Home ওপিনিয়ন ফরহাদ মজহার ও আমি: তর্কটা কোথায়?

ফরহাদ মজহার ও আমি: তর্কটা কোথায়?

।। মূসা আল হাফিজ ।।

ফরহাদ মজহার বুদ্ধিজীবী হিসেবে অনন্য, এটা নতুন করে বলার নয়। বরেণ্য কবি, চিন্তক , ভাবসাধক তিনি। তাঁর সাথে আমার সুসম্পর্ক অনেকেরই জানা। একটি বই আমি তাঁকে উত্সর্গ করি। সেখানে নিবেদনের ভাষা ছিলো -ঘর ডাকে ঘরে আয়!

তিনিও তাঁর ঐকান্তিক শুভেচ্ছা দিয়ে আমার বই নিয়ে লিখেছেন । যা প্রকাশিত হয়েছে মাসিক অন্য দিগন্তে, ২০১৮ সালে।

তাঁর সাথে আমার তর্ক আছে , জিঘাংসা নেই। তাঁর জ্ঞান-গরিমার প্রতি শ্রদ্ধাকে লুকাতে চাইনি কখনো। কিন্তু ইসলামপ্রশ্নে তার বোঝাপড়ার সাথে আমার ভিন্নমত কখনো গোপন করিনি। আজ তিনি এক পোস্ট করেছেন। সেখানে আমার কমেন্ট ছিলো –

আপনি বললেন- লালনের সঙ্গে প্রথাগত ইসলামের কোনই সম্পর্ক নাই। কথা হলো -লালনের সঙ্গে কোন ইসলামের সম্পর্ক? ইসলাম একটাই । যা আল্লাহ পাক নাযিল করেছেন এবং মুহাম্মদ সা. এর জীবন ও শিক্ষায় প্রতিফলিত। এর মূল বিশ্বাস ও আচরণীয় আ‘মাল সমূহ রয়েছে। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে যে কোন ধারার মুসলমান এই বিশ্বাস ও আমালে এক। ফলে মৌলিক জায়গায় ইসলামের আরব রূপ, ভারতীয় রূপ, বাঙালি রূপ বলে কিছু নেই। এগুলো খাড়া করেন কিছু মতলবী মানুষ। নিজেদের যথেচ্ছ ব্যাখ্যার স্পেস তৈরীর জন্য।

ইসলামের পালনে যে সব ফিকহি ধারা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতে অনুমোদিত, তা ইসলামের দেশীয় ও আঞ্চলিক রূপ নয়। এগুলো সরাসরি কুরআন -সুন্নাহ থেকে নির্গত। আকিদার প্রশ্নেও একই কথা। কুরআন-সুন্নাহের বাইরে গিয়ে কিংবা একে বুঝা ও ব্যাখ্যার উসূলকে পরিহার করে কেউ যদি এই ইসলাম, সেই ইসলাম খাড়া করতে চান ভাষার মারপ্যাচে, ইসলামের বিচারে সেগুলো ডাস্টবিনের জিনিশ।

ইসলামের মৌলিক কোনো বিষয়কে বাদ দিয়ে ইসলাম হয় না। নমুনা দিই। কোনো মুসলমানই আখেরাতে বিশ্বাস বাদ দিয়ে মুসলমান হতে পারেন না। এখন আপনি বলেন, লালন কি আখেরাতে বিশ্বাস করতেন? জান্নাত -জাহান্নামে? যে বিশ্বাস কুরআন ও সুন্নাহে প্রতিফলিত। এ প্রশ্ন করলাম না যে, আপনি কি আখেরাতে বিশ্বাস করেন?

আপনি নদিয়ার ভাবান্দোলনের ব্যাখ্যাতা ও এর প্রচারক। আপনি নিজেই লিখেছেন ‘ নদিয়া মনে করে না, মৃত্যুর পর আলাদা কোন জগত বা ‘পরকাল’ আছে। ফলে সাধক ‘অমর’ হতে পারে ইহলোকে তার কর্মের দ্বারা।‘ (গৌরপূর্ণিমা ও ফকির লালন সাঁই – ফরহাদ মজহার, প্রতিপক্ষ.৮ অক্টোবর, ২০২০)

