Home ওপিনিয়ন মোদির ভারতে মুসলমানদের পরিস্থিতিতে আমরাও উদ্বিগ্ন হই

মোদির ভারতে মুসলমানদের পরিস্থিতিতে আমরাও উদ্বিগ্ন হই

।। সৈয়দ ইবনে রহমত ।।

ভারতের ৭৮তম স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের তথাকথিত হিন্দু নির্যাতন প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে বিশেষত হিন্দু এবং অন্যান্য অমুসলিম নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ভারতের ১৪০ কোটি জনগণ।’ মোদি আরো বলেছেন, ‘১৪০ কোটি দেশবাসী চাইছেন, সে দেশে হিন্দু এবং সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার দিকটি নিশ্চিত করা হোক। ভারত বরাবর চেয়ে এসেছে সেখানে সুখ এবং শান্তি বজায় থাকুক। শান্তির বিষয়ে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের বিকাশের জন্য আমাদের শুভকামনাই থাকবে। কারণ, আমরা মানবতার পক্ষে।’

ভারতের নির্লজ্জ ও একপেশে পৃষ্টপোষকতায় বাংলাদেশের ক্ষমতায় অবৈধভাবে দীর্ঘদিন টিকে থাকা স্বৈরচার শেখ হাসিনার ৫ আগস্ট পতনের কারণে নিজেদের পলিসির ব্যর্থতা ও হতাশা ঢাকতেই মোদির এই প্রতিক্রিয়া, বলেছেন অনেকে। তাছাড়া, মোদি কথিত বাংলাদেশের সুখ-শান্তির প্রত্যাশার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার মতো কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ তাদের কোনো কর্মকাণ্ডে কখনোই পাওয়া যায় না। এগুলো শুধুই কথার কথা, মিথ্যাচারের নামান্তর। বাংলাদেশের আজকের পরিস্থিতির জন্য ভারতই দায়ী। যাহোক, তারপরও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস টেলিফোনে কথা বলেছেন নরেন্দ্র মোদির সাথে। এ সময় বাংলাদেশে হিন্দু ও সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। এ নিয়ে শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ পোস্ট করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এক্স-এ দেওয়া পোস্টে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে একটি টেলিফোন কল পেয়েছি। এ সময় বাংলাদেশে বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের হিন্দু ও সকল সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেন।’

এই টেলিফোনের মাধ্যমে ড. ইউনূস একজন সুপ্রতিবেশী হিসেবে দায়িত্বশীলতারই পরিচয় দিয়েছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে তিনি সংখ্যালঘুদের সাথে সত্যিকার অর্থে কী ঘটেছে, সেটি দেখতে বাংলাদেশে এসে ভারতীয় সাংবাদিকদের রিপোর্ট করার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি যখন উত্থাপন করেছেন তখন প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, সংখ্যালঘুসহ বাংলাদেশের সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একইসাথে ড. ইউনূস ভারতীয় সাংবাদিকদের বাংলাদেশে এসে সংখ্যালঘুদের ইস্যু নিয়ে তাদের মাঠ পর্যায় থেকে প্রতিবেদন করার আহ্বান জানিয়েছেন। ড. ইউনূস সম্ভবত সাংবাদিকদের আহ্বান জানিয়ে একটি সূক্ষ্ম কূটনৈতিক মার দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদিকে। কারণ, স্বাধীন সাংবাদিকতা মোদির জন্য একটা আতঙ্ক। সেটা তিনি বার বার প্রমাণ করেছেন। বিশেষ করে, ২০০২ সালের গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে তার ইন্ধন ও পৃষ্টপোষকতায় সেখানে সংঘটিত দাঙ্গায় কয়েক হাজার মুসলিম নিহত হন, আহত হন অগনিত আর ধর্ষিত হন বহু মুসলিম নারী। তারপর থেকেই ‘গুজরাটের কসাই’ খ্যাতি জুটে যায় তার। আর এই চরম মানবতাবিরোধী অপকর্মের জন্য বিশ্বজুড়ে হন সমালোচিত, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কবলেও পড়তে হয় তাকে। এরপরেও সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলিম বিদ্বেষী বহু বক্তৃতা দিয়েছেন, উসকানি দিয়েছেন, এখনো সেটাই করে যাচ্ছেন মোদি।

