Home ফিকহ ও মাসায়েল বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় কুরবানীর গোশত বণ্টনে শরয়ী বিধি-নিষেধ

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় কুরবানীর গোশত বণ্টনে শরয়ী বিধি-নিষেধ

।। মুফতি ফরিদুল হক ।।

শরীয়তের পরিভাষায় মহান আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর নামে কোনো কিছু উৎসর্গ করার নামই কুরবানী। কুরবানীর দিন কুরবানী করা মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে সবচেয়ে বেশি পছন্দের। কুরবানীর মুখ্য উদ্দেশ্য তাক্বওয়া অর্জন করা। তাক্বওয়ার মাধ্যমেই আত্মা পরিশুদ্ধ হয়। কুরআনুল কারীমে বর্ণিত হয়েছে,

لَنْ یَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوْمُهَا وَ لَا دِمَآؤُهَا وَ لٰكِنْ یَّنَالُهُ التَّقْوٰى مِنْكُمْؕ

আল্লাহ তায়ালার কাছে কখনাে (কুরবানীর) গোশত ও রক্ত পৌছে না। বরং তাঁর কাছে তােমাদের তাক্বওয়াটাই পৌঁছে। (সূরা হজ্ব ৩৭)।

কুরবানীর অন্যতম শিক্ষা হলো সমাজের অভাবগ্রস্তদের সহমর্মিতার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পারস্পরিক সৌহার্দ প্রতিষ্ঠা করা। সেইসাথে আল্লাহর রাস্তায় মানুষের আপন সম্পদ উৎসর্গ করা। যিনি যত পরিমাণ সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবেন তিনি আল্লাহর তত নৈকট্য লাভ করবেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো এই পূণ্যের কাজ করতে গিয়ে অনেকেই সীমালঙ্ঘন করে ফেলে, বিশেষত; কুরবানীর গোশত বণ্টের ক্ষেত্রে। তাই সময়ের চাহিদা অনুপাতে প্রচলিত কুরবানীর গোশত বণ্টন বিষয়ক আমাদের দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার ফতোয়া বিভাগ বরাবর, টাঙ্গাইল সদর, ইমাম পরিষদ ৩নং ওয়ার্ড থেকে প্রশ্ন করা হয়েছে, সর্বসাধারণের ব্যাপক ফায়দার দিকে লক্ষ করে মাসিক মুঈনুল ইসলামের অনলাইন পেইজে দেওয়া হলো।

প্রশ্ন : প্রচলিত সামাজিক গোশত বণ্টনের বিধান কি?  

উত্তর: কুরবানীর গোশত কুরবানীদাতার ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্বাধীন ও ঐচ্ছিকভাবে  বণ্টন করা ইসলামের শুরু থেকেই চলে আসছে,পরবর্তীতে কিছু কিছু অঞ্চলে সামাজিক বণ্টনের পদ্ধতি চালু হয়,যা দ্রুত সর্বএ ছড়িয়ে পড়ে।

প্রচলিত সামাজিক বণ্টন পদ্ধতির ধরণ: কুরবানীদাতা প্রত্যেকে কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ মসজিদে বা সমাজের নির্দিষ্ট স্থানে দিয়ে আসেন। মসজিদ কমিটি বা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ সবার মাঝে জমাকৃত গোশত বণ্টন করে দেন। এপদ্ধতিতে সামাজিক কিছু সুবিধা রয়েছে,যেমন কুরবানীদাতার বাড়িতে গরীব-দুঃখীদের ভীড় থাকে না, দরিদ্রদের বাড়িতে বাড়িতে যেতে হয়না ইত্যাদি।