এ জায়গায় ইসলাম কী বিশ্বাস করতে বলে সেটা বলি। ইসলাম বলে যারা মনে করে না মৃত্যুর পর আলাদা জগত বা পরকাল আছে, তারা মুসলমান হতে পারে না। এখানে একজন নদিয়াকে বিশ্বাস করবেন না ইসলামকে? যে প্রশ্নটা করেছি, ঠিক সেটার জবাব চাই ।

ফরহাদ মজহার জবাবে লিখেন- “দয়া করে অনর্থক তর্ক করবেন না, এখান ইসলাম নিয়ে তর্ক হচ্ছে না।”

১. জ্বি। ঠিক ধরেছেন। আমি বলেছি যারা জাতিবাদী ইসলাম চর্চা করেন অর্থাৎ ধর্মকে জাতিবাদী পরিচয়ের বর্ম হিশাবে ব্যবহার করেন এবং মানুষের সস্তা সমর্থন পাওয়ার জন্য ইসলামের কথা বলেন সেই ইসলাম, কিম্বা ইসলাম সম্পর্কে আমাদের যে সকল প্রথাবদ্ধ অনুমান ও ধারণা — লালন তার ধারে কাছেও নাই।

লালন আরব, ইরান, তুরান বা আফগানি ইসলাম বাংলাদেশে আমদানি করেন নি। করার কোন ইচ্ছাও তাঁর ছিল না। তিনি সুনির্দিষ্ট ভাবে নিজেকে নদীয়ার ফকির বলেছেন। এতে আপনার কি সমস্যা?

এরপরও খামাখা কেন তর্ক করছেন? লালন মুসলমানদের জন্য ইসলামের কোন নতুন ব্যাখ্যা বা সংস্কার করতে আসেন নি। তিনি রাসুলের আশেকান, কোন প্রকার শর্ত ছাড়া তিনি নিজেকে পরওয়ারদিগারের কাছে সঁপে দিয়েছেন। কারো কাছে ধর্মের সার্টিফিকেট কিম্বা জান্নাতের টিকিট চান নি। লালন একান্তই ভাবুকদের পথ, যারা সকল প্রকার পরিচয়বাদের উর্ধে উঠতে পেরেছেন। সকলের জন্য না। তারপরও কেন জিজ্ঞাসা করেন ‘লালনের সঙ্গে কোন্‌ ইসলামের সম্পর্ক?’ আপনার ইসলাম, আপনার বিশ্বাস, আপনার আকিদা নিয়ে আপনি থাকুন। অসুবিধা কি?

২. দেখুন তর্ক হচ্ছে “লালনীয় সহজিয়া মরমিয়া ইসলাম” নামক বিচিত্র কোন জিনিস লালনে আছে কিনা। না নাই। সে সম্পর্কে কিছুই বললেন না। তো সেই প্রশ্ন থুয়ে এখন এখানে ইসলামের তর্ক তোলা অনর্থক ও কুতর্ক। আপনি যে ইসলামকে ছহি মনে করেন, সেটা করুন। ইসলাম নানান ভাগে, নানান ফিরকায়, নানান মজহাবে বিভক্ত। প্রত্যকে মনে করে তারাই ছহি। এই তর্কের বোঝা লালন এবং লালন অনুরাগীরা বহন করতে চায় না। গায়ের জোরে প্রত্যেকেই দাবি করে তাদের ব্যাখ্যাই ইসলামের একমাত্র ব্যাখ্যা। ‘মূল বিশ্বাস ও আচরনীয় আমল’ – আপনি মুসলমান ও ভাই-বেরাদরদের বোঝান। তাঁরা কথায় কথায় একজন আরেজনকে কাফের বলে পুলক বোধ করে। “এই ইসলাম, সেই ইসলাম” মুসলমানরাই করে।

৩. জ্বি আমি লিখেছি ‘ নদিয়া মনে করে না, মৃত্যুর পর আলাদা কোন জগত বা ‘পরকাল’ আছে। (গৌরপূর্ণিমা ও ফকির লালন সাঁই – ফরহাদ মজহার, প্রতিপক্ষ.৮ অক্টোবর, ২০২০) । কেন করে না সেটাও ব্যাখ্যা করেছি”

মরলে গুরু শিষ্যের একই আত্মা
তাই হয়ে যায় পরমাত্মা
তোমার আমার একই কর্তা
তুমি আমায় পারে লবে, ইত্যাদি।

