Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ স্বাধীনতা হারানোর ইতিহাসও আছে

স্বাধীনতা হারানোর ইতিহাসও আছে

মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সমাজচিন্তক, কলামিস্ট ও লেখক।
।। কাজী সাইদ।।

১৯৪৫ সালে কাজী লেন্দুপ দর্জি খাং শেরপা সিকিম প্রজামণ্ডল নামে এক রাজনৈতিক দল গঠন করে এর সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে তিনি সিকিম স্টেট কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকেন। ১৯৬২ সালে সিকিমের স্বতন্ত্র দল, রাজ্য প্রজা সম্মেলন এবং সিকিম স্টেট কংগ্রেস ও সিকিম ন্যাশনাল পার্টির কিছু দলছুট নেতাদের নিয়ে গঠন করেন সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস। গোত্র কলহ, রাজতন্ত্রের বিরোধিতা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবিকে সামনে রেখে এ দলের যাত্রা শুরু হয়।এপ্রিল ১৯৭৩ সিকিম জনতা কংগ্রেসও এ দলের সাথে অঙ্গীভূত হয়ে যায়। লেন্দুপের মতে, এ দল গঠনের উদ্দেশ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করা, জনগণের শান্তি, উন্নতি এবং দেশের উন্নয়ন। তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনে তার দল ১৮টি মধ্যে আটটি আসন লাভ করে। ১৯৭০ সালের চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলরের পদ থেকে অব্যাহতি নেন।

উল্লেখ্য, উপমহাদেশ বিভক্তির সময় ব্রিটেন সিকিমের স্বাধীনতার প্রতি উদার নীতি অবলম্বন করে। সিকিমের স্বাধীন রাষ্ট্রীয় সত্তা বজায় থাকুক- ব্রিটেনের এ প্রত্যাশায় কোনো ঘাটতি ছিল না। সিকিমের প্রটেক্টরটের ক্ষমতা ব্রিটিশ রাজ ভারতের হাতে হস্তান্তর করে। কিন্তু অখণ্ড ভারতের স্বপ্নবিলাসী নেহেরু গণভোটের মাধ্যমে সিকিমের ভারত অন্তর্ভুক্তির সে চেষ্টা সফল হয়নি। প্রটেক্টরেট হিসেবে ভারত সিকিমের প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র এবং যোগাযোগব্যবস্থার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে।

সাংবিধানিক সরকারের আদলে চোগিয়ালের ভুটানে ১৯৫৫ সালে স্টেট কাউন্সিল গঠন করে, যা ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। ১৯৭০ রাজতন্ত্রবিরোধী সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি পুনর্নির্বাচন এবং নেপালি জনগোষ্ঠীর অধিকতর প্রতিনিধিত্ব দাবি করে। ১৯৭৩ সালের ভোটের ফলাফলে অসন্তুষ্ট হয়ে সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। সে আন্দোলন সরাসরি রাজতন্ত্রের পতন আন্দোলনে পরিণত হয়।

সিকিম জনতা কংগ্রেস এবং সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস একীভূত হয়ে এ আন্দোলন পরিচালনা করে। ১৯৬৫ সাল থেকে রাজ্য শাসনরত রাজা চোগিয়াল পলডেন থনডুপ নাম গয়াল বিক্ষোভ সংঘর্ষ থামানোর জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তা কামনা করেন।

আধিপত্যবাদী ভারত এ সুবর্ণ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল দীর্ঘদিন ধরে। ভারতীয় সৈন্যরা রাজার প্রাসাদ ঘিরে ফেলল। ভোরে নাম গয়াল তার জানালা খুলে দেখলেন, পুরো গ্যাংটক ভারতীয় সৈন্যদের দখলে। সাজানো নির্বাচন হলো। রাজতন্ত্রের পতনের পর ১৯৭৪ সালের নির্বাচনে লেন্দুপ দর্জির দল ৩২টি আসনের ৩১টিতেই জয়লাভ করে। ব্রুট মেজরিটি আর কাকে বলে। এ নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেটের ওপর ভর করে লেন্দুপ দর্জি নতুন গভর্নর নিয়োগের ক্ষমতা পেলেন।

