Home ইতিহাস ও জীবনী মুকুটহীন সম্রাট ইমাম আযম ইমাম আবু হানিফা (রহ.)

মুকুটহীন সম্রাট ইমাম আযম ইমাম আবু হানিফা (রহ.)

।। মুহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম সাদি ।।

‌জ্ঞান গভীর অতলান্ত পদ্ম, ইলম, আমল এবং অধ্যাবসায়ের আকাশের অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র ইমাম আবু হানীফা রহ. আমাদের গর্ব ও গৌরবের প্রতীক। আখলাকে নববীর মিছালি ও বাস্তব নমুনা। জ্ঞানের আকাশে ভূবন আলোকিত করা পূর্ণিমার স্নিগ্ধ চাঁদ। কূলহীন জ্ঞানসমুদ্র। তাঁর অসাধারণ জ্ঞান, অপরিমেয় প্রজ্ঞা এবং বিপুল বিশাল প্রতিভার ছবি আঁকা আমাদের মত ক্ষুদ্রগনের পক্ষে সত্যি দূরূহ এবং কষ্টসাধ্য ও বটে।তাঁর বিদ্যাপর্বতের পরিমাপ করা, তাঁর অবাক করা আখলাক ও মহামানবোচিত চরিত্রকে সঠিকভাবে চিত্রন করা আমাদের জন্য সত্যি কঠিন। তাই তো শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী হাদীস শাস্ত্রের প্রাণপুরুষ ইমাম ইবনুল আছীর আল জাযারী রহ. (ওফাত- ৬০৬ হি.) তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন—

ولو ذهبنا إلى شرح مناقبه وفضائله لأطلْنا الخَطْب، ولم نصلْ إلى الغرض منها، فإنه كان عالما عاملا زاهدا عابدا ورعا تقيا، إماما في علوم الشريعة مرضيا.

‘যদি আমরা তাঁর বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীর বিশদ বিশ্লেষণ করি, তাহলে বক্তব্য অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে; আর আমরা এ মহিমা কীর্তনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারব না। কেননা তিনি ছিলেন আলেম, আলেম বিল্লাহ ওয়া বি- আমরিল্লাহ, ব্যক্তি জীবনে ধর্মীয় অনুশাসনের যত্নবান অনুসারী, যাহেদ, দুনিয়া নির্মোহতায় চূড়ান্ত, ইবাদতগুজার, খোদাভীরু ও মুত্তাকী এবং ইলমে শরীয়াতের গ্রহণযোগ্য ইমাম।’ (জামেউল উসুল, ইমাম আবু হানীফা)।

জন্ম পরিচয় :

নাম- নুমান, উপনাম- আবু হানিফা, উপাধি- ইমাম আজম, পিতা- ছাবিত ইবনে জোতি। মুজতাহিদ ইমামদের মধ্যে তাঁর জন্মই সর্বপ্রথম। বংশ হিসেবে তিনি ইরানি ও পারস্য দেশের অধিবাসী ছিলেন। প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী ৮০ হিজরিতে কুফা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আলী (রা.)-এর খেদমতে হাজির হয়ে তাঁর দোয়া লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। (তারিখে বাগদাদ)।

ইলম অর্জন:

