Home ওপিনিয়ন হিন্দুজার ঘটনায় ফিরে আসা কুকুর কিংবা এ সময়ের ছাগলের গল্প

হিন্দুজার ঘটনায় ফিরে আসা কুকুর কিংবা এ সময়ের ছাগলের গল্প

জাহিদ নেওয়াজ খান: ১৫ লাখে ছাগল কেনা হলে একেকটি পায়ের দাম পড়ছে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এখন, যে-সে নয়; একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার শুরুর বেতন যদি ৪০ হাজার টাকা হয়, তাহলে ছাগলটির একটি পা কিনতে ওই কর্মকর্তার কত মাসের বেতন লাগবে? পণ্ডিত মশাইয়ের মতো আর বললাম না, ওই অফিসার ওই ছাগলের ক’টা ঠ্যাঙের সমান?

কুবের কে ছিলেন? আর ধনকুবের কে? বাস্তবের কুবের সর্বহারারও সর্বহারা। পৌরাণিক কাহিনীর কুবের বিশ্বের সবচেয়ে ধনাঢ্য।

যারা একটু-আধটু সাহিত্য পড়েছেন, বিশেষ করে পাঠ্য হিসেবে হলেও; তাদের কাছে কুবের হলেন পদ্মানদীর মাঝি। না পড়লেও সিনেমায় অনেকে দেখেছেন। বিশেষ করে কপিলা যাকে বলেছিলেন, ‘ডরাইলা মাঝি!’

এ কুবের অতিশয় দরিদ্র। অথচ যাঁর নামে তার নাম, সেই আসল কুবের পৃথিবীর ধনাধ্যক্ষ। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে কুবের হলেন ধনসম্পদের দেবতা।

সবাই কুবের বলতে দেবতা কুবেরকে চিনবেন না। সে কারণেই হয়ত কুবেরের আগে ধন শব্দটি যোগ করা হয়েছে। ধনাঢ্য ব্যক্তি বোঝাতে বাংলা ভাষায় যোগ হয়েছে ধনকুবের।

কে ধনকুবের আর কে কুবের, সেটা একটা আপেক্ষিক বিষয়। তবে, ফোর্বস ম্যাগাজিন বা এমন জায়গায় ধনীদের তালিকায় নাম করে নেওয়াদের ক্ষেত্রে কোনো আপেক্ষিকতা নেই। নেই কোনো বিতর্কও।

এই ধনকুবেররা নানা কারণে সময় সময় আলোচিত হন। কেউ কেউ দান-খয়রাত সূত্রে আলোচনায় থাকলেও নানা স্ক্যান্ডালেও জড়িয়ে পড়েন অনেকে। আর কারণে-অকারণে সাংবাদিকরাও তাদের পেছনে লেগে থাকেন। পান থেকে চুন খসলেই খবর হয়ে যান তারা। হবেনই বা না কেন! মাঝি কুবেরদের জীবন নিয়ে মাথাব্যথা না থাকলেও ধনকুবেরদের নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই।

এরকমই একটি নাম হিন্দুজা পরিবার। ফোর্বস ম্যাগাজিনের হিসাবে তারা বিশ্বের ১৪৬তম ধনী। ভারতে সপ্তম। আর যুক্তরাজ্যে তারা সবচেয়ে ধনী ভারতীয়। এখন অবশ্য তারা সুইজারল্যান্ডনিবাসী।

এই পরিবারটি গতরাত থেকে গণমাধ্যমের খবর। কারণ সুইস আদালতে তাদের কারাদণ্ড। মানবপাচারের অভিযোগ থেকে মুক্তি পেলেও গৃহকর্মীদের নির্যাতন এবং খুবই কম বেতন দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের শাস্তি হয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকার খবরটি একটু দেখে নেওয়া যাক:

“তাঁরা ভারত থেকে সামান্য বেতনে লোক নিয়ে এসে তাঁদের প্রাসাদোপম বাড়িতে গৃহ পরিচারকের কাজ করাতেন। পরিণত করতেন কার্যত ক্রীতদাসে! শ্রম আইনের তোয়াক্কা না করে দৈনিক ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করানো হত। সামান্য ভুলচুক করলেই সেই পরিচারকদের অত্যাচারের শিকার হতে হত।

আরও পড়তে পারেন-

সেই অপরাধে এ বার অনাবাসী ভারতীয় বংশোদ্ভূত ধনকুবের পরিবার হিন্দুজাদের চার সদস্যকে জেলের সাজা দিল সুইৎজ়ারল্যান্ডের জেনিভার একটি আদালত। বর্তমানে সুইস নাগরিক হিন্দুজা পরিবারের দণ্ডিতেরা হলেন— প্রকাশ হিন্দুজা, তাঁর স্ত্রী, ছেলে ও পুত্রবধূ। কারাদণ্ডের সর্বোচ্চ মেয়াদ সাড়ে চার বছর।

