।। আতাউর রহমান খসরু ।।
মাদক মানবসমাজের প্রাচীনতম ক্ষতগুলোর একটি, যা সমাজে নানা অনাচার ও অপরাধের অন্যতম কারণ। ইসলাম মানুষের জন্য ক্ষতিকর সব কিছুর মতো মদকেও নিষিদ্ধ করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মদ পান কোরো না। কেননা তা সকল অকল্যাণের চাবিকাঠি। ’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৩৭১)
মাদক মাত্রই হারাম
শরিয়তে সব ধরনের নেশাদ্রব্য হারাম। চাই মদের মতো সুপ্রাচীন হোক বা ইয়াবার মতো নব-উদ্ভাবিত হোক। শরিয়তের মূলনীতি হলো নেশা সৃষ্টি করে এমন সব দ্রব্য হারাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক নেশা সৃষ্টিকারী বস্তু হারাম। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৩৪৩)
অন্য হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক নেশা সৃষ্টিকারী বস্তু মদ এবং প্রত্যেক নেশা সৃষ্টিকারী বস্তু হারাম।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৫৬৯৯)
নেশা সৃষ্টি না করলেও মাদক হারাম
মাদকদ্রব্যের সামান্য পরিমাণ গ্রহণ করাও বৈধ নয়, এমনকি তাতে যদি নেশা সৃষ্টি না হয় তবু। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যার বেশি পরিমাণ নেশা সৃষ্টি করে, তার সামান্য পরিমাণও হারাম।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৫৬০৭)
মাদক গ্রহণের শাস্তি
শরিয়তে মদ পান করা হারাম এবং তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং চার খলিফার প্রত্যেকে মদ পানকারীকে শাস্তি দিয়েছেন। ফকিহ আলেমরা বলেন, খেজুর, আঙুর ও কিশমিশের তৈরি মদ স্বেচ্ছায় গ্রহণকারী ব্যক্তি নেশাগ্রস্ত হোক বা না হোক, তাকে ৮০ বার বেত্রাঘাত করা হবে। এ ছাড়া অন্যান্য উৎপাদিত জিনিস বা যেকোনো জিনিস থেকে তৈরি করা নেশাদ্রব্য নেশাগ্রস্ত হওয়ার মতো পরিমাণ গ্রহণকারী ব্যক্তিকেও ৮০ বার বেত্রাঘাত করা হবে। আনাস ইবনে মালিক (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.) মাদক সেবনের অপরাধে খেজুরের ডাল ও জুতা দিয়ে আঘাত করেন। আর আবু বকর (রা.) ৪০টি বেত্রাঘাত করেন।
অতঃপর ওমর (রা.) যখন খলিফা হন, তিনি লোকদের ডেকে বলেন, অনেক লোক পানির উৎসগুলোতে ও গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। কাজেই এখন আপনারা মাদক গ্রহণের ‘হদ’ প্রসঙ্গে কী বলেন? তখন আবদুর রহমান ইবনু আউফ (রা.) বলেন, আমরা হদের আওতায় লঘু শাস্তি দেওয়ার মত দিচ্ছি। সুতরাং তিনি এর শাস্তি হিসেবে ৮০টি বেত্রাঘাত নির্ধারণ করেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৪৭৯)
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
মাদক গ্রহণের পরকালীন শাস্তি
মাদক গ্রহণকারী পরকালে নানা রকম শাস্তি ভোগ করবে। এর ভেতর সবচেয়ে বড় শাস্তি হলো জান্নাত থেকে বঞ্চিত হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সর্বদা মদ পানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৩৭৬)
মদ অপবিত্র
বেশির ভাগ আলেমের মতে, মদ অপবিত্র। সুতরাং তা শরীর বা কাপড়ে লাগলে নিয়ম অনুযায়ী পবিত্র করতে হবে; বরং কোনো কোনো আলেম মদ নাপাক বা অপবিত্র হওয়ার ব্যাপারে উম্মতের ঐকমত্য (ইজমা) দাবি করেছেন। যেমন—আল্লামা ইবনু মুফলিহ (রহ.) বলেছেন, ‘সর্বসম্মতিক্রমে এটা (মদ) হারাম।’ (আল মুবদি : ১/২০৯)
ইমাম নববী (রহ.) মদ নাপাক হওয়ার ব্যাপারে চার ইমামের ঐকমত্য করে বলেছেন, ‘মদ আমাদের কাছে (শাফেয়ি) নাপাক। একইভাবে তা মালিক, আবু হানিফা ও আহমদ (রহ.)-সহ সব আলেমের কাছে অপবিত্র।’ (আল মাজমু : ২/৫৮১)
মদ নাপাক হওয়ার পক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ পবিত্র কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াত। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কোরো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৯০)
