অফিসারকে পদায়ন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অনেক সৎ, মেধাবী ও বঞ্চিত অফিসারদের বিবেচনায় নেয়া হয়নি। আরো অভিযোগ আছে, এ কাজে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেসুর রহমানের সুপারিশও কাজ করেছে। কিছুদিন আগে ওই সিনিয়র সচিবের নামে একটি গণমাধ্যমে টাকা লেনদেন সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হলে দেশজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আর্থিক এবং সেবাখাতে ভয়াবহ একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। একদিকে আর্থিক খাতকে দুর্বল করার জন্য সিন্ডিকেটগুলো সক্রিয় রয়েছে। ওই সিন্ডিকেটে ছিলেন তৎকালীন শেখ হাসিনার সরকারের সাবেক মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, এস আলম গ্রুপের সাইফুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ও সাবেক অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। আর্থিক বিভাগের অনিয়ম ধামাচাপা দেয়ার জন্য আব্দুর রউফের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত ড. খায়রুজ্জামানকে অর্থসচিব, শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক এবং সিএজি হিসেবে মো: নুরুল ইসলামকে নিয়োগ প্রদান করা হয়। অভিযোগ আছে, ২০২৩ সালে সিএজি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পরই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির রেওয়াজ ভেঙে একাধিকবার টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে চালু থাকা দিবস অতি উৎসাহের সাথে সরকারি অর্থ ব্যয়ে পালন করেন। গত ৫ আগস্টের পরে সিএজির পদত্যাগের দাবিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিক্ষোভ করলেও তিনি এখনো বহালতবিয়তে রয়েছেন। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে কেউ কেউ গ্রেফতার হলেও বহালতবিয়তে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন আরো অনেকেই।
আরও পড়তে পারেন-
- ইবাদতের গুরুত্ব নিয়ে ঠাট্টা-তাচ্ছিল্য জঘন্য গুনাহ
- উগ্র হিন্দুত্ববাদ এবং মুসলিমবিদ্বেষ ভারত ও বাংলাদেশের জন্য হুমকি
- ‘ইবাদুর রাহমান’ বা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বিশেষ ১২টি গুণ
- মৃত্যুর স্মরণ জীবনের গতিপথ বদলে দেয়
- যে কারণে হিন্দুত্ববাদের নতুন নিশানা ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’
সচিবালয়ে কর্মরত ৫ গ্রেডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ মহলের সাথে ওই আমলের সচিব, সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্তরা এবং সেবা খাতের বিভিন্ন অধিদফতরের ডিজিরা অতি সুকৌশলে এখনো যোগাযোগ রক্ষা করছেন। তারা মনে করছেন, দেশের কোথাও শৃঙ্খলা নেই। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে এই সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় পুরোপুরি ব্যর্থ প্রমাণিত হবে। এজন্য ধীরে ধীরে সেবা ও আর্থিকখাতে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করার ছক আঁকা হচ্ছে যাতে ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার নিজ থেকেই ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ওই সুযোগে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবে- এমনটি প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এজন্য এখন থেকেই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে অসেন্তাষ দানা বেঁধে উঠে সেই সব খাত চিহ্নিত করে পরিকল্পিতভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে এখন থেকেই গ্রাউন্ড তৈরি করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আবদুল লতিফ মাসুম নয়া দিগন্তকে বলেন, সবখানেই একটা অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর একটি অস্থায়ী অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে। অনেকেই মনে করছে, এখনই দাবি দাওয়া আদায়ের মোক্ষম সময়। তারা বিভিন্ন উসকানিতে পা দিয়ে মূলত কিছু দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও দূরদর্শিতার অভাবে এগুলো মোকাবেলা করতে পারছে না। তিনি আরো বলেন, এখনো প্রশাসন ঢেলে সাজাতে পারেনি এ সরকার। আওয়ামী লীগ আমলের আমলা বা প্রশাসনই রয়ে গেছে। তাদের অনেকেই মনে করছে, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবে। তারা একটি ঘোরের মধ্যে আছে। যদি সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া যেত তাহলে এ ধরনের অস্থিরতাগুলো তৈরি হতো না।
উম্মাহ২৪ডটকম: আইএ