Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন কুরবানীতে যেভাবে নফসের দমন ও আত্মত্যাগের চর্চা হয়

কুরবানীতে যেভাবে নফসের দমন ও আত্মত্যাগের চর্চা হয়

।। মুনির আহমদ ।।

মানবকালের শুরু হতেই কুরবানীর বিধান চলে আসছে। হযরত আদম (আ.)এর পুত্রদ্বয় হাবিল ও কাবিল এক বিশেষ বিষয়ে ফলাফল নির্ণয়ের জন্য যথাক্রমে হাবিল একটি হৃষ্টপুষ্ট দুম্বা এবং কাবিল কিছু শস্য কুরবানীস্বরূপ পেশ করেছিলেন। হাবিলের কুরবানী কবুল হল। আসমান থেকে একটি অগ্নি শিখা এসে হাবিলের দুম্বা ভস্ম করে দিল। অপরদিকে কাবিলের কুরবানীকৃত শস্য আসমানী আগুন জ্বালালো না। সে সময় কুরবানী কবুল হওয়া না হওয়ার এরূপ নিশানাই সাব্যস্ত ছিল।

হযরত ইবরাহীম (আ.)কে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বহু রকমের পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় এবং তিনিও প্রতিটি পরীক্ষায় চরম কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন। ফলে তিনি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘খলিলুল্লাহ (আল্লাহর অন্তরঙ্গ বন্ধু)’ উপাধীতে ভূষিত হন।

মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)কে কুরবানী করতে আদিষ্ট হয়ে সকল স্বার্থ ও দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে উঠে, সকল মায়া-মুহাব্বত বিসর্জন দিয়ে আপন রবের হুকুমের যথার্থ তা’মিল করেছিলেন। ফলে ইরশাদে ইলাহী নাযিল হয়- قَدۡ صَدَّقۡتَ الرُّءۡیَا ۚ اِنَّا کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿۱۰۵﴾ অর্থাৎ- “হে নবী! আপনি স্বপ্নের আদেশকে যথানুরূপ বাস্তবায়ন করেছেন। নিশ্চয় আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি”। (সূরা- আস-সাফফাত- ১০৫)।

হযরত ইবরাহীম (আ.)এর কর্তব্যপরায়ণতা, খোদাভক্তি ও নিষ্ঠার চরম পরাকাষ্ঠা প্রত্যক্ষ করে মহান আল্লাহ খুশি হয়ে বেহেশতি দুম্বা পাঠিয়ে দেন। ইসমাঈল (আ.)এর পরিবর্তে দুম্বা কুরবানী হয়। তাই আজ কুরবানীর নামে হযরত ইবরাহীম (আ.)এর ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংগ্রাম-সাধনা ও প্রেম-নৈকট্যের দৃষ্টান্ত ও আত্মত্যাগ নিয়ে প্রতি বছর বিশ্ব মুসলিম আল্লাহর দুয়ারে সমাগত হয়।

সুতরাং আমাদের মাঝে হযরত ইবরাহীম (আ.)এর চরম আত্মত্যাগ অবিস্মৃত স্মৃতিরূপে ভাস্বর হয়ে আছে। সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা পরবর্তীদের জন্য সেই কুরবানীকে একটি পালনীয় রীতি হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে- فَاتَّبِعُوۡا مِلَّۃَ اِبۡرٰهِیۡمَ حَنِیۡفًا ؕ অর্থাৎ ‘একনিষ্ঠভাবে তোমরা ইবরাহীমী মিল্লাতের অনুসরণ কর’। (সূরা আলে ইমরান- ৯৫)।

