জুনায়েত রাসেল: আবুল হাসনাতের (ছদ্মনাম) বইয়ের দোকান নীলক্ষেতের বাবুপুরা লেনে। দীর্ঘ এক যুগ ধরে বিক্রি করছেন সাহিত্যের বই। এই সময়টাতে কিছু নিষিদ্ধ বইও বিক্রি করেছেন তিনি। সমঝদার ক্রেতা দেখলেই বের করতেন দু-এক পিস। বলতেন, “দেখেন তো লাগবে নাকি!” কেউ কিনতে চাইলে একটু চড়া দামেই বিক্রি করতেন সেগুলো। হাসনাত এখন সেই ‘নিষিদ্ধ’ বইগুলোই বিক্রি করছেন সর্বসম্মুখে!
বলছি, জুলাই বিপ্লব পরবর্তী নীলক্ষেতের কথা। যে সব ইতিহাস-ভিত্তিক বই একসময় ছিল নিষিদ্ধ, কিংবা চাপা পড়ে ছিল অন্ধকারে— সেগুলাই এখন বেস্টসেলার। নীলক্ষেতের প্রতিটি দোকানেই পাওয়া যাচ্ছে বইগুলো। বিক্রিও হচ্ছে হরদম। শুধু নীলক্ষেত নয়, অনলাইন-ভিত্তিক বই বিক্রির প্ল্যাটফর্মগুলোতেও একই অবস্থা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসছে অর্ডার। হাজারো বই প্রতিদিন চলে যাচ্ছে সারাদেশে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে বই বিক্রি করতে দেখা যায় অনেককেই। বিসিএস আর বিভিন্ন চাকরি পরীক্ষার বই সাধারণত পাওয়া যায় এখানে। তবে এখনকার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন! লাইব্রেরির সামনে এখন বিক্রি হচ্ছে ‘চেপে রাখা ইতিহাসের’ বিভিন্ন বই। বেচাকেনারও হচ্ছে বেশ। তা কোন কোন বইগুলো নতুন করে পেলো এই জনপ্রিয়তা?
‘আমার ফাঁসি চাই’— বেশ চমকপ্রদ এক নাম। এই নামেই নিজের বইয়ের নামকরণ করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান রেন্টু। ১৯৮১ থেকে ৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উপদেষ্টা। সে সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে লেখা এ বইয়ে হাসিনা ও তার দলের নানা অনিয়মের কথা তুলে ধরেন লেখক। প্রকাশের পরেই ইতিহাস বিকৃতি ও রাজনৈতিক বিতর্ক ছড়ানোর অভিযোগে নিষিদ্ধ করা হয় বইটি। নিষিদ্ধের পর দীর্ঘদিন বইটিকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। কিন্তু সে বই-ই এখন বিক্রি হচ্ছে সর্বাধিক।
গণতন্ত্র তোরণের অদূরেই নীলক্ষেত ফুটপাতে বই বিক্রি করেন হাসান আলী। ১৮ বছরের ব্যবসায়ী জীবনে কোনোদিন ইতিহাসের বই এত বিক্রি করেন নি তিনি। জানালেন, কোনো কোনো দিন ‘আমার ফাঁসি চাই’ বইটি বিক্রি হয় ১০০ পিসের ওপরে। “এইগুলা তো পুরাতন বই সব। আগে লুকাইয়া বিক্রি হইছে। এখন ওপেনে। ক্ষমতার দাপটে এইগুলা আটকায়া রাখছিল। অনেক লেখকে মামলা খাইছে, বই বিক্রি করলেও পুলিশ ধরছে। এখন সব ওপেন।”
‘আমার ফাঁসি চাই’ এর পাশাপাশি আরও বেশ কিছু বই রয়েছে বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায়। এরমধ্যে অন্যতম শেখ মুজির রহমানকে সপরিবারে হত্যার সাথে জড়িত মেজর শফিকুল হক ডালিমের বই ‘আমি মেজর ডালিম বলছি’। ২০০২ সালে প্রকাশিত এই বইটি বিক্রি হচ্ছে পুরোদমে। মেজর ডালিমের ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ বইটিও পেয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। এই তিনটি বই এতই বিক্রি হচ্ছে যে, “কেউ কিনলে একটি বই কিনছেন না, তিনটাই একসাথে নিচ্ছেন,” জানালেন এক বিক্রেতা।