অর্থাৎ মৃত্যুর পর সাধক তাঁর ভক্তের হৃদয়ে গুরু-শিষ্য পরম্পরার ধারা ও চর্চার মধ্যে বেঁচে থাকেন। এই অর্থে সাধক সবসময় ‘অমর’। গুরু-শিষ্য পরম্পরা একটা রুহানি স্রোতের মতো, যারা সে স্রোতে ডুবতে জানে, তারা ফকিরদের মর্ম বুঝবে। তাঁদের দোজখের ভয় নাই, বেহেশতের লোভ নাই। কোন ইহলৌকিক আকাঙ্ক্ষা নাই। তাঁরা নিজেদের ‘জ্যান্তে-মরা’ বলে থাকেন। এই পথ তো মূর্খদের জন্য না।

তাহলে তর্কটা কিসের? কোন লালন অনুরাগী গিয়ে কি আপনার হাতে পায়ে ধরেছে যে ভাই আমাকে মুসলমান বানিয়ে দিন?” ।

ঔদ্ধত্যটুকু দেখুন, Musa Al Hafij লিখেছেন, “এ জায়গায় ইসলাম কী বিশ্বাস করতে বলে সেটা বলি। ইসলাম বলে যারা মনে করে না মৃত্যুর পর আলাদা জগত বা পরকাল আছে, তারা মুসলমান হতে পারে না। আপনি নদিয়াকে বিশ্বাস করেন না ইসলামকে? যে প্রশ্নটা করেছি, ঠিক সেটার জবাব চাই” ।

ভাবখানা এরকম ইনি আল্লার আরশে খোদ আল্লাহ হয়ে বসে আছেন কে মুসলমান আর কে মুসলমান না ইনি নির্ধারিত করে দেবেন। ভাবখানা এই রকম এই দায়িত্ব তিনি আল্লাহর কাছ থাকে প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনিই ইসলামের একমাত্র মহা পরাক্রমশালী পাহারাদার! এই যে ঔদ্ধত্য এবং রংবাজি — এদের সংখ্যা দেখবেন চারপাশে।

নদীয়া নদীয়ার ভাবের জায়গা থকে রাসুলকে বুঝেছে, আল্লাহকে বুঝেছে। ভাল্বেসেছে। সর্স্ব ত্যাগ করেছে। আমরা মানতে পারি, শুনতে পারি, দূরে থাকতে পারি, অস্বীকার করতে পারি, ইত্যাদি। অসুবিধা নাই। নদীয়ার বিচার যাঁর করবার তিনি করবেন। কিন্তু মুসা আল হাফিজ নিজেই বিচার করতে বসে গিয়েছেন!

বুঝুন এদের ইসলাম বোঝার দৌড়।

আমার জবাব-

আপনি রেগে যাচ্ছেন, উত্তেজিত হচ্ছেন ফরহাদ ভাই। আলাপের জন্য যা সুবিধাজনক নয়।

আপনার শেষ থেকেই শুরু করি। আমি বলেছি, ইসলাম বলে যারা মনে করে না মৃত্যুর পর আলাদা জগত বা পরকাল আছে, তারা মুসলমান হতে পারে না। আপনার বয়ানে নদীয়া যেহেতু মৃত্যুর পর আলাদা কোন জগত বা ‘পরকাল’ বিশ্বাস করে না, আর ইসলামে পরকাল বিশ্বাস মুসলিম হবার শর্ত, তাই আপনি এ জায়গায় নদীয়াকে বিশ্বাস করেন না ইসলামকে, এ প্রশ্ন সঙ্গতকারণেই জন্ম নেবে। জিজ্ঞাসাকে আপনি ঔদ্ধত্য বলতে পারলেন? আপনি একজন বুদ্ধিজীবী ও ভাবুক। আপনার থেকে এটা আশা করিনি। আপনার ঔদ্ধত্য বলায় জিজ্ঞাসাটি মরে গেলো না, সে আরো সবলেই আপনাকে প্রশ্ন করছে, কী আপনার বিশ্বাস?

