।। বিনতে জাহাঙ্গীর ।।
প্রকৃতির চিরন্তন সত্য, উপর হতে নিচে শুধু প্রবাহিত হয়। প্রবাহের ঢেউ নিচ হতে উপরে কমই উঠে! যে ঢেউয়ে উত্তালতা আছে, আছে সামনে বাড়ার অদম্য প্রতিজ্ঞা, সেই ঢেউই কেবল পূর্ণ স্ফীত হয়ে প্রবাহিত হয়ে উঠে আসে উপরে।
ঠিক তেমনি মা-বাবার ভালোবাসার প্রবাহ নেমে আসে সন্তানের উপর। পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে অসহায় হয়ে আগমনকারী ‘মানবকলি’ সিক্ত হয় সেই ভালোবাসার শিশিরে। সেই মমতার স্নেহ-মায়ায় সন্তান বুঝতে শিখে প্রকৃতি, পরিবার, সমাজ ও পৃথিবী। মা-বাবার প্রগাঢ় ভালবাসার প্রবাহ যদি তাকে ছায়া না দিতো, হয়তো অনেক অপূর্ণতা থেকে যেতো তার মাঝে। মা-বাবার কাছে সন্তানের এই যে ঋণের এক দায়বদ্ধতা, তা কি সন্তান অনুভব করে? জগতের বুকে রব্বে কারীম তাই তো দিয়েছেন অনেক ইয়াতীম শিশু। পথে-ঘাটে, এদিক-ওদিক, ফুটপাথে উদ্দেশ্যহীন জীবন যাপিত হয় কত শিশুর! সেই সন্তানদের মনের বাসনা থাকে কেবলই ‘আহা! যদি ছুঁয়ে দেখতে পারতাম মায়ের পরম আচঁল! যদি পেতাম বাবার উষ্ণ আদর!’ এই সন্তানগুলোর অশ্রুজলে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বার্তা। আমরা যারা বিনা যাচ্ঞাতেই পেয়েছি মা-বাবার পূর্ণ স্নেহ-ছায়া।
আজকের সমাজ আমাদেরকে নিষ্ঠুর ও নির্মম সব দৃশ্য অবলোকন করাচ্ছে। মা-বাবার আদরে পালিত এই সন্তানগুলোও যে মাঝে মাঝে হতে পারে এমন নির্মম, যবানে প্রকাশ করতে পারে এমন খতরনাক কথা; ভাবাও যায় না! বড় লজ্জা ও বেদনাহত হলেও, বাস্তব সত্যি এই যে, সন্তানদের দ্বারা আজ হাজারো ‘অসহায় মা-বাবা’ নিপীড়িত! তবুও প্রতিনিয়ত এসব হৃদয়বিদারক ঘটনা হৃদয়কে আন্দোলিত করে; রক্তাক্ত করে। কম দুঃখেই কি আরেকজন লিখেছেন- ‘মা-বাবারা আজ সন্তানের হাতে যেনো বন্দী’! এই একটি মাত্র বাক্যই আজকের সমাজের মা-বাবা ও সন্তানের মাঝে সম্পর্কের বিষয়টি কিঞ্চিত হলেও ফুটে ওঠে। বড় অবাক হয়ে ভাবি যে, ‘অসহায় মানবশিশু’কে মা-বাবা পরম মমতায় আগলে নেন বুকে। কিন্তু এই মা-বাবারা যখন জীবনের এক পর্যায়ে ‘অসহায়কর’ পরিস্থিতির মুখে পড়েন, কিংবা তার আগেই সেই ‘মমতাস্নিগ্ধ সন্তানরা’ কীভাবে তাদের দূরে ঠেলে দেয়! দুর্ব্যবহারে জর্জরিত করে! তার মানে এই নয় যে, পুরো সমাজের চিত্রই এরকম; বরং এখনো অনেক সন্তান রয়েছেন, যারা প্রার্থনা করেন- ‘হে আমার রব! মা-বাবাকে করো রহম, যেমন শৈশবে তাঁরা আমায় করেছেন লালন’ এবং নিজেও রহমত ও দয়ার আচরণ করেন তাঁদের সাথে।
মা-বাবার হক অনেক। কুরআন-হাদিসে মা-বাবার মর্যাদা-সম্মান বিষয়ে অসংখ্য বাণী রয়েছে। যেসব গুনাহের শাস্তি আল্লাহ তাআলা দুনিয়ায় থাকতে কিছুটা হলেও আস্বাদন করান। এর মধ্যে অন্যতম হলো ‘মা-বাবার অবাধ্যতা’। হাদিসে এসেছে- رضا الرب في رضا الوالد وسخط الرب في سخط الوالد অর্থাৎ- নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, পিতা-মাতার সন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি এবং পিতা-মাতার অসন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টি নিহিত। (তিরমিযী)।