এই তিন বই ছাড়াও শারমিন আহমেদের লেখা ‘নেতা ও পিতা’, পিনাকী ভট্টাচার্যের লেখা ‘স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ’, এ কে খন্দকারের ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’, আহমেদ মুসার ‘ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ’— বিক্রি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এর পাশাপাশি মহিউদ্দিন আহমেদের সম্প্রতি প্রকাশিত বই ‘জামাতে ইসলামী : উত্থান, বিপর্যয়, পুনরুত্থান’ নিয়েও আগ্রহ দেখাচ্ছেন মানুষ। এমনটিই জানালেন বিক্রেতারা।
নীলক্ষেতের ফুটপাত ধরে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ থেমে যান অনেকেই। নতুন পুরাতন বইয়ের অস্থায়ী দোকানগুলো থেকে হাতে তুলে নেন কোনো কোনো বই। এই পথচারী ক্রেতাদের মূল ঝোঁক এখন এসব বইয়ের ওপর। না কিনলেও একবার নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখছেন অন্তত। তরুণ বিক্রেতা রমজান শেখ জানালেন, গত এক মাসে হাজারখানেক ইতিহাসের বই বিক্রি করে ফেলেছেন। “এত বেশি চলে, আমরা ‘ফাঁসি চাই’ আর ‘মেজর ডালিম’ ৫,০০০ পিস করে ছাপাইয়া রাখছি। অনেকে পাইকারি নিয়া যায়। ১০ টাকা লাভে ছাইড়া দেই।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মুজাহিদুল ইসলামের অনলাইন ভিত্তিক বইয়ের দোকানের নাম ‘ক্যাম্পাস বুকশপ’। জুলাই বিপ্লবের পর ইতিহাসের বইগুলোর এই ব্যাপক চাহিদাকে তিনি তুলনা করেছেন ফেব্রুয়ারি মাসের বই বিক্রির সাথে, একে বলছেন ‘দ্বিতীয় ফেব্রুয়ারি’। ক্যাম্পাসে যেমন সাড়া পাচ্ছেন, বইয়ের মান ভালো বলে বাইরে থেকেও পাঠকেরা তার থেকে বই সংগ্রহ করছেন। “আমি আগস্টের ১৬ তারিখ থেকে বইগুলো বিক্রি করা শুরু করি। অনেকেই এই উদ্যোগের জন্য বাহবা দিচ্ছেন।”
মুজাহিদ মনে করেন, চমকপ্রদ সব তথ্য থাকার কারণে পাঠকের মধ্যে সাড়া ফেলেছে বইগুলো। তিনি বলেন, “এই বইগুলো নিষিদ্ধ হলেও অনেক পাঠকই এগুলোর সফটকপি পড়েছেন। কিন্তু দেশের পরিস্থিতির কারণে বইটি সম্পর্কে নিজের মত প্রকাশ করতে পারতেন না। স্বাধীনতার পর পাঠকরা বইগুলো নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন এবং বেশ কিছু সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকটিভিস্টও তাতে যোগ দেন। এভাবেই বইগুলোর পরিচিত বেড়ে যায়।”
আরও পড়তে পারেন-
- ইবাদতের গুরুত্ব নিয়ে ঠাট্টা-তাচ্ছিল্য জঘন্য গুনাহ
- উগ্র হিন্দুত্ববাদ এবং মুসলিমবিদ্বেষ ভারত ও বাংলাদেশের জন্য হুমকি
- ‘ইবাদুর রাহমান’ বা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বিশেষ ১২টি গুণ
- মৃত্যুর স্মরণ জীবনের গতিপথ বদলে দেয়
- যে কারণে হিন্দুত্ববাদের নতুন নিশানা ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’
নীলক্ষেত ফুটপাতে বই দেখছিলেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী সবুজ আহমেদ। নতুন করে সামনে আসা এসব বই নিয়ে তার মত, ইতিহাস চেপে রাখার জিনিস নয়।