মদ পানকারীর ইবাদত নিরাপদ নয়
মদ পানকারী ব্যক্তির ইবাদত-বন্দেগি আল্লাহর দরবারে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় আছে। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মদ পান করে এবং মাতাল হয়, ৪০ দিন পর্যন্ত তার নামাজ কবুল হয় না। সে মারা গেলে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আর যদি সে তাওবা করে, তবে আল্লাহ তায়ালা তার তাওবা কবুল করবেন। সে পুনরায় মদ পান করলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে ‘রাদগাতুল খাবাল’ পান করাবেন। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসুল! ‘রাদগাতুল খাবাল’ কী? তিনি বলেন, জাহান্নামিদের শরীর থেকে নির্গত পুঁজ ও রক্ত।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৩৭৭)
ইবাদত কবুল না হওয়ার অর্থ
ফকিহ আলেমরা উল্লিখিত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, নামাজ কবুল না হওয়ার অর্থ হলো ব্যক্তি নামাজের সওয়াব বা প্রতিদান পাবে না। কিন্তু সে ফরজ আদায়ের দায় থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। সুতরাং যে ব্যক্তি মদ বা অন্য কোনো মাদকে আসক্ত, সে নামাজ ত্যাগ করবে না। সে নামাজ পড়বে এবং আল্লাহর কাছে এই অভিশাপ থেকে মুক্তির দোয়া করবে। ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ‘নামাজ কবুল না হওয়ার অর্থ হলো সে নামাজের সওয়াব পাবে না। তবে তা ব্যক্তিকে ফরজের দায় থেকে মুক্ত করবে। এমন নামাজ পুনরায় পড়ার প্রয়োজন নেই।’ (মিরকাতুল মাফাতিহ : ৮/৪১০)
মুসলিম সমাজে মাদকসেবীর অবস্থান
মদ ও মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব মানুষ অভিশপ্ত। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) মদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে এমন ১০ শ্রেণির লোকের প্রতি অভিশাপ করেছেন : ১. যে লোক মদের নির্যাস বের করে, ২. প্রস্তুতকারক, ৩. মদপানকারী, ৪. যে পান করায়, ৫. মদের আমদানিকারক, ৬. যার জন্য আমদানি করা হয়, ৭. বিক্রেতা, ৮. ক্রেতা, ৯. সরবরাহকারী, ১০. এর লভ্যাংশ ভোগকারী। (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস : ২৭৭)
অন্য হাদিসে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মাদকাসক্ত ব্যক্তি মূর্তিপূজকদের মতোই।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৩৭৫)
জান্নাতে মদ কেমন হবে?
পৃথিবীতে আল্লাহ মুমিনের জন্য মদ হারাম করেছেন। কিন্তু পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াত থেকে বোঝা যায়, জান্নাতে আল্লাহ মুমিনের তা পান করার অনুমতি দেবেন। যদিও কোরআনে তাকে মদ শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে, তবে বৈশিষ্ট্যের বিচারে তা পৃথিবীর মদের মতো না। পবিত্র কোরআনের আয়াত থেকে তা স্পষ্টত বোঝা যায়। যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের সেবায় ঘোরাফেরা করবে চির কিশোররা—পানপাত্র, কুঁজা ও প্রস্রবণ নিঃসৃত সুরাপূর্ণ পাত্র নিয়ে, যা পান করলে তাদের মাথা ব্যথা হবে না এবং তারা বিকারগ্রস্তও হবে না।’ (সুরা : ওয়াকিয়া, আয়াত : ১৭-১৯)
উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যা ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘পৃথিবীর মদের চারটি বৈশিষ্ট্য আছে। তা হলো নেশা সৃষ্টি, মাথা ব্যথা, বমি ও পেশাব। আল্লাহ তাআলা জান্নাতি যে মদের কথা বলেছেন তা তিনি এসব বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত রেখেছেন। (তাফসিরে ইবনে কাসির)
আল্লাহ সবাইকে মাদকের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
উম্মাহ২৪ডটকম:এসএ