সামাজিকভাবে গোশত বণ্টনের শরয়ী বিধান: কুরবানী আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আতিথেয়তা। সমস্ত মুসলমান এ দিনগুলোতে আল্লাহর মেহমান।  কুরবানীর গোশত বিতরণ করা গরীবের প্রতি কুরবানীদাতার করুণা নয়; বরং তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মেহমানদারির প্রতিনিধিত্ব।  কাজেই প্রত্যেক কুরবানীদাতা আল্লাহর প্রতিনিধি হয়ে  সাওয়াব লাভের আশায় শরীয়ত সমর্থিত নিয়ম নীতিতে কুরবানীর গোশত মানুষের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া চাই।  এক্ষেত্রে শরীয়ত পরিপন্থী বা ইসলামী নীতি বহির্ভূত কোনো কাজ করা বা এমন কোনো রীতি অনুসরণ করার অবকাশ ‎নেই।

গোশত বণ্টনের শরয়ী দৃষ্টিভঙ্গি: শরীয়তে কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ সদাকা করার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু তা কুরবানীদাতার উপর আবশ্যকীয় নয়, বরং কুরবানীদাতা কতটুকু গোশত নিজে রাখবে, কতটুকু পরিমাণ সদাকা করবে এবং কাদের মাঝে বণ্টন করবে, এসব কুরবানীদাতার ইচ্ছাধীন বিষয়। তাই ব্যক্তিগত এবিষয়কে সামাজিক নিয়মে না নিয়ে ঐচ্ছিক রাখা চাই।

প্রচলিত সামাজিক নিয়মে কুরবানীর গোশত বণ্টনের কতিপয় ক্ষতির দিক:

১. অনেক কুরবানীদাতার পরিবারের সদস্য-সংখ্যা বেশি হওয়ায় অথবা অন্য কোনো যৌক্তিক কারণে নিজ পরিবারের ‎জন্য বেশি গোশত রাখার প্রয়োজন হয়; ফলে সে পরিবারের জন্য বেশি গোশত রাখতে চায়। আবার অনেকে তার ‎কোনো দরিদ্র আত্মীয়কে কুরবানীর গোশত দিতে চায়। কিন্তু সামাজিক এই বাধ্যবাধকতার কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ‎সামাজিক রীতি অনুযায়ী কুরবানীর এক তৃতীয়াংশ গোশত সমাজে দিতে বাধ্য হয়। অথচ হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

لا يحل مال امرئ مسلم إلا بطيب نفس منه. حديث صحيح أخرجه أحمد والبيهقي والدارقطني

কোনো মুসলমানের সম্পদ তার সন্তুষ্টি ব্যতীত হালাল নয়। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস ২০৬৯৫)‎।

২. প্রচলিত সামাজিক প্রথায় গোশতদাতা গোশত প্রদানে তার দানের অংশটি কাকে দেবে এ বিষয়ে স্বাধীনতা হারায়। হয়তো সে তার নিকটাত্মীয় অথবা ‎পরিচিত কাউকে একটু বেশি পরিমাণে দিত, কিন্তু এক্ষেত্রে তার জন্য এমনটি করার সুযোগ থাকে না,যা শরীয়ত পরিপন্থী কাজ।

৩. অনেক মানুষ এমন আছেন, যারা প্রত্যেকের হাদিয়া বা সদাকা গ্রহণ করতে চান না। আর শরীয়তও কাউকে সকলের ‎হাদিয়া বা সদাকা গ্রহণ করতে বাধ্য করেনি। কিন্তু সামাজিক এই রীতির কারণে গোশত গ্রহণকারী প্রত্যেকেই অন্য ‎সকলের হাদিয়া বা সদাকা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। বলাবাহুল্য এ ধরণের ঐচ্ছিক বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা ‎মোটেই সমুচিত নয়।

আরও পড়তে পারেন-

৪. এ ধরনের বাধ্যবাধকতা আরোপের আরেকটি ক্ষতির দিক হল, গোশত বিতরণের ক্ষেত্রে গোশতগ্রহণকারী ব্যক্তির উপর মসজিদে চাঁদা প্রদান করার শর্ত যুক্ত করা। অথচ চাঁদা প্রদান করা ঐচ্ছিক বিষয়।