দ্বিতীয় কথা হলো, পরকাল বিশ্বাস না থাকলে মুসলমান হওয়া যাবে না, এই বক্তব্যের উপর আপনি প্রতিক্রিয়া জানালেন এই ভাষায়- Ôভাবখানা এরকম ইনি আল্লার আরশে খোদ আল্লাহ হয়ে বসে আছেন কে মুসলমান আর কে মুসলমান না ইনি নির্ধারিত করে দেবেন। ভাবখানা এই রকম এই দায়িত্ব তিনি আল্লাহর কাছ থাকে প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনিই ইসলামের একমাত্র মহা পরাক্রমশালী পাহারাদার!Õ

হাসলাম পড়তে পড়তে। এই মুখস্ত ডায়লগ দিয়ে কতদূর যাবেন? ফরহাদ ভাই! যারাই মুসলমান হন, তাওহিদ ও রেসালতের পরে আখেরাতে বিশ্বাস ঘোষণা করেই মুসলমান হন। এটাই আল কুরআনের স্পষ্ট বার্তা, হাদীসের স্পষ্ট ঘোষণা। এ কোনো বিতর্কিত বিষয় নয়। এ বিশ্বাসের উপরই ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি ইসলামের বুনিয়াদী ভিত্তিকে উল্লেখ করেছি মাত্র। আপনি একে রংবাজি বলতে পারেন না।

আখেরাত বিশ্বাস না করলে কেউ মুসলমান হতে পারবে না, এই কথাটা ইসলামের মৌলিক এক সত্য। এর উচ্চারণকে ঔদ্ধত্য ও রংবাজি আখ্যাদানের মধ্যে আপনি নিজের মানসিকতার কোন দিকটি প্রকাশ করলেন, বুঝা কষ্টকর নয়।

(পরে আপনি রিপ্লাই এডিটিং করেছেন। ভাষাটাকে কিছুটা বদলিয়েছেন। সেখানে বলেছেন – নদীয়ার বিচার যাঁর করবার তিনি করবেন। কিন্তু মুসা আল হাফিজ নিজেই বিচার করতে বসে গিয়েছেন! খুব ভালো। আমি নদীয়ার বিচার করছি না। আপনার বয়ান দিয়েই আপনাকে প্রশ্ন করছি মাত্র। কিন্তু কথা হলো নদীয়ার বিচারকে আপনি মুসা আল হাফিজের হাতে তুলে দিতে চান না। তাহলে ইসলামের বিচার আপনার হাতে তুলে দিতে হবে কেন? আপনি বলছেন নদয়ার বিচার যাঁর করবার, সে করবে। একই কথা যখন বলছি ইসলামের বেলায়, তখন আপনি বলছেন মুসা আল হাফিজ খোদা হতে চাইছেন! ভারি কৌতুক! )

এক. লালন নিজেকে নদীয়ার ফকির বলেছেন, এতে আমার সমস্যা নেই। সমস্যা হলো, আপনি যখন বলেন লালনের সঙ্গে প্রথাগত ইসলামের কোনই সম্পর্ক নাই। তখনই আমাকে প্রশ্ন করতে হয় -লালনের সঙ্গে কোন ইসলামের সম্পর্ক? আপনি এ প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না। আপনার বহুল উচ্চারিত কথার পুণরাবৃত্তি করলেন মাত্র।

বললেন – Ôযারা জাতিবাদী ইসলাম চর্চা করেন অর্থাৎ ধর্মকে জাতিবাদী পরিচয়ের বর্ম হিশাবে ব্যবহার করেন এবং মানুষের সস্তা সমর্থন পাওয়ার জন্য ইসলামের কথা বলেন সেই ইসলাম, কিম্বা ইসলাম সম্পর্কে আমাদের যে সকল প্রথাবদ্ধ অনুমান ও ধারণা — লালন তার ধারে কাছেও নাই। লালন আরব, ইরান, তুরান বা আফগানি ইসলাম বাংলাদেশে আমদানি করেন নি। করার কোন ইচ্ছাও তাঁর ছিল না।Õ

ফলে এ প্রশ্ন থেকেই গেলো যে, লালন যদি আরব, ইরান, তুরান বা আফগানি ইসলাম বাংলাদেশে আমদানি না করেন, তাহলে যে ইসলাম তিনি অবলম্বন করলেন, সেটা কোন ইসলাম? হযরত মুহাম্মদ সা. আনীত ও প্রদর্শিত ইসলামের সাথে এর কী সম্পর্ক? সে ইসলাম কি মহানবী সা. এর শেখানো ঈমানের মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত?

