।। জহির উদ্দিন বাবর ।।
বাংলাদেশের হাতেগোনা যে কজন আলেম বিশ্ব পরিম-লে পরিচিত, তাদের একজন মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক। জ্ঞান ও গবেষণায় তিনি সমকালীন আলেমদের মধ্যে নিজেকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। আলেম-উলামার কাছে তিনি আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক। ফিকাহ ও ইলমে হাদিসে তার পাণ্ডিত্যের কথা দেশ-বিদেশে স্বীকৃত। তার যেকোনো মত ও গবেষণাকে সবাই সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করে থাকেন। সম্প্রতি এই বরেণ্য আলেমকে জাতিয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতীব হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। বক্ষমান নিবন্ধে তাঁর জীবনের আলোজ্জ্বল কিছু দিক নিয়ে লিখেছেন মাওলানা জহির উদ্দিন বাবর।
জ্ঞান, গবেষণা ও পাণ্ডিত্যে দেশের আলেম সমাজের কাছে ব্যাপক পরিচিত নাম মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক। তার ইলমি (জ্ঞানের) গভীরতার কথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন। ইসলামি জ্ঞানের এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার মনে করা হয় তাকে। এজন্য যেকোনো বিরোধপূর্ণ সমস্যার সমাধানে সবার দৃষ্টি থাকে তার ওপর। বর্তমান সময়ে মাসয়ালা-মাসায়েল ও ফতোয়ার ক্ষেত্রে কোথাও কোনো বিতর্ক দেখা দিলে সবাই তার শরণাপন্ন হন। বিশেষ করে ফিকাহ (ইসলামি আইন) ও হাদিসশাস্ত্রে তার গবেষণার ব্যাপ্তি শুধু দেশে নয়, উপমহাদেশসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত। মুসলিম বিশ্বের শীর্ষ আলেমদের কাছে ইলমি ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশে ইলমিবিষয়ক সভা-সেমিনারে প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন মাওলানা আব্দুল মালেক। গতানুগতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে তিনি নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিয়েছেন জ্ঞান ও গবেষণার জগতে। ইলমের জন্য তিনি নিজের পুরো জীবনই ওয়াকফ করে দিয়েছেন। ইলমকে কেন্দ্র করেই তার পুরো ধ্যান-জ্ঞান। নিভৃতচারী এই মনীষী ইতিমধ্যে দেশের আলেম-উলামা ও দ্বীনদার শ্রেণির কাছে আলোর মিনার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন।
মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ১৯৬৯ সালের ২৯ আগস্ট কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার সারাশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বাবা মাওলানা শামসুল হক (রহ.) ছিলেন ওই অঞ্চলের খ্যাতিমান আলেম। তার ভাইয়েরা সবাই যোগ্য এবং তাদের নানামুখী খেদমত রয়েছে। পরিবারে কোরআন মাজিদ ও প্রাথমিক শিক্ষালাভের পর তিনি চাঁদপুরের শাহরাস্তির খেড়িহর কওমি মাদ্রাসায় মিশকাত জামাত পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৮৮ সালে মাওলানা আব্দুল মালেক পাকিস্তানের বিখ্যাত জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়ায় দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি ওই মাদ্রাসার উচ্চতর হাদিস বিভাগে ভর্তি হয়ে তিন বছর বিখ্যাত আলেম মাওলানা আব্দুর রশীদ নোমানী (রহ.)-এর তত্ত্বাবধানে হাদিস অধ্যয়ন করেন। ১৯৯২ সালে তিনি দারুল উলুম করাচিতে ভর্তি হয়ে মুসলিম বিশ্বের খ্যাতিমান স্কলার মুফতি তাকি উসমানির তত্ত্বাবধানে দুই বছর উচ্চতর ফিকাহ ও ফতোয়া বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি সৌদি আরবে যান। সেখানে আরব বিশ্বের সুপরিচিত আলেম শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহর তত্ত্বাবধানে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত কাটান। প্রায় আড়াই বছর হাদিসশাস্ত্রসহ অন্যান্য গবেষণামূলক কাজের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন।