মোটকথা, রাসূলুল্লাহ ‎সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম, তাবিয়ী ও তবেতাবিয়ীগণের জামানা থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত শত শত বছর যাবৎ কুরবানীদাতাগণ কুরবানীর অংশ দান করার বিষয়ে স্বাধীন ছিল। কুরবানীদাতাগণ স্বেচ্ছায় মানুষকে হাদিয়া বা সদাকা করতো। তাই ইসলামী শরীয়ার তাক্বাযা হলো কুরবানীর গোশত বণ্টনে তাদেরকে স্বাধীনতা দেওয়া, তাদের উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা কখনও কাম্য নয়।

সামাজিকভাবে যদি গোশত বন্টন করতেই হয় তাহলে নিম্নোক্ত শর্তসাপেক্ষে এ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে

(ক) গোশত প্রদানকে মসজিদে চাঁদা আদায়ের সাথে শর্ত না করে, অন্য কোনভাবে চাঁদা আদায়ের ব্যবস্থা করবে।

(খ) সমাজে গোশত প্রদানকে ঐচ্ছিকে রাখবে। গোশত না দিলে তিরস্কার ও সমাজচ্যুত করতে পারবে না।

(গ) সমাজের কুরবানীদাতারা সন্তুষ্টি চিত্তে উক্ত কাজে অংশগ্রহণ করবে। এ সমস্ত শর্তের সাথে সামাজিকভাবে গোশত বন্টন করা জায়েয হবে। (বাদায়িউসসানায়ে’খ.৪ পৃ.২২৪, আল মুহীতুল বুরহানী ৮/৪৬৯, আল মাবসূত ১২/১৮,)

প্রশ্ন: সমাজের গোশত একত্রিত করে সবার মাঝে গোশত বণ্টন করাকে দানের হাদিসের সাথে তুলনা করা কতটুকু সহীহ?

উত্তর : কুরবানীর গোশত ধনীরা নিজেও খেতে পারে এবং তার ধনী আত্মীয়, প্রতিবেশী বা বন্ধুবান্ধকেও খাওয়াতে পারে। কুরবানীর গোশত সমাজের নির্দিষ্ট স্থানে জমা হলেই গরীব ও সমাজের অন্যান্যরা মালিক হয়ে যায় না; বরং বন্টনের পূর্বে এসবের মালিকানা কুরবানীদাতাগণেরই হয়ে থাকে, পরবর্তীতে সমাজের লোকদের মাঝে জনপ্রতি গোশত বণ্টন করার পর প্রত্যেকই তার প্রাপ্য অংশটুকুরই মালিক হবে। যেহেতু গরীব ও অন্যান্য লোকেরা তাদের প্রাপ্য অংশটুকুরই মালিক, বিধায় কুরবানীদাতা কর্তৃক সমাজের নির্দিষ্ট স্থানে গোশত জমা দেওয়ার পর ফেরত পাওয়া অংশটুকুকে নিম্নোক্ত হাদিসের সাদৃশ্য বলা সঠিক নয়।

عن ابن عباس، عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال العائد في هبته كالكلب يقيء ثم يعود في قيئه.

ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সা🙂 বলেছেনঃ নিজের দান প্রত্যাহারকারী ব্যক্তি কুকুরের ন্যায়, যে বমি করে পরে সে তার বমি পুনরায় ভক্ষণ করে (সহীহ মুসলিম শরীফ, হাদিস নং১৬২২) এক্ষেত্রে কুরবানীদাতাগণের উক্ত জমাকৃত গোশত থেকে কোন ভাগ গ্রহণ না করাই উত্তম। যদি নিয়েও থাকে, তাহলে তিনি গরীব-দুঃখীদের কে আরো কিছু গোশত দান করে দিবেন, যাতে সদাকার অংশ এক তৃতীয়াংশের কম না হয়। কেননা সদাকা এক তৃতীয়াংশ থেকে কম না হওয়া মুস্তাহাব। (হেদায়া ৩/৪০১, আল বাহরুর রায়েক্ব ৮/৩২৬)

প্রশ্ন: মসজিদের ইমামগণ সমাজ থেকে গোশত গ্রহণ করতে পারবে কি?