“আওয়ামী লীগের বানানো ইতিহাসের বাইরে আরেক ইতিহাস আছে। মানুষ এখন সেই চেপে রাখা ইতিহাস জানতে চাচ্ছে। ফলে এসব বই এখন জনপ্রিয় হতে বাধ্য,” বলেন তিনি।
সবুজ আহমেদ মনে করেন, ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের ফলে মানুষের মধ্যে নতুন করে ইতিহাস সচেতনতা তৈরি হয়েছে। “এখানে যে নিষিদ্ধ বইগুলো বিক্রি হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। এখানে ‘নেতা ও পিতা’র মতো বইও বিক্রি হচ্ছে। মহিউদ্দিন আহমেদের রাজনৈতিক ইতিহাসের বইগুলো বিক্রি হচ্ছে। মানুষ আগের চেয়ে ইতিহাস সচেতন হচ্ছে। আমি আমার এলাকার লাইব্রেরির জন্য বই কিনছি, অবশ্যই এই বইগুলো রাখবো।”
মেয়েকে নিয়ে বই কিনছিলেন শিক্ষিকা নাজনীন বেগম। মেয়ে আবদার করতেই কিনে দিলেন বেশ কিছু বই। সবগুলোই সম্প্রতি জনপ্রিয়তা পাওয়া ইতিহাসের বই। জানালেন, ওরা নতুন প্রজন্ম; ইতিহাস জানলে তবেই আলোকিত দেশ গঠন সম্ভব হবে।
“বই পড়ার ব্যাপারে আমার বাবা-মা যেমন কোনো বাছবিচার করতেন না, আমিও তা করি না। কোনটা বিতর্কিত তা দেখি না। মেয়ে পড়তে চেয়েছে, কিনে দিয়েছি,” বললেন নাজনীন। তবে এই বইগুলোর ছাপার মান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি।
তাজউদ্দীন আহমেদের জ্যেষ্ঠ কন্যা শারমিন আহমেদ বাবাকে নিয়ে লিখেছেন ‘নেতা ও পিতা’ বইটি। ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশের পর পরই পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে গ্রন্থটি। এ বইটিও নীলক্ষেত দখল করেছে এবার। তবে অরিজিনাল প্রিন্ট বিক্রি না হয়ে বিক্রি হচ্ছে নীলক্ষেত ভার্সন। এ বইটির মতো আরও অনেক বই-ই পাইরেসির স্বীকার হয়েছে বাড়তি জনপ্রিয়তার কারণে। এমনকি, মহিউদ্দিন আহমেদের বইগুলোও নীলক্ষেত ভার্সন হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে খুব কম দামে। বলা বাহুল্য, সেগুলো বিক্রিও হচ্ছে খুব।
তবে পাইরেসি বই বিক্রির পেছনে বিক্রেতাদের দাবি, পাঠকের কথা চিন্তা করেই তারা এসব বই বিক্রি করছেন। “প্রকাশনীর বইয়ের তো দাম অনেক। কেউ কিনবার চায় না। আর এই নীলক্ষেতের বইতে আমাগোও লাভ কম। সারাদিন ২০০–৩০০ কপি বিক্রি করলে হাজার টাকাও লাভ হয় না,” বললেন বিক্রেতা রমজান।
তবে রাজনৈতিক নেতাদের চাঁদা দিতে হয় না বলে ব্যবসা এখন ভালো, জানালেন এই বিক্রেতা। “ব্যবসা কইরা অনেক মজা এখন। আগের চেয়ে অনেক ভালো। এখন তো চাঁদা নাই, কোনো ফিটিং নাই, সন্ত্রাস নাই। আগে এখানে দাও ১০ টাকা, ওইখানে দাও ৫০ টাকা, ১০০ টাকা। এখন আর এইগুলা নাই।”
নতুন এই পরিস্থিতিতে বইয়ের ব্যবসায় লাভের মুখ দেখবেন, এমনটাই মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। আর সেক্ষেত্রে আরও অন্তত মাস দুয়েক ইতিহাস-ভিত্তিক বই-ই হবে তাদের প্রধান হাতিয়ার। যেমনটি বলছিলেন রমজান আলী। “এই বইগুলা বেচাকেনা বন্ধ হবে না। যাওয়ার-আসার সময় দেখলেই কিনবে। এহন যেমন চলতেছে, এমন আরও কয়েক মাস চলবে।”
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