মোটকথা, ‘কুরবানী’ হচ্ছে ত্যাগ-তিতিক্ষা প্রদর্শনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর অধিক নৈকট্য ও সান্নিধ্য অর্জনের অনন্য সোপান। কুরবানীর মাধ্যমে বান্দা স্বীয় খাহেশাতকে বিসর্জন দিয়ে মহান আল্লাহর সমীপে আত্মনিবেদন পূর্বক তাঁর আদেশ সম্পর্কিত হুকুম পালন করতঃ তাঁর নৈকট্য লাভে অগ্রসর হয় বিধায় এটিকে ‘কুরবান’ নামে নামকরণ করা হয়েছে।

লক্ষণীয় যে, হযরত ইসমাঈল (আ.) যবেহ না হলেও হযরত ইবরাহীম (আ.)এর আন্তরিকতা ও পূর্বাপর সকল প্রস্তুতিকেই আল্লাহ তাআলা ‘বাস্তবায়ন’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে তা কবুল করেছেন। বস্তুতঃ আল্লাহ তাআলা তো দেখেন মানুষের আন্তরিক ইচ্ছাকে।

প্রতি বছর আমরা যে পশু কুরবানী করছি, তার গোশত তো আমরাই খাচ্ছি। তার চামড়া-হাড় দ্বারা তো আমরাই উপকৃত হচ্ছি। কুরবানীর পশুর কোন কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। তাহলে এই কুরবানীর উদ্দেশ্য কী? কালামে পাকে ইরশাদ হয়েছে- لَنۡ یَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوۡمُهَا وَ لَا دِمَآؤُهَا وَ لٰکِنۡ یَّنَالُهُ التَّقۡوٰی مِنۡکُمۡ ؕ অর্থাৎ-‘ কুরবানীর পশুর গোশত আল্লাহ তাআলার দরবারে পৌঁছে না, পৌঁছে না তার রক্ত। তবে তোমাদের তাকওয়াই তাঁর কাছে যায়। (সূরা হজ্জ- ৩৭)।

আল্লাহ তাআলা পরীক্ষা নেন কেবল আমাদের মনোবৃত্তিরই। কিন্তু আজ আমাদের সামাজের দিকে তাকালে কী দেখতে পাই? আমারা দেখতে পাই, কুরবানীকে যেন গোশত ভক্ষণের এক মহোৎসব মনে করা হয়। সমাজের যারা সম্পদশালী, তারা যেন কুরবানীর পশু ক্রয় করতে এক রকম প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। কে কত চড়া দামে পশু ক্রয় করবেন, এটাই হয়ে উঠে মূখ্য বিষয়।

আর যারা অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল, দরিদ্র, তারা ঈদুল আযহা আসলেই এক মহাচিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। তারা কুরবানী না দিতে পারায় মনোবেদনায় ব্যথিত হন। নিজেদের সামর্থ্যহীনতার কথা বিবেচনা করা হয় না; বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু সামাজিকতা মেইনটেন করার জন্য কুরবানী করা হয়। এমনকি তারা কুরবানী করার জন্য ঋণ পর্যন্ত করতেও বাধ্য হয়। জিজ্ঞেস করলে বলে- সবাই দিচ্ছে, আমি দিব না; এটা কেমন হয়। তাছাড়া বাড়িতে স্ত্রী-পরিজন নিয়ে গোশত খাওয়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে হয়।

সাত ভাগে কুরবানী দেওয়া যায়। সাতভাগে কুরবানী দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের নিয়তের কতটা নিষ্ঠতা থাকে, তা ভাবার বিষয়। যে সমাজে দুই জন লোক এক হতে পারে না, ভাই ভাই দ্বন্দ্ব-কলহ লেগেই থাকে। ফলে সাত ভাগের কুরবানীর ক্ষেত্রে গোশত ভাগ বণ্টনের সময় দেখা যায় তুমুল বাকবিতণ্ডা। এতে গোশত ভক্ষণের উদ্দেশ্যটাই যেন ফুটিয়ে তোলা হয়। অথচ একমাত্র মহান আল্লাহর হুকুম তা’মিল ও তাঁকে রাজি-খুশি করার জন্যই কুরবানী দেওয়ার ব্যাপারে সবার নিয়ত এক থাকা অপরিহার্য। না হলে কুরবানী হবে না। কিন্তু আমরা ক’জনই সেদিকে লক্ষ রাখি!