উত্তর: কুরবানীর গোশত ধনী, গরিব, ইমাম, মোয়াজ্জিন সবাইকে দেওয়া যাবে, কিন্তু বিনিময় হিসেবে তাদের কাউকেই দেওয়া যাবে না, উল্লেখ্য, যে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিনের ন্যায্য বেতন নির্ধারিত থাকে না, তারা  এটাকে বিনিম়য় মনে করে, গোশত না দিলে মসজিদ পরিবর্তনের চিন্তা থাকে, (যেমন কোথাও কোথাও দেখা যায় ইমাম, মুয়াজ্জিনের ন্যায্য বেতনের পরিবর্তে মৌসুম ভিত্তিক ধান,গোশত ইত্যাদি দেওয়া হয়।) এমতাবস্থায় ইমাম মুয়াজ্জিনকে সমাজের গোশতের ভাগ দেয়া যাবে না, দিলে বিনিময় হিসেবেই পরিগণিত হবে। তবে ইমাম-মুয়াজ্জিনের যদি ন্যায্য বেতন  নির্ধারিত থাকে এবং তারাও এটাকে বিনিময় মনে না করে, তাহলে হাদিয়া হিসেবে গোশত দেওয়া জায়েয হবে। (আল মাবসূত ১২/১৮)

প্রশ্ন : জবাই গোশত বন্টনের বিনিময়ে জবাইকারী বণ্টনকারীকে সামাজিক গোশত ব্যতীত পৃথক ভাবে গোশত দেওয়া জায়েয হবে?

উত্তর: ইমাম ও অন্য কাউকে জবাইয়ের বিনিময় হিসাবে গোশত দেওয়া ও গোশত বন্টন কারীকে বন্টনের বিনিময় হিসেবে গোশত দেওয়া জায়েয হবেনা, যদি কেও দেয় তাহলে এ পরিমাণ মূল্য সদাকা করা ওয়াজিব। তবে তাদের কাজের  ন্যায্য পারিশ্রমিক আদায় করতঃ হাদিয়া হিসেবে অন্যদের মত তাদেরকে ও দেওয়া যাবে। (আল মাবসূত১২/১৮)

প্রশ্ন: মান্নত অসিয়তকৃত কুরবানীর গোশতের হুকুম কি?

উত্তর : মান্নাতকৃত কুরবানীর গোশত এবং ওসিয়াতকৃত কুরবানীর গোশত যা অসিয়ত কারীর সম্পদ দ্বারা করা হয় এগুলো শুধু গরীবদের মাঝে সদাকা করা ওয়াজিব, কুরবানীদাতা ও ধনীরা তা থেকে খেতে পারবে না। তাই এ সমস্ত গোশত পৃথকভাবে শুধু গরীবদের মাঝে বণ্টন করতে হবে। (ফাতাওয়া শামী ৯/৫৪০,আল বাযযাযিয়া ৯/২৪৮)

প্রশ্ন: সমাজের লোকদের আয়ইনকাম হালাল হারামে মিশ্রিত হওয়ায় সমাজে জমাকৃত গোশত কি হারাম হিসেবে গণ্য হবে?

উত্তর: সমাজের কিছু লোকের আয়-ইনকাম হালাল-হারামে মিশ্রিত হলেও কেবল ধারণা বশত: অনির্দিষ্টভাবে জমাকৃত গোশত হারাম বলা যাবে না। হ্যাঁ, যদি সুনির্দিষ্টভাবে কারো সম্পর্কে জানা থাকে যে, বাস্তবিকই তার কুরবানী হারাম উপার্জন থেকে হয়েছে তাহলে জেনে বুঝে এই কুরবানীর গোশত হাদিয়া ও সদাকা হিসেবে বণ্টন করা এবং তা ব্যবহার করা কোনোটাই জায়েয নয়। উল্লেখ্য, কেবল ধারণা ও অনুমানের ভিত্তিতে কারো কুরবানীকে হারাম উপার্জনের বলে দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। (মিনহাতুল খালেক ২/৩৫৯)

লেখক : মুফতী ও সিনিয়র শিক্ষক,  আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: আইএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।