।। আসআদ শাহীন ।।
ইসলাম যেভাবে ইবাদত ও ফরজ বিধি-বিধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে, তেমনি হালাল পেশা ও জীবিকা অর্জনকেও গুরুত্ব দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন : ‘অতঃপর নামাজ (পড়া) শেষ হলে জমিনে ছড়িয়ে পড়ো এবং (তারপর) আল্লাহর অনুগ্রহ (রিজিক) অন্বেষণ করো।’ (সুরা : আল জুমআ, আয়াত : ১০)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ইবাদতের পর হালাল রিজিক উপার্জন করা (সবচেয়ে বড়) ফরজ।’ (আস সুনানুল কুবরা, হাদিস : ১১৬৯৫)
উপরিউক্ত বর্ণনা থেকে জীবিকা নির্বাহের গুরুত্ব স্পষ্ট।
ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমান সাহাবায়ে কিরাম (রা.) বেশির ভাগ ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন এবং মদিনার সাহাবিরা বেশির ভাগ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে দ্বিন শুধু ইবাদত করার নামই নয়, বরং দ্বিন হলো ইবাদত ও লেনদেনের সামষ্টিক নাম। যদি কোনো ব্যক্তি বিশুদ্ধ নিয়তে ও সঠিক নিয়মে ব্যবসা ইত্যাদি করে তাহলে আল্লাহ তাকে সওয়াব দান করেন। তাই ইসলামে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করাও দ্বিনের ওপর আমল করার নামান্তর।
সুতরাং নিম্নে ইসলামের চার খলিফার অর্থনৈতিক জীবনব্যবস্থা কেমন ছিল—তা তুলে ধরা হলো—
আবু বকর সিদ্দিক (রা.)
আবু বকর সিদ্দিক (রা.) কাপড়ের ব্যবসা করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, তিনি ছিলেন কুরাইশদের সর্বশ্রেষ্ঠ বণিক। তিনি সুনৈতিকতা ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী একজন সুপরিচিত ও প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ছিলেন। (আল ইসাবাহ ফি তাময়িজিস সাহাবা, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-১৪৭)
উম্মে সালামা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের এক বছর আগে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ব্যাবসায়িক সফরে বসরা (ইরাক) গিয়েছিলেন এবং এই সফরে তাঁর সঙ্গে ছিলেন নুয়াইমান (রা.) এবং সুয়ায়বিত বিন হারমালা (রা.)-ও সঙ্গে ছিলেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৭১৯)
আবু বকর সিদ্দিক (রা.) যখন খলিফা হলেন, তখন তার পরের দিনই তিনি সকালে বাজারে যাচ্ছিলেন এবং তাঁর কাঁধে কাপড়ের গাট্টি ছিল, যার মাধ্যমে তিনি ব্যবসা করতেন। পথিমধ্যে ওমর (রা.) এবং আবু উবাইদাহ ইবনে জাররাহ (রা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, তখন তাঁরা উভয়ে আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর খলিফা! গন্তব্য কোথায়? তিনি জবাবে বলেন, বাজার। তখন উভয়েই বলেন, আপনি কিভাবে ব্যবসা করবেন? অথচ আপনি মুসলমানদের গভর্নর ও খলিফা। (অর্থাৎ আপনাকে মুসলমানদের বিষয় দেখাশোনা করার এবং তাদের সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আপনি এই খলিফার দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা কিভাবে করবেন?) তখন আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বলেন, তাহলে আমার পরিবার চলবে কেমন করে?
ওমর (রা.) ও আবু উবাইদাহ ইবনে জাররাহ (রা.) বলেন, আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন, যাতে আমরা আপনার জন্য বায়তুল মাল (রাষ্ট্রীয় কোষাগার) থেকে কিছু (বেতন) নির্ধারণ করে দিতে পারি। আবু বকর (রা.) তাঁদের সঙ্গে গেলেন এবং সাহাবায়ে কিরাম তাঁর জন্য প্রতিদিন অর্ধেক ভেড়া ও বার্ষিক দুই হাজার দিনার বেতন নির্ধারণ করা হলো।
এ ছাড়া শীত ও গ্রীষ্মের দুটি কাপড় পরিধানের জন্য নির্ধারণ করা হয়। আবু বকর সিদ্দিক (রা.) খলিফা হওয়ার আগে তাঁর পরিবারের জন্য যত খরচ করতেন তা-ই নির্ধারণ করা হলো। পরবর্তী সময়ে এই বেতন বাড়িয়ে দৈনিক একটি ভেড়া ও বার্ষিক ছয় হাজার দিনার করা হয়। (সিরাজুল মুলুক, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১২৯)
ওমর ফারুক (রা.)