যদি হযরত ইসমাঈল (আ.)এর যবেহই মঞ্জুরে ইলাহী হতো এবং হযরত ইবরাহীম (আ.)এর হাতে তাঁর কুরবানী হতো, আর সেই আমলের পরম্পরায় আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানদেরকে যবেহ করার হুকুম হতো, তা কত কঠিন ব্যাপারই না ছিল! তথাপি মুসলমান হিসেবে জীবন যাপন করলে আমাদের তা পালন করতেই হতো। এ ক্ষেত্রে পরম করুণাময় আল্লাহ আমাদের উপর বড় মেহেরবানী করেছেন যে, তিনি পশু কুরবানীকে তার স্থলাভিষিক্ত করেছেন।

তাই ইবরাহীমী কুরবানীর স্মৃতিগাঁথা ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। খলীলী ইশকের দীক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে আহকামে ইলাহীর সামনে নিজের খাহেশাত বা কামনা বাসনাকে কুরবান করতে হবে। সর্বান্তকরণে নিজেকে সঁপে দিতে হবে ইসলামের তরে। প্রকৃতপক্ষে কুরবানী হচ্ছে ত্যাগের এক সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর সেই ত্যাগের দৃষ্টান্ত হিসেবে কুরবানী দিতে হবে যার যার সমর্থ অনুযায়ী মোটাতাজা পশু দিয়ে। আর কুরবানী শেষে নিজের নফসের সাথে মোকাবেলা করে কুরবানীর গোশত নিজ নিজ ফ্রিজে না ভরে রেখে, নিজেদের পরিবার-পরিজন নিয়ে আহারের পাশাপাশি পাড়া-প্রতিবেশি, ফকির-মিসকীন এবং আত্মীয়-স্বজনের মাঝে বিলিয়ে দিতে হবে। কারণ, নফস চাইবে কুরবানীর পশুর মূল্যবান গোশতগুলো শুধু নিজেদের আহারের জন্য রেখে দিতে ফ্রিজে ভরতে। কিন্তু সেটা করা যাবে না।

বরং কুরবানীর যে আত্মত্যাগ ও মনের পশুকে বদ করার কথা বলা হয়, যে সহমর্মিতা ও স্রষ্টার জন্য নিবেদিত হওয়ার কথা বলা হয়, ইখলাসপূর্ণ নিয়তের পাশাপাশি সেটার দৃশ্যমান আমলও করতে হবে। আর সেটা এভাবে যে, মন চাইবে না হাজার হাজার টাকা মূল্যমানের কুরবানীর গোশতকে তিন ভাগ করে দুই ভাগ অকাতরে বিলিয়ে দিতে। মন চাইবে কুরবানীর গোশতকে প্রয়োজনমাফিক রান্না করে ও গরিবদেরকে অতি সামান্য কিছু দিয়ে বাকিটা ফ্রিজে ভরে রাখতে, যাতে মাসের পর মাস সেটা নিজেরাই আহার করে ভোগ করা যায়। কিন্তু এতে তো কুরবানীটা যে আল্লাহর জন্যই নিবেদিত ছিল, তার প্রমাণ হয় না। বরং এতে নফসের দাসত্ব, আত্মকেন্দ্রিকতা, লোক দেখানোর মানসিকতার প্রমাণ মিলে।

কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজের পরিবার-পরিজন নিয়ে আহার এবং বাকি দুই ভাগ বিলিয়ে দেওয়ার মাঝে যেমন মহান আল্লাহর প্রতি নিবেদিত হওয়ার প্রমাণ মিলে, তেমনি এতে মানবিকতা, সহমর্মিতা, আত্মীয়তার সম্পর্ক, সামাজিকতা ও মানুষে মানুষে সম্পর্ক বৃদ্ধির উত্তম অনুশীলনের মাধ্যমে বৃহত্তর উম্মাহ গড়ার পথও সুগম হয়। একই সাথে এতে সকলের একসাথে উত্তম আহারের মাধ্যমে ঈদের আনন্দ উদযাপনেরও সার্থকতা অর্জিত হয়। অথচ তথাকথিত মানবতার ধ্বজাধারি পুঁজিবাদের সৃষ্ট কর্পোরেট হাউজগুলো মুসলমানদের কুরবানিতে সর্বস্তরে অকাতরে কুরবানির গোশত বিলানোর মানবিকতা, সহমর্মিতা, সংহতি, সামাজিকতা ও ঈদের ঐক্যবদ্ধ আনন্দ উদযাপন চর্চার পথে বাধা তৈরি করতে আকর্ষণীয় ছাড়ের বিজ্ঞাপন দিয়ে ফ্রিজ বিক্রির পসরা সাজায়।

কুরবানিতে ইসলাম মুসলামনদের মাঝে চাহিদা পেশ করে মনের কুপরামর্শ মেনে রোগা-খোঁড়া ও যেনতেন কম মূল্যের পশুর পরিবর্তে মোটা-তাজা, সুস্থ ও সুন্দর পশু নির্বাচন করতে এবং সেই সুন্দর পশুর কুরবানী দেওয়া উত্তম গোশতগুলো ফ্রিজে না ভরে একটা অংশ পরিবারের সকলকে নিয়ে খেয়ে আনন্দ করতে, বাকি দুইটা অংশ পাড়াপ্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজন ও গরিব-মিসকিনদের মাঝে বিলিয়ে ঈদের আনন্দকে ভাগাভাগি করে মানবিকতা ও ঐক্যের উত্তম চর্চা করতে। অন্যদিকে পুঁজিবাদি ব্যবস্থা প্রচারণা চালায় সকলকে বঞ্চিত করে গোশতগুলো ফ্রিজে ভরে আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতার চর্চা করতে। আর এই পুঁজিবাদিরাই আবার নানাভাবে ইসলামকে অমানবিক ও নিষ্ঠুর হিসেবে দেখাতে নানান মিথ্যা প্রচারণা চালায়। কী বিচিত্র সেলুকাস!

আরও পড়তে পারেন-

বলাবাহুল্য, পশু কুরবানী তো একটি প্রতীকী আমল। কুরবানীর গোশত বিলানোকে উৎসবে পরিণত করেই এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যকে অর্থবহ করে তুলতে হবে। কারণ, আল্লাহর রাজি-খুশির উদ্দেশ্যে উত্তম পশু কুরবানীর পর এর মূল্যবান গোশতগুলো নিজেরা আহার করার পাশাপাশি পাড়াপ্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজন ও গরীবদের মাঝে বিলিবণ্টনের মাধ্যমে নফসের কুবাসনাকে বিসর্জন দেয়ার মধ্য দিয়েই কুরবানীর উদ্দেশ্যকে ফলপ্রসূ করতে হবে। তাই কুরবানীর প্রক্কালে সর্বাগ্রে নফ্সানী খাহেশাত, প্রবৃত্তি, লোভ-লালসা ও দুনিয়ামুখিতার গলায় ছুরি চালাতে হবে। নিজের মনের খেয়াল খুশিতে নয়, বরং আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ মোতাবেক সাহাবায়ে কেরামের অনুসৃত পথে চলার সংকল্প করতে হবে। যে কোন পরিস্থিতিতে আল্লাহর ভয় ও আখেরাতের জবাবদিহিতার আশঙ্কায় সর্বপ্রকার অনৈসলামিক বা মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।

