Home জাতীয় শিক্ষা প্রশাসন চালাচ্ছে আওয়ামী সুবিধাভোগীরা

শিক্ষা প্রশাসন চালাচ্ছে আওয়ামী সুবিধাভোগীরা

আওয়ামী শাসনামলের দেড় দশকে ভেঙে দেয়া হয়েছে শিক্ষার মেরুদণ্ড। ওই সরকারের তিন মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, দীপু মনি ও মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল তাদের সময়ে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি যেমন করেছেন, তেমনি বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিতে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। এছাড়া একের পর এক কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন, প্রশ্নফাঁস (ভর্তি পরীক্ষা, প্রাথমিক থেকে সকল পাবলিক ও নিয়োগ পরীক্ষা), ঘুষ ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছি শিক্ষা প্রশাসনের সব দপ্তরই। আর এসবে নেতৃত্ব দিয়েছেন আওয়ামী মন্ত্রীদের নেতৃত্বে তাদের নিয়োগকৃত দলীয় কর্মীতে পরিণত হওয়া কর্মকর্তারা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেড় দশকের স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পর নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। দায়িত্ব নিয়ে কারিকুলাম ও পাঠ্য বইয়ে পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়ে কাজ শুরু করলেও প্রায় দেড় মাসেও শিক্ষা প্রশাসনকে আওয়ামী দোসর মুক্ত করতে পারেননি তিনি। এখনো শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, সকল শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম) সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগীরা। এর কোন কোনটিতে দপ্তর প্রধান পদত্যাগ করলেও যাদের চলতি দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারাও একই আদর্শের এবং সাবেক মন্ত্রীদের ঘনিষ্ট। আবার এতোদিন যারা আওয়ামী সুবিধাভোগী ছিলেন তাদের কেউ কেউ রং পাল্টে হয়ে উঠছেন নতুন সরকারের সুবিধাভোগী।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে সচিব পরিবর্তন করে সিনিয়র সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তবে গত নভেম্বরে নিয়োগ পাওয়া কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব পালন করছেন এখনো। মন্ত্রণালয়ের বাকী যারা দায়িত্বে রয়েছেন সেই আওয়ামী আমলের কর্মকর্তারাই। অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপ সচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন বিগত সরকারের মন্ত্রীদের ঘনিষ্ট ব্যক্তিরা। এমনকি সিনিয়র সচিবের একান্ত সচিবের দায়িত্বে আছেন সাবেক সচিবের একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মো. জাকির হোসেন। পরিবর্তন আসেনি প্রশাসন ও অর্থ, উন্নয়ন, মাধ্যমিক, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পরিকল্পনা, নিরীক্ষা ও আইনসহ কোন দপ্তরেই। যদিও আওয়ামী আমলের সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা সে সময় দীপু মনি ও নওফেলের ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচয় দিলেও এখন ভোল পাল্টে বিএনপি ও জামায়াতের নানা নেতার পরিচয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দু’একজন সমন্বয়কের পরিচয়েও দাপট দেখাচ্ছেন কেউ কেউ।

অন্যদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন ফরিদ আহাম্মদ। তিনি আওয়ামী শাসনামলে ডিসি থেকে শুরু করে সামরিক ভূমি ও ক্যান্টনমেন্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, শেখ ফজলে নূর তাপসের নেতৃত্বে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সিইও এবং পরবর্তীতে প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়েছেন। সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন, রুমানা আলীর সময় জয়বাংলার লোক হিসেবেই নিজেকে উপস্থাপন করতেন ফরিদ আহাম্মদ। সরকার পরিবর্তন হলেও তিনি এখনো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্বেই রয়ে গেছেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লাগাতার আন্দোলনের মুখে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে ডিজি আব্দুস সামাদকে অপসারণ করে নতুন ডিজি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ড. মো. আব্দুল হাকিমকে।