চোগিয়াল আর লেন্দুপ দর্জির সাপে নেউলে সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ভারত পৃথিবীর মানচিত্র থেকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মানচিত্র মুছে ফেলার মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগাতে এক মুহূর্তও বিলম্ব করল না। কাউন্সিল অব মিনিস্টারের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী লেন্দুপ দর্জির ইচ্ছায় পার্লামেন্টে বিনা বিরোধিতায় রাজতন্ত্রের অবসান করা হলো। সিকিমের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লেন্দুপ দর্জি ভারতীয় পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করার এবং স্টেটহুড স্ট্যাটাস পরিবর্তন করার আবেদন জানান। ১৪ এপ্রিল ১৯৭৫ সিকিমে ভারতীয় সেন্যদের ছত্রছায়ায় এক গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। লেন্দুপের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখানো হয় গণভোটের ফলাফলে। ২৬ এপ্রিল ১৯৭৫ সিকিম ভারতের ২২তম অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়। ১৬ মে ১৯৭৫ সরকারিভাবে ভারত ইউনিয়নভুক্ত হয় এবং লেন্দুপ দর্জিকে করা হয় সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী।

রাজতন্ত্রের পতনের ফলে ‘চোগিয়াল’ পদের অবসান ঘটে। চীন ছাড়া অন্যান্য বেশির ভাগ জাতিসঙ্ঘের সদস্যরাষ্ট্র সিকিমের পরিবর্তনকে দ্রুত অনুমোদন করে। লেন্দুপ দর্জি সিকিম ভারতভুক্তির আগে ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সিকিমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভারতের অঙ্গীভূত হওয়ার সাথে সাথে তার দলও ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস দলে বিলীন হয়ে যায়।

ভারতীয় আধিপত্যবাদের সেবাদাস লেন্দুপ দর্জিকে ২০০২ সালে ভারত ‘পদ্মবিভূষণ’ খেতাবে ভূষিত করে। সিকিমের রাজ্য সরকার ২০০৪ সালে তাকে ‘সিকিমরত্ন’ উপাধি দেয়। পশ্চিমবঙ্গের নর্থ বেঙ্গলের নিজ শহর কালিম পংয়ে ১০৩ বছর বয়সে ৩০ জুলাই ২০০৭ সালে লেন্দুপ দর্জি মারা যান।

এই ভারতীয় দালালের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এক বিবৃতিতে লিখেছেন- “I am deeply shocked and grieved to learn of the sad demise of Shri Kazi Lhendup Dorjee Khang Serpa, the first Chief Minister of Sikkim. He played a historic role as the architect of Sikkim’s accession to the Indian Union and had the distinction of spearheading the State as its first Chief Minister from 1974 to 1979. The pride of place occupied by Sikkim as an important State of our country and its impressive progress in many spheres owe lot to numerous policies initiated by him.”

ভারতের নেতৃবৃন্দ বরাবরই অখণ্ড ভারত গড়ার স্বপ্নেবিভোর। আর সে লক্ষ্যে ভারত চায় এর প্রতিবেশী দেশগুলোকে নানাভাবে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে সেখানে লেন্দুপ দর্জির মতো তাঁবেদার সরকার বসিয়ে দেশটিকে ভারতের সাথে একীভূত করে নিতে। সিকিম তার বড় প্রমাণ। ভারতের প্রতিটি প্রতিবেশী দেশের মানুষকে এ অন্তর্নিহিত সত্যটি উপলব্ধিতে রেখে দেশ পরিচালনা করতে হবে। নইলে বিপর্যয় অবধারিত।

লেখক: মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সমাজচিন্তক, কলামিস্ট ও লেখক।

উম্মাহ২৪ডটকম: আইএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।