শুধু মুসলিম বিদ্বেষই নয়, বরং মোদির শাসনামলে সে দেশে বসবাসরত খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ এমনকি নি¤œ বর্ণে হিন্দুদের বিরুদ্ধেও ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে তাদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন করা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সংবিধান পরিবর্তন ও বিভিন্ন আইন করে ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে মুসলিমবিদ্বেষ তৈরি অব্যাহত রেখেছেন তিনি। এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ার আতঙ্ক তাকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়। এ কারণেই তিনি কখনো সাংবাদিকদের মুখোমুখী হওয়ার সৎসাহস দেখাতে পারেন না। তাছাড়া বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে সত্য ও সঠিক তথ্যের পরিবর্তে নিজেদের পছন্দ মতো মিথ্যা ও গুজব প্রচারেই ব্যস্ত থাকে মোদি প্রশাসন। বাংলাদেশে ভারতীয় সত্যানুসন্ধানী কোনো সাংবাদিক এলে মোদি সরকারের সেসব কপটতার মুখোশ খুলে যাওয়ার ভয় আছে।

গুজরাটের দাঙ্গা নিয়ে ২০২৩ সালের শুরুতে একটি ডকুমেন্টারি প্রচার করে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি। তারপর থেকে বিবিসির বিরুদ্ধে স্টিম রোলার চালাতে দেখা যায় মোদি প্রশাসনের পক্ষ থেকে। ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এক দশকের শাসনামলে দেশটিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলিমদের অধিকার ক্রমশ কমে আসছে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন সিএএ মুসলিমবিরোধী। দেশটির একমাত্র মুসলিম অধ্যুষিত জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করেছে মোদি সরকার। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের স্থানে রামমন্দির নির্মাণ করেছে। একাধিক রাজ্যে গরুর মাংস বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোনো কোনো রাজ্যে প্রকাশ্যে মুসলমানদের ইবাদত-বন্দেগি করাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মুছে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে মুঘল আমলের বিভিন্ন ঐতিহ্যের নাম ও স্মৃতিচিহ্ন। ঘর ওয়াপসির নামে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের জোর করে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করা হয়েছে। ফ্রিজে গরুর মাংস আছে, এমন অজুহাতেও ভারতের বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অনেক জায়গায় অত্যাচার করে জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিতে বাধ্য করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ধর্মীয় জনগোষ্ঠী হিসেবে সেখানকার মুসলিমরা প্রতিনিয়ত নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। নাগরিকপঞ্জির নামে আসামে লাখ লাখ মুসলমানকে উন্মুক্ত কারাগারে রাখা হয়েছে। তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে মুসলমানদের নানা ছলচাতুরির মাধ্যমে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার পাঁয়তারাও চলছে। তারপরও মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য বা উসকানি বন্ধ করেননি মোদি এবং তার দল বিজেপি নেতৃবৃন্দ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ৬৩ শতাংশ ভাষণই ছিল ঘৃণা উদ্রেককারী। গত ১৬ মার্চ নির্বাচনী আচরণবিধি কার্যকর হওয়ার পর জনসভায় প্রধানমন্ত্রী মোদির দেওয়া ১৭৩টি বক্তব্য বিশ্লেষণ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, ১১০টি (৬৩ শতাংশ) ভাষণে মোদি ‘ইসলামভীতি’ তথা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন।

মোদি নিজে একজন সাম্প্রদায়িকতার পৃষ্টপোষক, বিশেষ করে ইসলাম এবং মুসলিম বিদ্বেষ তার প্রতিটি কাজেকর্মের লক্ষ্যবস্তু। নির্বাচনের পূর্বে ইসলামভীতি ছড়িয়ে হিন্দুদের ভোট বগলদাবা করাই তার উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ নিয়েও তার সেই একই সাম্প্রদায়িকতার কার্ড খেলে যাচ্ছেন ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। ন্যূনতম জনপ্রিয়তা না থাকার পরও আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে এই ইসলামভীতিকেই হাতিয়ার বানিয়েছেন মোদি এবং তার প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বকে বুঝিয়েছেন, যেকোনো মূল্যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে হবে। না হলে ইসলামন্থীরা ক্ষমতায় এসে যাবে। বাংলাদেশের পরিণতি হবে আফগানিস্তানের মতো। তাই বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা যাবে না। নয়াদিল্লির এ আবেদন শুনেই নাকি হাসিনা বিরোধিতার সুর নরম করেছিল ওয়াশিংটন। প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদপত্র দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য মতে, চলতি বছরের শুরুতেই বাংলাদেশ ইস্যুতে কথা হয়েছিল ভারত-আমেরিকার। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পরিস্থিতি নিয়ে সুর চড়িয়েছিল ওয়াশিংটন। বাংলাদেশ পুলিশের একটি অংশের উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়েছিল। হাসিনার নাম উল্লেখ করে তুমুল সমালোচনা করে মার্কিন প্রশাসন। গণতন্ত্রের বিরোধী বাংলাদেশিদের ভিসা দেয়া বন্ধ করে দেয়া হবে বলেও জানানো হয়। এমন পরিস্থিতিতে মাঠে নামে ভারত। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি সুর নরম করতে অনুরোধ জানানো হয় আমেরিকার কাছে। কারণ হিসাবে বলা হয়, বাংলাদেশে যদি বিরোধীরা ক্ষমতা দখল করে তাহলে ভারতের জাতীয় সুরক্ষা বিঘিœত হতে পারে। কারণ, বিরোধীরা বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক হাব’-এ পরিণত করবে।

