Home জাতীয় ভোগান্তির শহর ঢাকা!

ভোগান্তির শহর ঢাকা!

প্রাক মুঘল যুগে ঢাকা শহর পরিচিত ছিল ‘বাহান্ন বাজার তিপান্ন গলি’ হিসেবে। মুঘল আমল, ব্রিটিশ আমল আর পাকিস্তান আমল পর্যন্ত বলা হতো ‘মসজিদের শহর ঢাকা’। সেই মসজিদের শহর রূপ নিয়েছে রিকশার শহর হিসেবে। এখন বলা হচ্ছে, যানজটের শহর, ভোগান্তির শহর ঢাকা। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ঢাকা যেন ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। রাজধানীজুড়ে শুধু গাড়ি আর রিকশা।

এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে যানজট নেই। ২০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে এখন ৫ ঘণ্টাও লাগে। সরকারে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে একজন উপদেষ্টা আছেন। তিনিও কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়েরও কোনো মাথা ব্যথা নেই। পুলিশ নামমাত্র দায়িত্ব পালন করছে। যেসব অভিযানের কথা বলা হচ্ছে সবই অপ্রতুল, ভোগান্তির তুলনায় কিছুই না। ভুক্তভোগিদের প্রশ্ন- এভাবে আর কতোদিন? পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. মইনুল ইসলাম গতকাল শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দুর্গাপূজার পর ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক, অপরাধমূলক কর্মকা- ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অভিযান পরিচালনা করা হবে। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির আহ্বায়ক সাইফুল আলম ইনকিলাবকে বলেন, আগামী সপ্তাহ থেকে আমাদের ৪-৫শ’ কমিউনিটি পুলিশ ট্রাফিক পুলিশকে সহায়তায় রাত-দিন কাজ করবে। এসব আশার বাণীর আদৌ বাস্তব প্রতিফলন ঘটবে কি না তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। কারণ সরকার দায়িত্ব নেয়ার দুই মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর মানুষের ভোগান্তি লাঘবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।

যানজটে ভোগান্তির শহর হিসেবে বিশ্বে পঞ্চম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। সময় অপচয় ও ট্রাফিকের অদক্ষতা সূচকেও এগিয়ে ঢাকা। বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নামবিও’র ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০২৩ সালের তথ্য এটি। বর্তমানের ভোগান্তি হিসাব করলে এই সূচকের মান নিশ্চয় আরও বাড়বে।
বিশ্বব্যাংক এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্যানুযায়ী, ২০০৭ সালে ঢাকায় গাড়ির গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। ২০২২ সালে তা কমে হয়েছে ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। বর্তমানে এই গতি চারেরও কম। এই হারে গতি কমলে ঢাকা এক সময় নিশ্চল এবং পরিত্যক্ত শহরে পরিণত হবে।

গুলিস্তান থেকে কাঁচপুর সেতুর দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। ফ্লাইওভার হয়ে সড়কপথটি আট লেনের। এই আট লেন সড়কে যানবাহন চলবে নির্বিঘেœ যাতে সময় লাগার কথা সর্বোচ্চ ১০/১২ মিনিট। অথচ এই ১০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে গতকাল ছুটির দিনেও সাড়ে তিন ঘণ্টা লেগেছে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী এক প্রাইভেটকারের চালক বলেন, কাঁচপুর সেতুতে উঠতে গিয়ে যানজট। সেতু পার হয়ে আবার যানজট। এরপর নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে আবার যানজট। সেখান থেকে রায়েরবাগে এসে আবার প্রায় এক ঘণ্টা যানজটে আটকে ছিলাম। ফ্লাইওভারে ওঠার পর ৫৫ মিনিট পেরিয়ে গেছে এখনও সায়েদাবাদ পার হতে পারিনি। সব মিলিয়ে ফ্লাইওভার অতিক্রম করে গুলিস্তান পর্যন্ত আসতে তার সাড়ে তিন ঘণ্টা লেগেছে। একই অবস্থা ঢাকার প্রবেশমুখ উত্তরা এবং গাবতলীতেও। কোথাও রাস্তা খালি নেই! শুধু যানজট আর যানজট! সকলের একই প্রশ্ন এতো রিকশা, এতো গাড়ি এতো মোটরসাইকেল কোত্থেকে এলো?

ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ খোকন বলেন, যানজটের প্রধান কারণ ব্যাটারিচালিত রিকশা। ট্রাফিক পুলিশের নির্লিপ্ততার সুযোগে ইতোমধ্যে ৮ লাখ ব্যাটারি রিকশা রাজধানীতে প্রবেশ করেছে। এছাড়া রাইড শেয়ারিংয়ের নামে প্রাইভেট কার ও মোটর সাইকেল চলছে প্রায় ১৫ লাখ। ঢাকার বাইরের সিএনজি অটোরিকশা চলছে প্রায় ২৫ হাজার, ফিটনেস ও রুটপারমিটবিহীন বাস ও মিনিবাস চলছে প্রায় এক হাজার, ভুয়া কাগজপত্রের লেগুনা চলছে প্রায় ৫ হাজার। তিনি বলেন, ব্যাটারি রিকশা প্রথমেই শহর থেকে বের করতে হবে। শুধু তাই নয়, এগুলোর খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধ করাসহ এসব তৈরির কারখানায় অভিযান চালাতে হবে। বিশেষ করে, কমলাপুর স্টেডিয়ামে ব্যাটারিচালিত রিকশার দোকানগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। হানিফ খোকন বলেন, ট্রাফিক পুলিশ সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর নামে যে অভিযান চালাচ্ছে সেগুলো লোক দেখানো। লাখ লাখ ব্যাটারি রিকশার মধ্যে তারা এক দিনে ৩০/৪০টি আটক করছে, এটা রাজধানীবাসীর সাথে উপহাস ছাড়া কিছুই নয়।

উল্লেখ্য, গতকাল শনিবার ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানিয়েছেন, গত শুক্রবার ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করায় ডিএমপিতে ৮৩৮টি মামলা এবং ৩৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

আরও পড়তে পারেন-

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির আহ্বায়ক সাইফুল আলমের মতে, বিগত সরকারের আমলেই পরিবহন সেক্টরে বিশৃঙ্খলা ছিল, এখন তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বর্ষার কারণে নগরীর অনেক এলাকার রাস্তা ভেঙে গেছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি টিকাটুলি এলাকার রাস্তার বেহাল দশার কথা তুলে ধরে বলেন, ইনকিলাব মোড় থেকে ফ্লাইওভারে উঠতে গিয়ে ভাঙ্গাচোরা রাস্তার কারণে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে যেটা পিক আওয়ারে মতিঝিল ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এর দায় সিটি কর্পোরেশনের। তারা রাস্তাগুলো চলাচলের উপযোগী করলে এমন অবস্থা হতো না। যাত্রাবাড়ী আড়তের সামনের চিত্র বর্ণনা করে তিনি বলেন, সেখানে ভোরে রাস্তার উপর মাছের বাজার বসে। এতে গাড়ি চলাচল করতে পারে না। এর জেরে ভোর থেকেই যানজটের সৃষ্টি হয়। যা পিক আওয়ারে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির এই নেতা স্বীকার করেন যে, বাস চালকরা কোনো নিয়ম না মেনে যেখানে সেখানে বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করায়। যে কারণেও যানজটের সৃষ্টি হয়। তবে তিনি বলেন, আমরা আগামী সপ্তাহ থেকে আমাদের ৪-৫শ’ পরিবহন শ্রমিক ট্রাফিক পুলিশকে সহায়তার জন্য কমিউনিটি পুলিশ হিসেবে কাজ করবে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, আমরা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছি। এর পেছনে পরাজিত শক্তির ইন্ধন থাকতে পারে। বিশেষ করে, লাখ লাখ ব্যাটারি রিকশা কোত্থেকে এলো, কারা আনলো, তাদের উদ্দেশ্য কী সেটা ভাবার সময় এসে গেছে। আশা করি, সরকার বিষয়টিকে হালকা করে না দেখে সিরিয়াসলি দেখবে। রোড ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন বোর্ডের নির্লিপ্ততার সমালোচনা করে সাইফুল আলম বলেন, আগে ডিএমপি কমিশনারের নেতৃত্বে প্রতিমাসে মিটিং হতো। কিন্তু দক্ষিণ সিটির মেয়র তাপস সেটি বন্ধ রেখেছিল। আমি মনে করি, প্রতিমাসে মিটিং করে সব ধরনের যানবাহন চলাচলে একটা সমন্বয় আনা জরুরি।

এদিকে, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করলেও বাড়তি এসব যান চলাচলের জন্য কোনো নিয়মনীতি বা শৃঙ্খলার ব্যবস্থা করা হয়নি। আরামবাগ, মতিঝিল এবং গুলিস্তান থেকেও এক্সপ্রেসওয়ের গাড়ি ছাড়ে, আবার যাত্রাবাড়ী, ধোলাইপাড় থেকেও ছাড়ে। এসব গাড়ি ফেরার সময় একেক গন্তব্য হওয়ায় যানজটের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে সারা রাজধানীতে ফুটপাত দখল, রাস্তার উপর দোকানপাট, বাস কাউন্টারসহ টার্মিনালগুলোতে কোনো নিয়ম নীতি না থাকার কারণেও যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানীর যানজটের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১ লাখ ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা, যা দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৯ শতাংশ। কমছে মাথাপিছু আয়। এতে প্রবৃদ্ধি কমছে ৩ শতাংশের বেশি। দারিদ্র্য বিমোচনের হারও কমছে আড়াই শতাংশের কাছাকাছি। যানজটের কারণে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সেই হিসাব যোগ করলে লোকসানের পরিমাণ আরও বাড়বে। দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা গ্রাস করছে যানজট।

উম্মাহ২৪ডটকম: আইএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।