উবাইদুল্লাহ ইবনে উমায়ের (রা.) থেকে বর্ণিত, আবু মুসা আশআরি (রা.) ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর কাছে প্রবেশের অনুমতি চাইলে তাঁকে অনুমতি দেওয়া হয়নি; সম্ভবত তিনি কোনো কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাই আবু মুসা (রা.) ফিরে আসেন। পরে ওমর (রা.) পেরেশান হয়ে বলেন, আমি কি আবদুল্লাহ ইবনে কায়সের [আবু মুসা (রা.)-এর নাম] আওয়াজ শুনতে পাইনি? তাঁকে আসতে বলো। কেউ বলল, তিনি তো ফিরে চলে গেছেন। ওমর (রা.) তাঁকে ডেকে পাঠালেন। তিনি (উপস্থিত হয়ে) বলেন, আমাদের
এরূপই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। (অর্থাৎ প্রবেশের অনুমতি না থাকলে ফিরে যাও) ওমর (রা.) বলেন, তোমাকে এর ওপর সাক্ষী পেশ করতে হবে। আবু মুসা (রা.) ফিরে গিয়ে আনসারদের এক মজলিসে পৌঁছে তাঁদের এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন। তাঁরা বলেন, এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ আবু সাঈদ খুদরি (রা.) সাক্ষ্য দেবেন। তিনি আবু সাঈদ খুদরি (রা.)-কে নিয়ে গেলেন। ওমর (রা.) (তাঁর কাছ থেতে সে হাদিসটি শুনে) বলেন, (কী আশ্চর্য) আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ কি আমার কাছ থেকে গোপন রয়ে গেল? (আসল ব্যাপার হলো) বাজারের ক্রয়-বিক্রয় অর্থাৎ ব্যবসার জন্য বের হওয়া আমাকে বেখবর রেখেছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০৬২)
ওমর (রা.) জাহেলি যুগে বিভিন্ন শিল্পে পারদর্শিতা অর্জনের পর তিনি জীবিকার দিকে মনোনিবেশ করেন। সমগ্র আরবে জীবিকা নির্বাহের বেশির ভাগ মাধ্যম ছিল ব্যবসা, তাই তিনিও ব্যবসা শুরু করেন এবং এতে তিনি এত বেশি মুনাফা অর্জন করেন যে তিনি মক্কার ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য হতে থাকেন। এমনকি তিনি খলিফা হওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যবসা চালিয়ে যান এবং খলিফা হওয়ার পরও তিনি ব্যবসা চালিয়ে যান। (তারিখে দামেস্ক, খণ্ড-৪৪, পৃষ্ঠা-৩৪৫)
আরও পড়তে পারেন-
- ইবাদতের গুরুত্ব নিয়ে ঠাট্টা-তাচ্ছিল্য জঘন্য গুনাহ
- উগ্র হিন্দুত্ববাদ এবং মুসলিমবিদ্বেষ ভারত ও বাংলাদেশের জন্য হুমকি
- ‘ইবাদুর রাহমান’ বা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বিশেষ ১২টি গুণ
- মৃত্যুর স্মরণ জীবনের গতিপথ বদলে দেয়
- যে কারণে হিন্দুত্ববাদের নতুন নিশানা ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’
গ্রীষ্মকালে তিনি বাণিজ্যের উদ্দেশে সিরিয়া দেশে যেতেন এবং শীতকালে তিনি ইয়েমেন দেশে যেতেন। সম্ভবত তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের সফরের কারণে তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণ, বীরত্ব ও সাহসিকা, অভিজ্ঞতা, ব্যাবসায়িক চতুরতা, নৃতাত্ত্বিক চিন্তাধারা ও প্রজ্ঞার মতো দুর্দান্ত গুণাবলি অর্জন করেছিলেন। (হায়াতুস সাহাবা, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৫০৬)
উসমান বিন আফফান (রা.)
উসমান (রা.) যে ব্যবসা করতেন তা জগদ্বিখ্যাত ছিল। তিনি কাপড়ের ব্যবসা করতেন এবং খেজুরের ব্যবসাও করতেন। উসমান (রা.) জাহেলিয়াত ও ইসলামী উভয় যুগেই একজন সফল ও প্রসিদ্ধ বণিক ছিলেন এবং তিনি তাঁর টাকা-পয়সা ও মাল মুদারাবাতের সুরতে ব্যবসায় লাগাতেন অর্থাৎ টাকা-পয়সা বা মাল তিনি সরবরাহ করতেন এবং ব্যবসা অন্য ব্যক্তি দ্বারা করাতেন। (আল মাআরিফ, পৃষ্ঠা-৫৭৫)
আলী বিন আবি তালিব (রা.)
আলী (রা.) একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতিতে উটের বিনিময়ে তাঁর উট বিক্রি করেছিলেন। তাঁর উটকে উসাইফির বলে ডাকা হতো। (আল মুসান্নাফ লি-সুনআনি, হাদিস : ১৪১৪২)
আলী (রা.) বলেছেন, (বদর যুদ্ধের) গনিমতের মাল থেকে আমার অংশের একটি উটনী ছিল এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর খুমুস (পঞ্চমাংশ) থেকে একটি উটনী আমাকে দান করেন। যখন আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কন্যা ফাতিমা (রা.) এর সঙ্গে বাসর রাত যাপনের ইচ্ছা করলাম, সে সময় আমি কায়নুকা গোত্রের একজন স্বর্ণকারের সঙ্গে এই চুক্তি করেছিলাম যে সে আমার সঙ্গে (জঙ্গলে) যাবে এবং ইজখির ঘাস (Fresh Lemongrass) বহন করে আনবে এবং তা স্বর্ণকারদের কাছে বিক্রি করে তার মূল্য দ্বারা আমার বিবাহের ওয়ালিমার ব্যবস্থা করব। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০৮৯)
উম্মাহ২৪ডটকম: আইএ