।। মো: এনামুল হক জীবন ।।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আরেকটি সফল গণ-অভ্যুত্থান সঙ্ঘটিত হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার দেশ পরিচালনা করছে। তবে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রেতাত্মারা প্রতিনিয়ত কোনো না কোনোভাবে জাতির মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি, সন্দেহ-সংশয় ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়ে আছে। বিগত ১৫ বছর আমরা স্বৈরাচারী সরকার কর্তৃক, স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষ-বিপক্ষ ও জঙ্গিবাদের নাটকের মাধ্যমে জাতিকে দ্বিধাবিভক্তির কাজ সার্বক্ষণিক চালিয়ে গেছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর কু-পরিকল্পনা মোতাবেক দেশের আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ শাসন বিভাগ এমনকি প্রতিরক্ষা বিভাগের তথা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ লেভেল থেকে সর্বনিম্ন লেভেল পর্যন্ত বাংলাদেশী মানুষের মনে-মগজে দ্বিধাবিভক্তি ও বিভ্রান্তির জাল পেতে রেখেছে!
আমি যদি উদাহরণস্বরূপ বলি, আমার বাসা রামপুরা বনশ্রীতে। আমার মেয়ের পাসপোর্ট নবায়নের জন্য আফতাবনগর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার পর ১১ বার যাওয়া আসা করে পাসপোর্ট উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি! বনশ্রী থেকে আফতাবনগর এক দিনে আমার আসা-যাওয়া হয়েছে আটবার! সর্বমোট ১১ বার যাওয়া-আসা করে পাসপোর্ট অফিস থেকে পাসপোর্ট নবায়ন করতে পারলেও উপরি বা ঘুষের টাকা দেয়া থেকে মুক্ত থাকতে পারিনি। বড় মেয়ের আইইএলটিএস পরীক্ষার আগে এনআইডি কপির জন্য আবেদন করলে, তারা বলে জাতীয় নির্বাচন শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত এনআইডি দেয়া বন্ধ আছে। পরে এক দালালের সাথে যোগাযোগ করলে সে বলে, আমাকে ১২ হাজার টাকা দেবেন আমি এটি ইশারায় করিয়ে দেবো। মেয়ের আইইএলটিএস শেষ করে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনে আমি ১২ হাজার টাকা দেয়ার পর দুই দিনের মধ্যেই এনআইডি আমাকে পৌঁছে দেয়! বিগত প্রায় ১৬ বছরের মধ্যে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে, পুলিশ বিভাগ, বিচার বিভাগে, শিক্ষা বিভাগে সব ক্ষেত্রে স্বৈরাচারী হাসিনা তার দলীয়করণের মাধ্যমে রন্ধ্রে রন্ধ্রে মেধাশূন্য, অথর্ব দলকানা এবং ইন্ডিয়ান ‘র’-এর লোক এত বেশি পরিমাণ নিয়োগ দিয়েছে যে, জাতি খুব সহজে এদের হয়রানি থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব।
গণবিপ্লবের পর ঘটিত সরকার তাই যত সহজে সব ক্ষেত্র থেকে মানুষকে সেবা দেয়ার চেষ্টা করছে তত সহজে কোনোটিই করে উঠতে পারছে না। কেননা ইন্ডিয়ান ‘র’ এবং শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া প্রেতাত্মারা বর্তমান বিপ্লবী সরকারকে এবং সামগ্রিকভাবে পুরো জাতিকে এক দিনের জন্যও চিন্তামুক্ত বা স্থির থাকতে দিতে রাজি নয়। ভারতীয় ‘র’-এর সহযোগী মিডিয়াগুলো, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, কালবেলা, ভোরের কাগজ ও স্বৈরাচারের দোসর ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ সার্বক্ষণিকভাবে ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে এবং একের পর এক ষড়যন্ত্রের ট্রাম্পকার্ড ফেলছে। কখনো সংখ্যালঘু কার্ড, কখনো আনসার কার্ড, কখনো পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের কার্ড, কখনো মব জাস্টিসের কর্মকাণ্ড করে পাশাপাশি প্রথম আলোসহ তাদের বিভিন্ন মিডিয়া দিয়ে প্রচার ও প্রসার ঘটিয়ে জাতির সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে, বিভ্রান্তি, মতদ্বৈততা, সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টির মাধ্যমে বিপ্লবী সরকারকে কোনো না কোনোভাবে ব্যর্থ প্রমাণের অপচেষ্টায় ও অপতৎপরতায় বিরতিহীনভাবে ক‚টকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে! মানুষ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সেবা পেতে অনেক বেশি বিড়ম্বনা ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। আসল উদ্দেশ্য হলো বিগত দিনে মানুষ যেভাবে হয়রানির শিকার হয়েছে স্বৈরাচারের পতনের পর তার প্রেতাত্মাদের দিয়ে মানুষকে যদি ওইভাবে হয়রানির মধ্যে রাখা যায় তা হলে বর্তমান সরকারের প্রতি মানুষের বিরূপ মনোভাব তৈরি করা সম্ভব।
আরও পড়তে পারেন-
- ইবাদতের গুরুত্ব নিয়ে ঠাট্টা-তাচ্ছিল্য জঘন্য গুনাহ
- উগ্র হিন্দুত্ববাদ এবং মুসলিমবিদ্বেষ ভারত ও বাংলাদেশের জন্য হুমকি
- ‘ইবাদুর রাহমান’ বা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বিশেষ ১২টি গুণ
- মৃত্যুর স্মরণ জীবনের গতিপথ বদলে দেয়