মানুষ যেখানে সারাক্ষণ নিজের সামান্য কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য, নিজের চাহিদা পূরণের জন্য যে কোন রকম ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকে, সেখানে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নির্দেশ পালন কল্পে, তাঁর রহমতের দ্বারে কড়া নাড়ার জন্য, তাঁর দয়া দৃষ্টি নিজের দিকে আকর্ষণ করার জন্য ত্যাগ স্বীকার করে সর্বোচ্চ কুরবানী করতে হবে। এ ত্যাগ এ কুরবানী পশু কুরবানী থেকে শুরু করে আত্মোৎসর্গ পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। খোদাভীতির সামনে পরিবেশ পরিস্থিতি, সমাজ সংস্কার আর পার্থিব ভয়-ভীতিকে এবং আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালবাসার সামনে মানুষের সহায়-সম্পদ, পরিবার-পরিজন এবং নিজের জীবনের ভালবাসাসহ অন্যান্য যাবতীয় প্রেম-ভালবাসাকে উৎসর্গ করতে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে।

আল্লাহর হুকুম পালনে হযরত ইব্রাহীম (আ.) যেরূপ প্রবল মনোবল নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন, ইবলিস শয়তানও তত কঠোর প্রতিরোধ নিয়ে বাঁধা দিয়েছিল। কিন্তু শয়তান তাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তিনি রমিয়ে জিমার (পাথর নিক্ষেপ) করে শয়তানকে বিতাড়িত করেছিলেন। যার স্মৃতি আজ হজ্জের আমল হিসেবে গন্য।

ঐ প্রতীকী স্তম্ভ জগদ্বাসীকে বলছে যে, যে কোন প্রকার সৎকাজে অগ্রসর হওয়ার সময় যদি শয়তান কোন প্রকার বাঁধার সৃষ্টি করে, তাহলে আল্লাহর এ ক’জন সেরা নবীর নিদর্শন স্মরণ করে তওবা স্বরূপ ভীষণ প্রস্তরাঘাতে তাকে ক্ষত-বিক্ষত করে অনেক দূরে নিক্ষেপ করো।

আল্লাহর আদেশ পেয়ে হযরত ইবরাহীম (আ.) পার্থিব মায়া পরিত্যাগ করে প্রাণপ্রিয় পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়ে ছিলেন। অনুরূপভাবে আমাদেরকেও প্রকৃত মুসলমান হতে হলে কীভাবে শত প্রেম ভালবাসা, মায়া-মুহাব্বাত ছিন্ন করে, শত বাধাবিঘ্ন, শয়তানি কুচক্র পদদলিত করে কঠোর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়, আর কীভাবেইবা পরম দয়ালু আল্লাহ তাআলা তাঁর সন্তুষ্টির জন্য লালায়িত বান্দাকে শত সহস্র বিপদ হতে অচিন্তনীয়ভাবে সম্পূর্ণরূপে রক্ষা করেন, কুরবানী তাই শিক্ষা দেয়।

আজও কুরবানীর ব্যাপারে শয়তান ওয়াসওয়াসা দিয়ে প্রতিরোধে তৎপর হয়। মুসলিম সমাজে কুরবানির বিরুদ্ধে নানা কুযুক্তি হাজির করে। ফ্রিজে কুরবানির গোস্ত ভরতে পুঁজিবাদি ব্যবস্থা কুরবানির উদ্দেশ্য পূরণে বাঁধা তৈরি করে। কিন্তু মিল্লাতে ইব্রাহীমির ধারক আল্লাহর খাঁটি মুসলমান বান্দাগণ শয়তানকে পরাজিত করে আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন করেন। তথাপি শয়তান কতক লোককে তার দলে ভিড়াতে সক্ষম হয়। তাদের কেউ শয়তানী প্ররোচণায় কুরবানী দ্বারা কেবল নাম কামানোর ধান্ধায় থাকে। আবার কেউ ওয়াজিব দায়িত্ব আদায়ে অনীহা দেখায়। উপরন্তু শয়তানিতে প্ররোচিতদের কেউ কেউ কুরবানীকে নির্মম পশু হত্যা ও অপচয় বলে ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি পর্যন্তও করে বসে। অথচ দেখা যায়, কথিত পশুপ্রেমি এই লোকগুলোর মাছ-গোশত ছাড়া কোন দিনই ভুরিভোজ হয় না।