দেশে ফিরে ১৯৯৬ সালে তিনি এবং তার বড় ভাই মাওলানা আবুল হাসান আব্দুল্লাহসহ কয়েকজন আলেম ঢাকায় উচ্চতর ইসলামি শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাসচিব ও উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগের প্রধান। মূলত তাকে কেন্দ্র করেই পরিচিতি পেয়েছে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানটি। রাজধানীর পল্লবী ও কেরানীগঞ্জের হজরতপুরে প্রতিষ্ঠানটির দুটি ক্যাম্পাস রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান ঘিরেই মাওলানা আব্দুল মালেকের ইলমি গবেষণা পরিচালিত হয়। ইতিমধ্যে তার হাতেগড়া ছাত্ররাও সুযোগ্য হিসেবে গড়ে উঠেছেন, যারা দ্বীনের বিভিন্ন শাখায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
মারকাযুদ দাওয়ার বাইরে মাওলানা আবদুল মালেক জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া ঢাকার শায়খুল হাদিস ও শান্তিনগরের আজরুন কারিম জামে মসজিদের খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন। কওমি মাদ্রাসার সরকারি স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে ২০১২ সালে বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন গঠিত হলে তিনি এর সদস্য মনোনীত হন। ২০১৯ সালে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের জাতীয় চাঁদ দেখা উপকমিটির প্রধান মনোনীত হন। এ ছাড়া আলেমদের সম্মিলিত বিভিন্ন কাজে তিনি যুক্ত আছেন।
আরও পড়তে পারেন-
- ইবাদতের গুরুত্ব নিয়ে ঠাট্টা-তাচ্ছিল্য জঘন্য গুনাহ
- উগ্র হিন্দুত্ববাদ এবং মুসলিমবিদ্বেষ ভারত ও বাংলাদেশের জন্য হুমকি
- ‘ইবাদুর রাহমান’ বা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বিশেষ ১২টি গুণ
- মৃত্যুর স্মরণ জীবনের গতিপথ বদলে দেয়
- যে কারণে হিন্দুত্ববাদের নতুন নিশানা ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’
২০০৫ সালে মাওলানা আবদুল মালেকের তত্ত্বাবধানে মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়ার মুখপত্র হিসেবে মাসিক আলকাউসার প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় হাদিসশাস্ত্রের নব-উদ্ভাবিত বিভ্রান্তির নিরসনমূলক রচনাসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে তার লেখা প্রকাশিত হয়ে আসছে। পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যাতেই তার একাধিক গবেষণামূলক মূল্যবান লেখা থাকে, যার জন্য পাঠক অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন। তার এসব লেখার সংকলনও এ দেশের দ্বীনদার মুসলমানদের সঠিক দ্বীনের ওপর চলার সহায়িকা হিসেবে কাজ করছে।
মাওলানা আবদুল মালেকের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে তালিবুল ইলমের পথ ও পাথেয়; উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা; প্রচলিত ভুল; হাদিস ও সুন্নায় নামাজের পদ্ধতি; তারাবির রাকাতসংখ্যা ও ঈদের নামাজ; ইমান সবার আগে; তাছাউফ ও তত্ত্ববিশ্লেষণ; প্রচলিত জাল হাদিস; তাবলিগ জামাত : বর্তমান পরিস্থিতি ও উত্তরণের উপায়, দুই খণ্ডের প্রবন্ধ সমগ্র। আরবি গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে আল-মাদখাল ইলা উলুমিল হাদিসিশ শরিফ; আল-ওয়াজিজ ফি শাইয়ি মিন মুসত্বলাহিল হাদিসিশ শরিফ; মুহাদিরাত ফি উলুমিল হাদিস; ইনায়াতুর রহমান ফি আদাদি আয় আল-কোরআন; তাওতিদ আল উখওয়াত আল ইমানিয়াত ইত্যাদি। তার লিখিত কিতাব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশ্ববিদ্যালয় মানের প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যভুক্ত। এ ছাড়া তার সম্পাদনা ও তত্ত্বাবধানে বেশ কিছু বই ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রকাশের পথে রয়েছে আরও অনেক বই।