আরও পড়তে পারেন-

কিন্তু বাস্তবতা হলো ভারতের এসব বক্তব্য মিথ্যা ও প্রপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ভারত চেয়েছে তাদের একনিষ্ঠ অনুগত শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখে নিজেদের স্বার্থ হাসিল অব্যাহত রাখতে। ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে জয় লাভের পর থেকে শেখ হাসিনার সরকার ভারতকে শুধু দিয়েই গেছে, বিনিময়ে দেশ এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষায় কোনো কিছু আদায় তো দূরের কথা, তারা সেটা প্রত্যাশাও করেনি। শেখ হাসিনা শুধু চেয়েছেন ভারতের প্রয়োজন এবং অন্যায় আবদার মিটিয়ে নিজের ক্ষমতাকে নির্বিঘœ করতে। সেকারণেই দীর্ঘদিনের সমস্যা তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির ব্যাপারে ভারত কোনো উদ্যোগ না নিলেও শেখ হাসিনা বিনা শর্তে ফেনী নদীর পানি উত্তোলনের অনুমোতি তাদের দিয়েছেন। তাদের জন্য চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। বাংলাদেশের রাস্তা ব্যবহার করে ভারতীয় যানবাহনকে পশ্চিম অংশ থেকে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে যাওয়ার অনুমোতি দিয়েছেন। রেল করিডোর দিয়েছেন। আমাদের দক্ষিণাঞ্চলে বঙ্গপোসাগরে অবাদে নজরদারি বৃদ্ধির ব্যাপারে ভারতকে সুযোগ করে দিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূলে চীন গভীর সমুদ্র বন্দর করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেও ভারতের অনিহার কারণে চীনকে সেটি করতে দেয়া হয়নি। উত্তারঞ্চলের তিস্তা পাড়ের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ প্রকল্পে চীনের আগ্রহ থাকার পরেও ভারতের অনিহার কারণেই সেটিও আটকে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতকে তুলে দেওয়া হয়েছে ভারতীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাতে। সীমান্তে বিএসএফ পাখির মতো গুলি করে বাংলাদেশিদের হত্যা করলেও ভারতকে তুষ্ট রাখতে নতজানু থেকেছে শেখ হাসিনার সরকার। সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবিকে এসব ঘটনায় নাকি পিঠ দেখাতে বলেছিল শেখ হাসিনার সরকার। ব্যবসা-বাণিজ্য, কূটনীতি, নিরপত্তা এমন কোনো খাত নেই, যেখানে আওয়ামী লীগ সরকার একপেশেভাবে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করেনি। শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘ভারতকে যা দিয়েছি তা তারা সারা জীবন মনে রাখবে।’ ভারতের স্বার্থ রক্ষা ছাড়াও চরম দুর্নীতি, লুটপাট আর অর্থ পাচারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। বিভিন্ন শিল্পকারখানাকে ধ্বংস করে দিয়ে ভারতের উন্মুক্ত বাজারে পরিণত করা হয়েছে দেশকে।

মূলত এসব কারণেই বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ এবং তাদের পৃষ্টপোষক ভারতের প্রতি বিদ্বেষ ক্রমাগত বেড়েছে। সেই বিদ্বেষ যত বেড়েছে, শেখ হাসিনা ততই নিষ্ঠুরভাবে তা দমন করেছেন। ফলে গুম-খুন, নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। বিরোধী দল-মতের অস্তিত্বও যেন টিকে থাকতে না পারে তার জন্য যত রকমের নির্দয়-নিষ্ঠুরতা চালাতে হয়, তার সবই করেছেন তিনি। কিন্তু সব কিছুরই শেষ আছে। অনিবার্যভাবেই সব স্বৈর শাসকেরই পতনও আসে। শেখ হাসিনারও তাই হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অতি সামান্য এবং ন্যায্য কোটা সংস্কারের দাবিতে সৃষ্ট আন্দোলনকেও যখন তিনি ফ্যাসিবাদী কায়দায় দমন করতে গেছেন, তখন সেটি পারমাণবিক বোমার মতো বিস্ফোরিত হয়েছে সকলস্তরের মানুষের মধ্যে। শিক্ষার্থীরাও অসীম সাহস নিয়ে বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে। সহস্ত্রাধিক তাজা প্রাণের বিনিময়ে গড়ে তুলেছে অভেদ্য এক জীবন্ত দেয়াল। সমস্ত শক্তি দিয়েও যা ভাঙতে ব্যর্থ হয়ে জনরোষ থেকে বাঁচতে গদি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন হাসিনা। নিজেদের অনুগত সরকারের অপ্রত্যাশিত পতনের যন্ত্রণায় কাতর মোদি সরকার এখন দিশেহারা। এর আগে তারা আফগানিস্তানে অনুগত সরকারের পতন দেখেছে, পতন দেখেছে শ্রীলঙ্কাতে, পতন দেখেছে নেপাল, ভুটান এবং মালদ্বীপের মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিবেশী দেশেও। সর্বশেষ বাংলাদেশেও বাধ্যগত সরকারের গদি উল্টে যাওয়া তাদের পক্ষে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে পালানোর পর থেকেই তারা ইসলামভীতি আর সংখ্যালঘু কার্ড খেলা শুরু করেছেন নতুন করে।