শিক্ষার সব দপ্তরে আওয়ামী আমলের কর্মকর্তারা বহাল: মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর নেহাল আহমেদ পদত্যাগ করার পর ওই পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে একই আমলের সুবিধাভোগী পরিচালক (প্রশাসন) প্রফেসর এবিএম রেজাউল করীমকে। যিনি আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ট হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই রাজধানীর ইডেন কলেজ, বিজ্ঞান কলেজসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে সর্বশেষ মাউশিতে পদায়ন হয়েছেন। একইভাবে পরিচালক (মাধ্যমিক) প্রফেসর সৈয়দ জাফর আলী, পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) প্রফেসর একিউএম শফিউল আজমসহ অনেক কর্মকর্তা এখনো মাউশিতে বহাল তবিয়তেই আছেন। ৪ আগস্ট তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের পক্ষে মাউশিতে মিছিল এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দিলেও এখনো পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের রয়েছেন আবুল কালাম আজাদ, মোহাম্মদ মানকিউল হাসানাত, স্বরূপ কুমার কাহালি, আলমগীর হোসেন, মো. মুকিব মিয়া, শাহিনুর ইসলাম, রিপন মিয়া, খ. ম. মঞ্জুরুল আলম, কামরুন নাহার, কে এম শফিকুল ইসলাম, সরকার মোহাম্মদ শফিউল্লাহ দিদার, সাদিয়া সুলতানা, মোহাম্মদ ওয়ায়েছ আলকারনী মুন্সী, প্রলয় দাস, মাউশির কাওছার আহমেদ, তরিকুল ইসলাম, রিয়াদ আরাফাত, হাফিজুর রহমানসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা দাপটের সঙ্গেই শিক্ষা ভবনে রয়েছেন। আর এসব কর্মকর্তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন মাউশিতে এখন দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালক রেজাউল করীম। অভিযোগ রয়েছে এই মিছিলে ইন্ধন ছিল রেজাউল করীম ও শফিউল আজমের। এই দু’জনই সাবেক দুই মন্ত্রীর ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত। যদিও এখন রেজাউল করীম বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের বন্ধু পরিচয়ে ব্যাপক দাপট দেখাচ্ছেন মাউশিতে। ব্যতিক্রম নয় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে।

এছাড়া ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সহ প্রায় সব শিক্ষা বোর্ডেই এখনো আওয়ামী আমলে নিয়োগ দেয়া চেয়ারম্যানগণ দায়িত্ব পালন করছেন। এদের মধ্যে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্বে আছেন প্রফেসর তপন কুমার সরকার, চট্টগ্রাম বোর্ডে প্রফেসর রেজাউল করিম, বরিশাল বোর্ডে প্রফেসর মো. ইউনুস আলী সিদ্দিকী, দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে প্রফেসর স ম আব্দুস সামাদ আজাদ, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে প্রফেসর ড. মো. অলীউল আলম। জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) পরিচালক পদে প্রফেসর ড. উম্মে আসমাসহ উপ-পরিচালক, সহকারী পরিচালকরা রয়েছেন আগের মতোই।

আরও পড়তে পারেন-

আওয়ামী সরকার পতনের পর শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, নর্থ সাউথসহ বেশ কয়েকটি প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদত্যাগ করেন। ইতোমধ্যে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার নিয়োগও দেয়া হয়েছে। তবে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিরা পদত্যাগ করেননি তারা এখনো দায়িত্ব পালন করছেন। আওয়ামী আমলের সুবিধাভোগী ও নিয়োগপ্রাপ্ত এসব ভিসি, প্রো-ভিসি, প্রক্টরসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাউকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখনো অপসারণ করেনি।

স্বৈরাচার সরকারের দোসর, কুখ্যাত ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের পরিচালক, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. আবুল কালাম আজাদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেজারার এস এম এহসান কবীর ৫ আগস্টের পর পলাতক থাকলেও এখনো তাদেরকে স্বপদে বহাল রেখেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে না আসলেও তাদের শোকজ পর্যন্ত করেনি বিশ্ববিদ্যালয় ও মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে তাদের দুর্নীতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে এবং হাসিনা সরকারের পদলেহনের অভিযোগে অপসারণ দাবি করে ধারাবহিক কর্মসূচি পালন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কিন্তু তাতেও টনক নড়েনি শিক্ষা প্রশাসনের।

একই চিত্র দেশের স্কুল, কলেজগুলোতেও। বরং যেখানে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে স্কুল, কলেজের অধ্যক্ষ পদত্যাগ করেছেন তাদেরকে আবারও ডেকে এনে পুনর্বহাল করার অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। আবার বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি, অনিয়ম, যৌন নিপীড়নের দায়ে অভিযুক্ত, অব্যাহতিপ্রাপ্ত এবং বহিস্কৃতদেরও পুনর্বাসন করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর উত্তরার ৭ নং সেক্টরের উত্তরা হাই স্কুল এন্ড কলেজে। অধ্যক্ষের পদ শূন্য থাকায় সরকারের সহযোগিতায় তালা ভেঙে চেয়ারে বসানো হয় দুর্নীতির দায়ে বহিষ্কৃত হাফিজুর রহমান মোল্লাকে। এঘটনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিবাবকদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে কথা বলার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. মো. আব্দুর রশীদ ও শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে ফোন দিলে তারা কেউই রিসিভ করেননি। ম্যাসেজ দিলেও কোন উত্তর দেননি।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।