যদি আপনার জবাব হয়, হ্যাঁ, তাহলে আপনি দেখাবেন সেটা কীভাবে প্রতিষ্ঠিত? যদি আপনার জবাব হয় না, তাহলে লালনের সাথে ইসলামের সম্পর্ক বলে যে দাবি করলেন, সেটা ভুল প্রমাণিত হবে।

দুই . নদীয়ার ফকির কথা দিয়ে লালন প্রমুখকে বুঝা ও বুঝানোর যে চেষ্টা, তার স্বরূপ আমার কাছে অস্পষ্ট নয়। সহজ করে দিয়েছেন আপনি নিজেই। আপনি লিখেছেন Ôনদিয়ার প্রথম ফকির শ্রীগৌরাঙ্গের আবির্ভাব তিথি উদযাপন করবার আনন্দ হিসাবে দিনটির গুরুত্ব ছেঁউড়িয়ায় অপরিসীম।Õ(গৌরপূর্ণিমা ও ফকির লালন সাঁই – ফরহাদ মজহার, প্রতিপক্ষ.৮ অক্টোবর, ২০২০) ।

আরও পড়তে পারেন-

হিন্দুধর্মের অবতার ও পূজ্য মহাত্মা গৌরাঙ্গ যে নদীয়ার প্রথম ফকির, নদীয়ায় যে ফকিরির প্রথম দিশারী তিনি, সেখানে এই ফকির ও ফকিরী ইসলামের তাসাউফ বা রুহানিয়্যতের সাথে সঙ্গতিহীন।

আপনি লিখেছেন – গৌরাঙ্গ আসলে পুরানের শ্রীকৃষ্ণ, নদিয়ায় তিনি মানুষের রূপ নিয়ে মনুষ্য লীলা করে গিয়েছেন। নদিয়ায় কৃষ্ণই গৌরাঙ্গ, কিম্বা গৌরাঙ্গই কৃষ্ণ। তিনি তাই অবতার।(গৌরপূর্ণিমা ও ফকির লালন সাঁই – ফরহাদ মজহার, প্রতিপক্ষ.৮ অক্টোবর, ২০২০)

লালনের কাছে ফকিরী আসলে কী? আপনি জানাচ্ছেন – ফকির লালন শাহ চৈতন্যকে ‘ফকির’ হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, এটাই বিশেষ ভাবে খেয়াল করবার বিষয়। অর্থাৎ নিমাইয়ের সন্যাস গ্রহণ ও ‘কৃষ্ণচৈতন্য’ নাম গ্রহণ লালনের কাছে ‘ফকিরী’। (গৌরপূর্ণিমা ও ফকির লালন সাঁই – ফরহাদ মজহার, প্রতিপক্ষ.৮ অক্টোবর, ২০২০)

নদীয়ার সাধকরা এ ধারায় কী করেছেন পরবর্তীতে?

আপনি জানাচ্ছেন – নদিয়ার ফকিরগণ তাঁদের জীবনচর্চা ও ভাবচর্চার মধ্য দিয়ে পরবর্তীতে গৌরাঙ্গের তাৎপর্য গৌরতত্ত্বে আরও বিকশিত করেছেন এবং গৌরকে নতুন তাৎপর্যে নদিয়ায় কায়েম করেছেন।(গৌরপূর্ণিমা ও ফকির লালন সাঁই – ফরহাদ মজহার, প্রতিপক্ষ.৮ অক্টোবর, ২০২০)

ওয়েল। গৌরাঙ্গের তাৎপর্য গৌরতত্ত্বে আরো বিকশিত হবার যে ফকিরি, একে যতক্ষণ ইসলামের সাথে জড়ানো হবে, ততক্ষণ ইসলাম নিজেই আপত্তি করবে আপন নীতিমালার আলোকে।

এর সাথে ইসলামকে জড়ানোর চেষ্টা না করলে আপনার সাথে তর্ক আর থাকে না।

তিন. আপনি লিখেছেন – “ইসলাম নানান ভাগে, নানান ফিরকায়, নানান মজহাবে বিভক্ত। প্রত্যকে মনে করে মনে করে তারাই ছহি। এই তর্কের বোঝা লালন এবং লালন অনুরাগীরা বহন করতে চায় না। গায়ের জোরে প্রত্যকেই দাবি করে তাদের ব্যাখ্যাই ইসলামের একমাত্র ব্যাখ্যা। ‘মূল বিশ্বাস ও আচরনীয় আমল’ – আপনি মুসলমান ও ভাই-বেরাদরদের বোঝান। তাঁরা কথায় একজন আরেজনকে কাফের বলে পুলক বোধ করে। “এই ইসলাম, সেই ইসলাম” মুসলমানরাই করে।”