তাঁর সময়কালে ইসলামী জ্ঞানের যেসব শাখা বিদ্যমান ছিল সেগুলোর জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে তিনি তাঁর ইলমী জীবন শুরু করেন। ‘কুরআনে কারীম’ মুখস্থ করেন (আসেমের রেওয়ায়েত অনুযায়ী)। হাদীস অধ্যয়ন করেন। আরবী ব্যাকরণ (নাহু), আরবী সাহিত্য ও আরবী কাব্যের উপর প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়া ইসলামী-আকীদা ও তৎসংশ্লিষ্ট মাসয়ালা-মাসায়েল নিয়ে তিনি বাতিল ফেরকাবাজদের সাথে বিতর্কসভায় অংশ গ্রহণ করতেন। এরপর ফিকহের (ইসলামী আইন শাস্ত্র) জ্ঞান অর্জনে নিমগ্ন হন এবং ফিকহের সাথে লেগে থাকেন। এমনকি তাঁর সকল চেষ্টা-সাধনা এ জ্ঞান অর্জনে ব্যয় করে যান। গভীরভাবে পড়াশুনার জন্য তিনি ফিকহশাস্ত্রকে কেন বেছে নিয়েছেন সে সম্পর্কে তাঁর একটি উক্তি রয়েছে। তিনি বলেন, “আমি এ ইলমকে নিয়ে যতবেশী নাড়াচাড়া করি, যতবেশী পড়াশুনা করি এর মর্যাদা ততবেশী স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে… আর আমি দেখতে পাচ্ছি- এ জ্ঞান ছাড়া ফরয ইবাদত আদায় করা সম্ভব নয়, দ্বীন ইসলাম কায়েম করা সম্ভব নয়, ইবাদত-বন্দেগী করা সম্ভব নয়। এমনকি এই জ্ঞান ছাড়া দুনিয়া-আখেরাত কোনোটাই পাওয়া সম্ভব নয়।” এরপর আবু হানীফা সে যামানার বড় বড় আলেমদের সান্নিধ্যে থেকে ‘ফতোয়া’ নিয়ে গবেষণাকর্ম চালিয়ে যান। ২২ বছর বয়স থেকে তিনি তাঁর ওস্তাদ হাম্মাদ ইবন আবু সুলাইমানের সান্নিধ্যে থাকেন। আবু হানীফার বয়স যখন ৪০ বছর তখন শায়েখ হাম্মাদ মারা যান। ততদিন পর্যন্ত আবু হানীফা তাঁর সান্নিধ্যে-ই ছিলেন।

তাঁর আখলাক:

আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন অত্যন্ত দ্বীনদার-পরহেযগার, খুব বেশী ইবাদতগুজার। তিনি দিনে রোজা রাখতেন, রাতে তাহাজ্জুদ পড়তেন এবং প্রচুর কুরআন তেলাওয়াত করতেন। তিনি ছিলেন আল্লাহ্‌র ভয়ে কম্পিত ব্যক্তি। একাধারে ত্রিশ বছর তিনি তাহাজ্জুদ নামাজ পড়েছেন। কুরআন ছিল তার সবসময়ের সাথী, একান্ত বন্ধু।
তাঁর অন্যতম গুণ ছিল সহিষ্ণুতা ও বদান্যতা। ব্যবসার মাধ্যমে তাঁর হাতে প্রচুর অর্থ আসত। যদিও তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার এবং যৎসামান্য লাভে ব্যবসায়িক লেনদেন করতেন। তাঁর সম্পদের বেশীরভাগ অংশ তিনি আলেম-ওলামা ও মুহাদ্দিসদের জন্য ব্যয় করতেন। তাঁর প্রতি আল্লাহ্‌পাকের অনুগ্রহের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি এ দান করতেন।

আরও পড়তে পারেন-

ফিকাহশাস্ত্রে ইমাম আবু হানিফার রহ. অবদান:

যুক্তিবিদ্যাসহ অন্যান্য বিষয়ে অসাধারণ জ্ঞানে গুণান্বিত হওয়ার পাশাপাশি ইমাম আবু হানিফা রহ. ইসলামী শরীয়তের বিধিবিধানের উপর গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। ইলমে দ্বীন শিক্ষার্জনের  মানসে বিভিন্ন মুহাদ্দিস ও ফকীহদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং তাদের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। ফিকহের উপর তার এত আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল যে, তিনি হাম্মাদ ইবনে আবি সুলায়মান রহ. এর সান্নিধ্যে সুদীর্ঘ্য ১৮ টি বছর ইলমে দ্বীন শিক্ষার্জনে কাটিয়ে দিয়েছিলেন। কুরআন হাদিস গবেষণা তথা ইজতিহাদের ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। তাকে সমকালীন যুগে ফকীহদের সর্দার বলে গণ্য করা হত। এছাড়া তিনি ইরাকের কুফা নগরীর ‘মুফতী’ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। ইলমী ময়দানে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি হানাফী মাযহাবের প্রবর্তক। আজো তিনি ইমাম আজম নামে প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন এবং প্রসিদ্ধ চার ইমামের মাঝে তাঁকেই শ্রেষ্ঠ ইমাম হিসেবে অভিহিত করা হয়। বর্তমানে ইরাক, চীন, ভারত, পাকিস্তান,বাংলাদেশসহ পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ নিজেদের জীবনচলার পথে উদ্ভুত সমস্যার সমাধানে ইসলামের দিকনির্দেশনা হিসেবে তার মাজহাবকে মেনে চলেন।এমনকি উসমানী সাম্রাজ্যের অন্তর্গত এলাকাসমুহে আবু হানিফা রহ.-এর মাজহাবকে রাষ্ট্রীয়ভাবে রাষ্ট্রে প্রয়োগ করা হত। (উসুলুদ্দিন ইনদা আবি হানিফা-৯৯)।