হিন্দুজা পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, জেনেভায় হ্রদের ধারে বিলাসবহুল বিশাল ভিলায় কাজ করার জন্য তাঁরা ভারত থেকে মানব পাচারের মাধ্যমে গৃহসহায়ক, গৃহসহায়িকা এবং পাচক নিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের দিয়ে অমানবিক পরিশ্রম করাতেন। অন্তত ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হত। বাড়িতে কোনও ভোজসভা বা আমোদ-প্রমোদ চললে, কাজ করতে হত ভোররাত পর্যন্ত। রান্নাঘরের মেঝেতেই চাদর পেতে শুতে হত তাঁদের। কোনও ছুটি দেওয়া হত না, এমনকি তাঁদের ভিলার বাইরে পা রাখতেই দেওয়া হত না।

কত বেতন পেতেন হিন্দুজার গৃহকর্মীরা

আদালতে শুনানির সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, সুইজারল্যান্ডে থাকলেও কর্মীদের বেতন দেওয়া হতো ভারতীয় মুদ্রায়। ভারতের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হতো তাদের বেতনের টাকা। শুনতে সুখকর মনে হলেও আসল ঘটনা হচ্ছে. সুইজ়ারল্যান্ডে এ ধরনের কাজের জন্য যে পারিশ্রমিক পাওয়া যায়, হিন্দুজার গৃকর্মীদের বেতন তার দশ ভাগের এক ভাগও ছিল না।

রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে যেসব প্রমাণ দাখিল করে তাতে দেখা যায়: একে ত কর্মীদের দিনে ১৮ ঘণ্টা কাজ করানো হতো। তার উপর দিনে তাদের মজুরি দেওয়া হতো ৬ পাউন্ডের একুট বেশি, ভারতীয় মুদ্রার যা মাত্র ৬৫৮ রুপি।

যেখানে মুজতবা আলীর সেই সারমেয়র প্রত্যাবর্তন

পুরো বছরের হিসাব করে সুইস আইনজীবীরা আদালতকে জানান, হিন্দুজা পরিবারের একেকজন বছরে ২ হাজার ২শ ৬০ পাউন্ড বা ২ লাখ ৪০ হাজার রুপির একটু বেশি পাচ্ছিলেন। সওয়াল-জবাবের সময় রাষ্ট্রপক্ষ সুইস আদালতকে এটাও জানান যে, হিন্দুজা পরিবার একেকটি পোষা কুকুরের জন্য বছরে ৭ হাজার ৬শ ১৬ পাউন্ড বা ৮ লাখ ৯ হাজার ১৪৩ রুপি খরচ করে। অর্থাৎ একেকটি কুকুরের পেছনে তাদের খরচ একজন মানুষ গৃহকর্মীর চারগুণ।

নিশ্চয় এখন সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পাদটীকা’ গল্পটি মনে পড়ছে।

ওই গল্পে লাট সাহেবের সঙ্গে যে কুকুরটিও স্কুল পরিদর্শনে এসেছিল তার জন্য মাসে খরচ হতো ৭৫ টাকা। একটা পা তার কম ছিল। মানে তিন পেয়ে সারমেয়ের জন্য খরচ মাসে ৭৫ টাকা। আর পণ্ডিত মশাইয়ের বেতন!

শ্রেণিকক্ষে পণ্ডিত মশাই বলেছিলেন: “অপিচ আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আটজন। আমাদের সকলের জীবন ধারণের জন্য আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা। এখন বল তো দেখি, তবে বুজি তোর পেটে কত বিদ্যে, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সায়েবের কুকুরের ক’টা ঠ্যাঙের সমান?”

হিন্দুজা পরিবার ত তবু ব্যবসা করে একজন গৃহকর্মীর বেতনের চারগুণ খরচ করছে একেকটি কুকুরের পেছনে। মানে একজন গৃহকর্মীর বেতন কুকুরের এক পায়ের সমান।

কিন্তু আমাদের এখানে যারা জনগণ ও রাষ্ট্রের টাকা গায়েব করে দিয়ে কোরবানীর ছাগল কিনছে ১৫ লাখ টাকায়! পনেরো লাখ টাকার এমন ক্রয়ে ছাগলের একেকটি পায়ের দাম পড়ছে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এখন, যে-সে নয়; একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার শুরুর বেতন যদি ৪০ হাজার টাকা হয়, তাহলে ছাগলটির একটি পা কিনতে ওই সরকারি কর্মকর্তার কত মাসের বেতন লাগবে?

পণ্ডিত মশাইয়ের মতো আর বললাম না যে, ওই অফিসার ওই ছাগলের ক’টা ঠ্যাঙের সমান?

সূত্র- টিবিএস-এর সৌজন্যে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা উম্মাহ টুয়েন্টিফোর ডটকম-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।