খুবই সরলিকরণ হয়ে গেলো। Ôগায়ের জোরে প্রত্যকেই দাবি করে তাদের ব্যাখ্যাই ইসলামের একমাত্র ব্যাখ্যা।Õ মাঠে -ময়দানে যারা ওয়াজের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করেন, তাদের কথাবার্তা থেকে ইসলামকে বুঝতে গেলে এমনই হয়। ইসলামের স্বীকৃত কোনো মজহবই নিজেদের ব্যাখ্যাকে ইসলামের একমাত্র ব্যাখ্যা বলে দাবি করে না। হানাফি-শাফেয়ি-মালেকী-হাম্বলি কিংবা সালাফি; কেউই তা করেননি। প্রত্যেক ধারার ফকিহ -মুজতাহিদগণ অন্যান্য ইজতেহাদকে শ্রদ্ধা করেছেন। আকিদার ক্ষেত্রে সালাফি-আশআরী-মাতুরিদীদের ব্যাপারও একই। প্রত্যেক ধারাকেই হক মনে করা হয়। কারণ সেগুলোর পেছনে কুরআন-হাদীসের প্রমাণাদি রয়েছে। বাড়াবাড়ি যারা করেছেন, উসুলে এখতেলাফ বা মতভিন্নতার মূলনীতি সেসব বাড়াবাড়িকে প্রত্যাখান করেছে।

আপনি যে নদীয়ার ভাবান্দোলনের কথা বলেন, সেখানে কি বিভিন্ন ধারা নেই? আপনি লিখেছেন – ‘নদিয়ার ভাব’ কথাটা ফকির লালন শাহের; তিনি সহ নদিয়ার আরও চারটি ‘ঘর’ এই ভাব চর্চা করতেন বলে ‘নদিয়ার ভাব’ কথাটার অর্থ দাঁড়িয়েছে লালনসহ নদিয়ার পাঁচটি ঘরের সাধনার ধারা এবং সেই সাধনার ধারার মধ্যে বিভিন্ন ‘ভাব’ বা দার্শনিক বিষয়াদির বিচার। এই পাঁচঘরের সাধুসন্তরাই এই বিচারের ঐতিহ্য গড়ে তুলেছেন ও টিকিয়ে রেখেছেন। তাঁদের সকলের ‘ভাব’ বা চর্চা একই রকম ছিল এটা অনুমান করারা কোন কারন নাই। নদিয়ার ভাবচর্চার নিজস্ব ভাষা ও পরিভাষা আছে, যাঁরা নদিয়ার ভাবের সাধনা করেন তাঁদের কাছে সেই ভাষা ও পরিভাষা পরিচিত।

… এরা সকলেই ফকির লালনের কমবেশী সমসাময়িক এবং সাধন ভজন ও তত্ত্বচর্চার দিক থেকে সকলেই ফকির লালনের মতোই সমান মাত্রার গুরুত্বপূর্ণ। লালনপন্থি ফকিরদের ভাষায় এরা ‘গদিমান্য’। অর্থাৎ নদিয়ার ভাবচর্চায় তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য, লালন এঁদের কাছে ঋণী। (গৌরপূর্ণিমা ও ফকির লালন সাঁই – ফরহাদ মজহার, প্রতিপক্ষ.৮ অক্টোবর, ২০২০)

এর মানে পরিষ্কার। অনেকগুলো ধারা তৈরী হয়েছে কেবল নদীয়ায়। আর আপনি বলছেন প্রত্যেকেই গদ্যিমান্য। নদিয়ার ফকিরি এই কয়দিন আগের বিষয়। এর অনুসারিদের পরিসরও তেমন বড় নয়। সেখানে তৈরী হয়েছে এতগুলো ধারা! ইসলামী আকিদা ও ফিকহের অনেকগুলো ধারা তৈরী হবে, এটা নিশ্চিত হয়ে যায় ইসলামের প্রথম যুগেই। সাহাবাদের মধ্যেও ভিন্নমত ছিলো কুরআন-হাদীস অনুসরণের নানা প্রসঙ্গে। সেসব ভিন্নমত নবীজী কর্তৃক সমর্থিত। এসব থেকে দাঁড়িয়েছে ভিন্নমতের মূলনীতি।