কিন্তু যে ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে ভারতীয় নাগরিক এবং বিশ্বনেতৃবৃন্দকে বাংলাদেশ নিয়ে আতঙ্কিত করার চেষ্টা মোদি সরকার করছে তার কোনোটাই ধোপে টিকছে না। সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে ভারতীয়রা বাংলাদেশের ব্যাপারে অনবরত মিথ্যা গুজব ছড়াচ্ছে। শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে এদেশে হিন্দুদের বাড়ি-ঘর-মন্দির জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাদের হত্যা করা হচ্ছে, এমন মিথ্যা তথ্য দিয়ে বানানো কন্টেট ছড়ানো হচ্ছে। শুধু সামাজিক মাধ্যম নয়, ভারতের মূল ধারার গণমাধ্যমেও বাংলাদেশে হিন্দুদের নির্যাতন করা হচ্ছে বলে একের পর এক মিথ্যা সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। আর এসব করার পেছনে মোদি সরকারের ইন্ধন রয়েছে বলেও অনুমান করা কঠিন কিছু না। কারণ, বিজেপির অনেক সংসদ সদস্যকেও এসব মিথ্যা প্রপাগান্ডাকে ভিত্তি করে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে। এমনকি বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাঠিয়ে এর বদলা নিতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানাতে দেখা গেছে। কিন্তু তাদের এসব প্রপাগান্ডা কোনোভাবেই হালে পানি পাচ্ছে না। কারণ, অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং দেশি-বিদেশি অনেক ফ্যাক্ট চেকার এসব গুজব শনাক্ত করে সঠিক সংবাদ প্রচার করে তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে। তাছাড়া ভারতের পৃষ্টপোষকতায় দীর্ঘদিনের ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়ে আওয়ামী লীগ ও তার বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের দুষ্কৃতিকারীরা হিন্দুদের বাড়ি-ঘর-মন্দিরে হামলা করে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করেছিল, তাদের সেই ষড়যন্ত্রের জালও ছিন্ন করে দিয়েছে এদেশের মানুষ। বিশেষ করে, যে ইসলামপন্থীদের ভয়ে তারা অস্থির সেই ইসলামপন্থী দলগুলো এবং মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই হিন্দুদের বাড়ি-ঘর-মন্দির পাহারা দিয়ে তাদের রক্ষা করেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু হিন্দুকে উসকানি দিয়ে আন্দোলনে নামানো হয়েছিল, কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হয়েছে ভারত এবং তার দোসরদের কূট চাল। আর এটা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশে বসবাস করা বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষের মধ্যে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কারণেই।

শেখ হাসিনার পতনের পর তিন দিন বাংলাদেশে আক্ষরিক অর্থে কোনো সরকার ছিল না। এই অবস্থায় অরাজকতা খুবই স্বাভাবিক বিষয় ছিল। তার উপর ছিল ভারতীয় এবং আওয়ামী কূটচাল এবং নানা ষড়যন্ত্র। সব কিছু ছিন্ন করে যেভাবে এদেশের মুসলমানরা বুক পেতে দিয়ে হিন্দুদের রক্ষা করেছে, মোদির ভারতে মুসলমানসহ সংখ্যালঘুরা একইভাবে নিরাপত্তা পাবে, এই প্রত্যাশা কি বিশ্ববাসী করতে পারে? তারা সেটা পারছে না কেন? সে দেশে বসবাস করা বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠি ও ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় তাদের ব্যর্থতার কারণ কী? আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস পরবর্তী কোনো সুযোগে এই প্রশ্ন মোদির কাছে উত্থাপন করবেন। কারণ, ভারতের সংখ্যালঘু তথা মুসলমানরা নির্যাতিত-নিপীড়ত হলে তার প্রভাব এখানেও পড়ে। আমরাও উদ্বিগ্ন হই, উদ্বিগ্ন হয় বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়।

ইমেইল- sayedibnrahmat@gmail.com

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।