মাওলানা আবদুল মালেকের ব্যক্তিত্বের উচ্চতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় সমকালীন কিছু আলেমের উক্তি দ্বারা। মদিনা মুনাওয়ারার বিখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ আওয়ামা মাওলানা আব্দুল মালেককে ‘মুহাক্কিক আলেম’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। শিক্ষক মাওলানা আব্দুর রশীদ নোমানী (রহ.) তাকে ফিকাহ পড়ার জন্য যখন মুফতি তাকি উসমানির হাতে তুলে দেন তখন এক পত্রে লেখেন ‘এই তালিবে ইলম কী পরিমাণ যোগ্যতাসম্পন্ন, কত গভীর ইলমের অধিকারী, তাকে পড়ালেই তা বুঝতে পারবেন।’ আরব বিশ্বের সমাদৃত মুহাদ্দিস শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি দাবি করেন, আমার কাছ থেকে তিনি উপকৃত হয়েছেন। অথচ আমি দেখি তার থেকে আমিই অনেক উপকৃত হয়েছি। সে তার অনেক উস্তাদের থেকেও এগিয়ে যাবে। সেই উস্তাদদের মধ্যে আমি হব প্রথমজন।’
দারুল উলুম দেওবন্দের মাওলানা সাঈদ আহমদ পালনপুরী (রহ.) তার কিতাব ‘আল-মাদখাল’ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, ‘আল্লাহর বিশেষ তওফিকপ্রাপ্ত ও ইলমব্যস্ত এই উস্তাদ ও শায়খের কিতাব আমাকে বিমোহিত ও বিস্মিত করে দিয়েছে।’ দেশের সমকালীন আলেমদের প্রায় সবাই তার গুণমুগ্ধ। তার ইলমি অবস্থানের
স্বীকৃতি দিয়েছেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.), আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.)-এর মতো সমকালীন শীর্ষ আলেমরা। তাকে বাংলাদেশের গর্ব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তারা।
ইলমি পরিবারের সন্তান মাওলানা আবদুল মালেক ছোটবেলা থেকেই প্রখর মেধার অধিকারী। পড়াশোনায় গভীর মনোযোগ তখন থেকেই। তিনি কিতাব পড়ায় নিমগ্ন হলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যেতেন ছাত্রজীবনে। পড়াশোনার বাইরে তার আর কোনো কাজ ছিল না। এখনো সেই অভ্যাসটি ধরে রেখেছেন সযতনে। দিন-রাতের বেশিরভাগ সময় পড়াশোনাতেই ব্যস্ত থাকেন। হাজার হাজার কিতাবের মধ্যে তার বসবাস। প্রাচীন ও আধুনিক হাজারো কিতাব তার নখদর্পণে। ইলমের সাগরে ডুবে থাকতেই তিনি পছন্দ করেন। বেশিরভাগ সময় কাটে কেরানীগঞ্জের ছায়ানিবিড় নিভৃত গ্রাম হজরতপুরে মারকাযুদ দাওয়াহর ক্যাম্পাসে। সময়ের মূল্যায়নের ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সচেতন। ঘড়ির কাঁটা ধরে চলেন তিনি। ছাত্রদেরও তিনি সেই শিক্ষাই দেন। সারা দেশের নির্বাচিত ছাত্ররা তার কাছে পড়াশোনার সুযোগ পান। তাদের তিনি সেভাবেই গড়ে তোলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত বিনয়ী, সজ্জন, অমায়িক ও সাদাসিধে প্রকৃতির। দ্বীন ও নীতি-আদর্শের প্রশ্নে কোনো ছাড় দেন না। নিয়মের খেলাপ কিছু পছন্দ করেন না।
আপাদমস্তক একজন ইলমি মানুষের প্রতিকৃতি মাওলানা আবদুল মালেক। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের উচ্চতর গবেষণায় বাংলাদেশে তিনি এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছেন। পরবর্তী সময়ে তাকে অনুসরণ করে অনেকেই নতুন গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। সময়ের বাস্তবতায় যোগ্য আলেম তৈরির মিশনে তিনি সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। শুধু ইসলামি অঙ্গনই নয়, তিনি বাংলাদেশের জন্য বড় সম্পদ। ইলমি দুনিয়ায় অনেকে তাকে দিয়ে বাংলাদেশকে চিনে। তার খেদমতের ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দিনে দেশের এই সুনাম উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবে।
লেখক: লেখক, সাহিত্যিক ও বার্তা সম্পাদক, ঢাকা টাইমস।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