আমার স্বল্প জ্ঞানে মনে হয়, মা-বাবার সকল সম্মান ও সর্বোচ্চ গুরুত্ব এই হাদিসে এসে গেছে। কারণ, মুমিন জীবনের প্রধানতম লক্ষ্য হলো আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন। আর রবের সন্তুষ্টি মানে আখিরাতের অনন্ত জীবনে জান্নাতের নিশ্চিন্ত আবাসন, সবরকম নিয়ামত প্রাপ্তি। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে পিতা-মাতার আনুগত্য ও সন্তুষ্টির মাঝে। অর্থাৎ মা-বাবার যদি সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়, তাঁর জীবনের কামিয়াবি অনেকখানি নিশ্চিত, ইনশাআল্লাহ।
বয়স হলে মানুষ শিশুদের মতো দুর্বল এবং অবুঝ হয়ে যায়। বায়না ও জেদ ধরেন। অসম্ভব বিষয় আবদার করেন। যার সমর্থন পাওয়া যায় রবের এ আয়াতে- اَللّٰهُ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ مِّنۡ ضُؔعۡفٍ ثُمَّ جَعَلَ مِنۡۢ بَعۡدِ ضُؔعۡفٍ قُوَّۃً ثُمَّ جَعَلَ مِنۡۢ بَعۡدِ قُوَّۃٍ ضُؔعۡفًا وَّ شَیۡبَۃً ؕ یَخۡلُقُ مَا یَشَآءُ ۚ وَ هُوَ الۡعَلِیۡمُ الۡقَدِیۡرُ “আল্লাহ তাআলা সেই সত্তা, যিনি তোমাদের সৃষ্টি (শুরু) করেছেন দুর্বল অবস্থা হতে। দুর্বলতার পর তিনি দান করেন শক্তি, ফের শক্তির পর তিনি দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা চান সৃষ্টি করেন এবং তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। (সূরা রুম- ৫৪)।
অর্থাৎ- মানুষের জীবন শুরু হয় শৈশবের দুর্বলতা দিয়ে। সর্বশেষ পুনরায় মানুষ আবারও সেই দুর্বলতায় ফিরে যায়, তার সাথে থাকে বার্ধক্য। বার্ধক্যই এক ধরনের অসুস্থতা, যা মানুষের শিশুসুলভ আচরণ, দুর্বলতা ইত্যাদি সবকিছুকে বাড়িয়ে দেয়।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
বৃদ্ধ মা-বাবার সেই পরিস্থিতিগুলো সবরের সাথে মেনে নেওয়া একজন সন্তানের নৈতিক দায়িত্ব। তাই তো রব ইরশাদ করেছেন- وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَ قُلْ رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِيْ صَغِيْرًا “তাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে বিনয়ের ডানা বিছিয়ে দাও ও প্রার্থনা করো ‘হে আমার রব! তাদের উপর রহম করুন, যেমন শৈশবে তাঁরা আমায় লালন পালন করেছেন”। (সূরা ইসরা- ২৪ আয়াত)।
আহ! কী বিনয় ও নম্রতার হকদার তাঁরা! হবেইনা কেন! সেই অবুঝ- অসহায় শিশু থেকে তিলে তিলে স্নেহ-মমতা, আদর-শাসন, কষ্ট-পরিশ্রম, অর্থ খরচ করে আগলে রাখেন তাঁরা সন্তানকে। নিজেদের সাধ- স্বপ্নগুলো অপূর্ণ রেখে পূর্ণ করেন সন্তানের হাজারো চাওয়া।
তারপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া সেই সন্তান কি পিছে ফিরে দেখে সময়ের সাথে অবুঝ- বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া সেই মা-বাবাকে? ‘প্রাপ্য-প্রাপ্তির’ হিসেবই কি বড় হয়ে দাঁড়ায় সন্তানের কাছে? মা-বাবা কি এখন সুখী পরিবারের জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন? অনেক ক্ষেত্রে মানুষের সামনে তাঁদের অবুঝ- অসম্ভব আবদার-জেদকে মনে হচ্ছে সামাজিকভাবে নিজে ‘ছোট’ হবার কারণ।
হ্যাঁ, অত্যন্ত পরিতাপ ও আফসোসের বিষয় হলো, সমাজের আজ প্রায় অধিকাংশ ঘরই অলিখিত একেকটি ‘আধুনিক বৃদ্ধাশ্রম’! ‘লোকে কী বলবে’ এ ভয়ে ‘বৃদ্ধাশ্রম’ এ রেখে আসতে পারেন না অনেকেই, কিন্তু দিনের পর দিন মানসিক-শারীরিক নির্যাতনে ঘরকে তাঁদের জন্য পরিণত করেছে জেলখানায়! বৃদ্ধাশ্রমগুলোতেও হয়ত এমন সব নির্যাতন থাকে না। থাকে কেবল সন্তান-বিরহে থাকা মা-বাবার অশ্রুজল! বৃদ্ধ মা-বাবার সাথে কেন দুর্ব্যবহার, আর নানান রকম মানসিক নির্যাতন?
আবার এমন অনেককে দেখা যায়, যারা মা-বাবার কাছ থেকে নানান সুযোগ-সুবিধা পাওয়া ও না পাওয়াকে উপলক্ষ্য টেনে তাঁদের সাথে উত্তম ব্যবহারের পরিধি নির্ধারণ করেন; নাঊযুবিল্লাহি মিন যালিক। এই ভয়ংকর চিন্তার বিস্তারই আজ সন্তানদের (বিশেষত তরুণদের) মাঝে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।
বিবেকের দুয়ারে কড়া নেড়ে সন্তানদের উদ্দেশ্যে কয়েকটি কথা আরয করতে চাই-বংশগত বা পারিবারিক কারণে, মানসিক বা শারীরিক কারণে,আপনার মা হতে পারে ভিন্ন! কিন্তু ‘গর্ভধারণ ও দুনিয়ায় আনয়ন’ যন্ত্রণায় তিনি এবং অন্যসব মা এক ও অভিন্ন।
আপনার মা আপনার খিদমাত ও ভালো ব্যবহারের হকদার ঐ দু’টি কারণে (‘গর্ভধারণ ও দুনিয়ায় আনয়ন’), তাঁর আচরণের কারণে নয়। কুরআন যেখানে মা-বাবার সামনে সন্তানকে ‘উফ’ বলতে নিষেধ করেছে, সেখানে অন্য কিছুর সুযোগ কোথায়?!
যাদের দিকে তাকালে হজ্জের সাওয়াব, সেই পবিত্র চেহারা দু’টির দিকে রাগত চোখে তাকানো কতোটা গুনাহ ও দুর্ভাগ্যের কাজ হতে পারে?
যাদের উসিলায় দুনিয়ায় এলাম, তাঁদের ভুলে যাওয়া কতোটা লজ্জার কথা হতে পারে! যাদের শক্তি-শ্রম, অর্থ-ঘর্মে নির্ভর করে স্বাবলম্বী হলাম, তাঁদের সামনে কতোটা গভীর আদব, বিনয় ও আন্তরিকতার সাথে দাঁড়ানো উচিত?!
যেই মা-বাবার সন্তুষ্টি রহমানকে সন্তুষ্ট করে; তাঁদের গায়ে হাত তোলা..! নাঊযুবিল্লাহ।
পরিশেষে সবিনয়ে আরয করতে চাই, যদি জীবনে সামনে বাড়ার অদম্য ইচ্ছে থাকে, তবে সুখের সংজ্ঞা কেবলমাত্র স্ত্রী-সন্তানের মায়াবী মুখের মাঝেই যেন সীমাবদ্ধ না হয়। হে আমার ভাই; বরং মায়ের ছানিপড়া চোখের প্রার্থনা-ছোঁয়া চাহনিতে ও বাবার শুষ্ক ওষ্ঠের দোয়াতেও খুঁজে ফিরুন জীবনের সফলতা ও কামিয়াবি।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