ইসলাম তো হচ্ছে সবান্তকরণে আল্লাহর সমীপে আত্মনিবেদন করার নাম। আল্লাহর বান্দারা আল্লাহর সৃষ্টি উত্তম পশু কুরবানী করবে, সবার মাঝে কুরবানীর গোশত বিলাবে, এতে সংকীর্ণমনা হওয়ার আবকাশ নেই। এ ব্যাপারে যারা বিরূপ উক্তি করে, তাদের অনেকে ইসলামী নামের অধিকারী হলেও মূলতঃ তারা ধর্মদ্রোহী নাস্তিক মুরতাদদের কাতারেই তাদের অবস্থান আবিষ্কার করা উচিত।

ঈদুল আযহার পশু কুরবানী যেহেতু আল্লাহর আদেশ পালন ও ইবাদত; তাই এক্ষেত্রে মনে কোন সংকীর্ণতার স্থান দেয়া জায়েয নেই। বরং স্বতঃস্ফূর্তভাবে আল্লাহর এ হুকুম পালন করতে হবে। কুরবানীর জন্য সুস্থ, সবল, মোটাতাজা উত্তম পশু নির্বাচন করতে হবে। কুরবানীর পর সবার মাঝে গোশত বিলি-বণ্টনের মাধ্যমে উম্মাহর ঈদ-আনন্দকে সার্বজনীনতায় রূপ দিতে হবে। এর মধ্য দিয়ে উম্মাহ’র সংহতি, সহমর্মিতা, সদাচরণ ও ঐক্যের উত্তম চর্চা হবে। আর এতেই ঈদুল আযহার আনন্দ উদযাপন সফল ও সার্থক হবে।

মূলতঃ হযরত ইব্রাহীম (আ.) যেমন কঠিন পরীক্ষার মুহূর্তে প্রমাণ করেছিলেন- قُلۡ اِنَّ صَلَاتِیۡ وَ نُسُکِیۡ وَ مَحۡیَایَ وَ مَمَاتِیۡ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ অর্থাৎ- “আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সবই বিশ্ব পালনকর্তা মহান আল্লাহর জন্যই নিবেদিত।” (সূরা আন্আম- ১৬২)। আমাদেরকেও ইখলাসপূর্ণ নিয়তের মাধ্যমে উত্তম পশু দিয়ে কুরবানী দিয়ে সেই কুরবানীর গোশত ফ্রিজে না ভরে বিলানোর মাধ্যমে আল্লাহর জন্য নিবেদিত হতে হবে। কুরবানীতে যে ত্যাগের কথা বার বার উচ্চারিত হয়, উত্তম পশু নির্বাচন ও মনের ইচ্ছাকে দমিয়ে অকাতরে বিলিয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই করতে হবে কুরবানীর বহুল আলোচিত ত্যাগের উত্তম চর্চা।

‘কুরবানী’ প্রতি বছর আসে যায়, আমাদের বারবার ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত করে। সারা বছরের কর্মতৎপরতায় কুরবানীর শিক্ষাকে ধারণ করে রাখাই সচেতন ধার্মিকের কাজ।

সুতরাং, আসুন! আমরা কুরবানীর শিক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে সকলকে আনন্দ উদযাপনে শামিল করার মাধ্যমে ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করি। আল্লাহর অধিক নৈকট্য ও সান্নিধ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে নিজেকে সর্বান্তকরণে সঁপে দেই ইসলামের তরে। আল্লাহ্ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।

– মুনির আহমদ, নির্বাহী সম্পাদক- মাসিক মুঈনুল ইসলাম, সম্পাদক- উম্মাহ টুয়েন্টিফোর ডটকম।

উম্মাহ২৪ডটকম: আইএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।