এই নীতির আলোকে কুরআন-সুন্নাহের প্রমাণাদির আওতায় ইসলাম চর্চায় যেসব স্বীকৃত ধারা তৈরী হয়েছে, সেসব ধারা পরস্পরকে কাফির বলবে, এই অনুমোদন ইসলামে নেই। কিন্তু কুরআন-সুন্নাহকে উল্লঙ্ঘন করে শিরকের সাথে ইসলামকে মিশিয়ে যে কোনো জগাখিচুড়িকে প্রত্যাখান করার নীতিমালা সরাসরি কুরআন-হাদীস থেকেই এসেছে।

( আপনার বিবৃত এসব ধারায় সরাসরি শিরক এর চর্চা থাকলেও এবং লালনপন্থী ফকিরদের কাছে তারা গদ্যিমান্য হলেও ইসলামের বিচারে প্রতিটি শিরকই পরিত্যাজ্য।)

চার. আপনার ব্কতব্য – আমি লিখেছি ‘ নদিয়া মনে করে না, মৃত্যুর পর আলাদা কোন জগত বা ‘পরকাল’ আছে। কেন করে না সেটাও ব্যাখ্যা করেছি”

মরলে গুরু শিষ্যের একই আত্মা
তাই হয়ে যায় পরমাত্মা
তোমার আমার একই কর্তা
তুমি আমায় পারে লবে, ইত্যাদি।

অর্থাৎ মৃত্যুর পর সাধক তাঁর ভক্তের হৃদয়ে গুরু-শিষ্য পরম্পরার ধারা ও চর্চার মধ্যে বেঁচে থাকেন।

এই মূলকথার সাথে কিছুটা রহস্য তৈরী করলেন, এবং অস্পষ্টতা বিস্তার করে এর আড়ালে আশ্রয় নিতে চাইলেন যে, “গুরু-শিষ্য পরম্পরা একটা রুহানি স্রোতের মতো, যারা সে স্রোতে ডুবতে জানে, তারা ফকিরদের মর্ম বুঝবে। তাঁদের দোজখের ভয় নাই, বেহেশতের লোভ নাই। কোন ইহলৌকিক আকাঙ্ক্ষা নাই। তাঁরা নিজেদের ‘জ্যান্তে-মরা’ বলে থাকেন।”

কিন্তু আপনার মূলকথা হলো- মৃত্যুর পর সাধক তাঁর ভক্তের হৃদয়ে গুরু-শিষ্য পরম্পরার ধারা ও চর্চার মধ্যে বেঁচে থাকেন।

এটাই আপনাদের বিশ্বাস, আকিদা। জান্নাত-জাহান্নামকে অস্বীকার করার উপর পর্দা দেবার জন্য দোজখের ভয়, বেহেশতের লোভ ইত্যাদি কথাবার্তা আনা হলো মাত্র। আপনি নদীয়ার বিশ্বাসকে ব্যক্ত করেছেন এভাবে : সারা জীবন একজন মনের মতো শিষ্য পাবার জন্যই তাঁদের আকুতি প্রবল থাকে। কারন শিষ্যই গুরুকে ‘পার’ করে। নদিয়া মনে করে না, মৃত্যুর পর আলাদা কোন জগত বা ‘পরকাল’ আছে। ফলে সাধক ‘অমর’ হতে পারে ইহলোকে তার কর্মের দ্বারা। গুরুর কথা ও কাজ গুরু কর্তব্য হিসাবে শিরোধার্য করা এবং তা শিষ্যপরম্পরায় বয়ে নিয়ে যাবার মধ্যেই সাধকের সার্থকতা।(গৌরপূর্ণিমা ও ফকির লালন সাঁই – ফরহাদ মজহার, প্রতিপক্ষ.৮ অক্টোবর, ২০২০)

এর মানে যাহা লাউ, তাহা কদু। মৃত্যুর পরে আলাদা জগত বা পরকাল নেই। ভক্তের মধ্যে গুরু বেঁচে থাকেন। এ জন্য শিষ্যের তালাশ করতে হয় জীবনভর। পরকাল অস্বীকৃতির মধ্যেই থাকা হলো শেষঅবধি।

এটা আপনার বিশ্বাস। এটাই?

লেখক: বুদ্ধিজীবি, গবেষক ও কবি।

উম্মাহ২৪ডটকম: আইএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।