- যে কারণে হিন্দুত্ববাদের নতুন নিশানা ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’
তাই বিপ্লবী সরকারকে আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই যে, অসংখ্য মানুষ আহত হয়ে, পঙ্গু হয়ে, অন্ধ হয়ে, বিধবা হয়ে, সন্তান হারিয়ে, রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে সর্বদলীয় ঐকের ম্যান্ডেট দিয়ে আপনাদেরকে ক্ষমতায় বসিয়েছে এ জন্য যে, সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে বিগত দিনের স্বৈরাচারের দোসর ও প্রেতাত্মাদের খুঁজে খুঁজে বের করবেন এবং এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করবেন যে, তারা বিপ্লবী সরকারকে যাতে কোনো রকম অস্থিরতায় ফেলার দুঃসাহস না পায়। যারা বিপ্লবী সরকারের বিভিন্ন দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্নভাবে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার অবকাশ পাচ্ছে তারা কিন্তু দেশ-বিদেশে আস্তে আস্তে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টায় লিপ্ত আছে এবং যেকোনো সময় বিপ্লবী সরকারকে ব্যর্থ করতে ওঁৎ পেতে থাকছে। তাই স্বৈরাচারের প্রেতাত্মাদেরকে যত তাড়াতাড়ি সমূলে উৎপাটিত করতে পারবেন, তত তাড়াতাড়ি সংস্কারের কাজ করতে পারবেন নির্বিঘ্নে, আর না হলে কোনোভাবে শান্তি দিবে না তারা আপনাদেরকে। এক দিকে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে নিয়োজিত লোকদেরকে পরিপূর্ণরূপে কাজে নামানো জরুরি, অন্য দিকে মব জাস্টিসের মতো অঘটন ঘটন পটিয়সীদের ধরপাকড় করত উপযুক্ত শাস্তি কার্যকর করা, বিগত দিনের অশান্তি সৃষ্টিকারী ও লোপাটকারী চোর, বাটপাড়, লুণ্ঠনকারী ও দুর্বৃত্তদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সময়ের অপরিহার্য দাবি। স্বৈরাচারের দোসররা সরকারের বিভিন্ন স্তরে এভাবে ঘাপটি মেরে বসে আছে এবং সুযোগের সন্ধান করছে যে, তাদেরকে শায়েস্তা করা বা সমূলে উৎপাদন করা একান্ত অপরিহার্য। গোয়েন্দা বিভাগের বিভিন্ন শাখায় নির্ভরযোগ্য লোকদেরকে দায়িত্ব দিয়ে ঘাপটি মেরে থাকা লোকদের খুঁজে বের করা, চাকরিচ্যুত করা, বিচারের মুখোমুখি করা যাতে সহজ হয়, বিগত দিনে সৎ ও দক্ষ পুলিশ ও সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা বিভাগের ক্ষতিগ্রস্ত ও বঞ্চিত কর্মকর্তাদেরকে এনে কাজে লাগালেও অনেকটা সহজ হবে বলে ধারণা করি। যারা বিগত দিনে ঘুষ, দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত না হওয়ার কারণে, বিভিন্ন জায়গায় কোণঠাসা অবস্থায় ছিল, পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত ছিল এবং চাকরিও হারিয়েছে বা ওএসডি হয়েছে, তাদের মতো কিছু সৎ ও যোগ্য লোককে এখনো স্বৈরাচারের দোসররা তাদের বেষ্টনীতে বিভিন্ন জায়গায় কোণঠাসা অবস্থায় রেখেছে! আর দুর্নীতিবাজ এবং সব ঘাপটি মেরে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেদের মধ্যে ঐক্য রেখে চলছে এবং সরকারকে বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে!
একেবারে তরতাজা উদাহরণটি হলো শেখ হাসিনার দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত গোপালি মাওলানা রুহুল আমিন শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে মসজিদে আর খতিবগিরি করতে আসেন না, বারবার তাগাদা দেয়ার পরও সে গোপালগঞ্জে বসে থেকে কু-পরিকল্পনা আঁটে আর অতিসম্প্রতি এক শুক্রবারে বাসভর্তি করে গোপালগঞ্জের লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে আসেন এবং বায়তুল মোকাররমের মুসল্লিদের সাথে মারামারি ও হট্টগোলের তুলকালাম ঘটিয়ে দেন! এত দিন পর্যন্ত তিনি অনুপস্থিত থাকার পরে, সরকারি নোটিশের কোনো তোয়াক্কা না করে পালিয়ে থাকলেন, অপকর্মের কারণে তিনি গ্রেফতার হওয়ার কথা, জেলখানায় থাকার কথা অথচ সরকারের যথাসময়ে অ্যাকশন না নেয়ায় সে সুযোগের সদ্ব্যবহারে লিপ্ত হয়েছেন এবং বায়তুল মোকাররমে যে কাণ্ড ঘটিয়েছেন তা আমাদের দেশ জাতির জন্য এক কলঙ্কজনক ঘটনা। জাতীয় মসজিদের মতো মর্যাদাপূর্ণ একটি জায়গায় খতিব নামক কলঙ্কিত রুহুল আমিন গং আমাদের দেশ ও জাতিকে সারা পৃথিবীর কাছে হেয় প্রতিপন্ন করলেন। এভাবে অপরাধীগুলোকে আশকারা দিলে তারা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশ্বজোড়া যে খ্যাতি রয়েছে এবং তার নেতৃত্বে গঠিত সরকারের বিশ্বের কাছে যে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, সেটিকে ধূলিস্যাৎ করে দিবে। তাই বিপ্লবী সরকারকে অবিলম্বে স্বৈরাচারের প্রেতাত্মাদেরকে সমূলে উৎপাটন করতে দেরি করলে বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে ; আমরা এটি হতে দিতে পারি না, আমাদের এখনই হুঁশ ফিরে আসা জরুরি; সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়।
উম্মাহ২৪ডটকম: আইএ