ইলমে হাদিসে ইমাম আবু হানিফা রহ:- এর বিশেষ অবদান:

হাফেজ মুহাম্মদ ইউসুফ সালেহি শাফেয়ি (রহ.) বলেন, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) হাদিসের বড় বড় হাফেজ ও শীর্ষদের অন্তর্ভুক্ত। তিনি যদি হাদিসের প্রতি খুব বেশি মনোযোগী না হতেন এবং ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন না হতেন, তাহলে ফিকহের মাসআলা-মাসাইল বের করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো না। (তাবাকাতুল হুফফাজ, আল হাদিস ওয়াল মুহাদ্দিসুন, পৃষ্ঠা-২৮৪)।

মুহাদ্দিস ইয়াহিয়া ইবনে মুঈনকে যখনই ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হতো, তখনই তিনি বলতেন তিনি নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত, ভুলভ্রান্তিমুক্ত। হাদিসের ব্যাপারে কেউ তাঁকে দুর্বল বা অগ্রহণযোগ্য বলেছেন বলে আমি শুনিনি। (উমদাতুল কারি, দ্বিতীয় খণ্ড ,পৃষ্ঠা- ১২)।

শায়খুল ইসলাম ইয়াজিদ ইবন হারুন (রহ.) বলেন, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) অত্যন্ত মুত্তাকি, পবিত্র-পরিচ্ছন্ন গুণসম্পন্ন সাধক, আলিম, সত্যবাদী ও সমসাময়িককালের সবার অপেক্ষা হাদিসের বড় হাফেজ ছিলেন। (মানাকেবে আবু হানিফা লি মুহাম্মদ জামিরি)।

হাফেজ আবু নঈম ইসফাহানি (রহ.) বলেন, আমি ইমাম আবু হানিফার কাছে একটি ঘরে উপস্থিত হলাম, যা কিতাবে পরিপূর্ণ ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কিসের কিতাব? প্রত্যুত্তরে বলেন, হাদিসের। (উকুদুল জাওয়াহিরিল হানিফা প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ২৩)।

ইন্তিকাল:

খলিফা মনসুর তাকে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি জালেম শাসকের সমর্থনের দায় এড়ানোর জন্য এ পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। এতে অপমানে ক্ষুব্ধ হয়ে খলিফা ইমাম আবু হানিফাকে কারাগারে বন্দী করেন। প্রতিদিন তাকে কারাগার থেকে বের করে প্রকাশ্যে দশটি করে চাবুক মারা হতো। চাবুকের আঘাতে তার শরীর থেকে রক্ত বের হতো। সে রক্তে কুফার মাটি রঞ্জিত হতো। পানাহারের কষ্টসহ বিভিন্নভাবে সত্তর বছর বয়সের বৃদ্ধ ইমামকে নির্যাতন করা হতো। অবশেষে জোর করে বিষ পান করানো হয়। ৭৬৭ ঈসায়ি সালের ১৪ জুন মোতাবেক ১৫০ হিজরিতে তিনি আমাদের কে এতিম করে পরপারে পাড়ি জমান।
আল্লাহ আপনি হযরত কে জান্নাতুল ফেরদাউস- এর উঁচু মাকাম দান করুন। আমীন।

লেখক: শিক্ষার্থী, দাওরায়ে হাদিস , জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: আইএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।