।। অভিজিৎ বড়ুয়া অভি ।।
আমাদের দেশের বর্তমান সমাজের প্রায় সবার একটি বিশ্বাস যে নৈতিকতা হ্রাস পাচ্ছে। প্রশ্ন হলো-আমাদের রাষ্ট্রে, সমাজে, রাজনীতিতে ও নীতি-নির্ধারকদের অনৈতিকতা, দুর্নীতি, সহিংসতায়, আমরা কি এই সমাজে বসবাসের যোগ্য? শিশুশ্রম, ধর্ষণ, গার্হস্থ্য সহিংসতা, বৈষম্য, বর্ণবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য, ধর্মের নামে বৈষম্য ও সহিংসতার বর্তমান সমাজে নৈতিকতা ও নীতির অস্তিত্ব বিলুপ্তপ্রায়। বৃদ্ধি পাচ্ছে এক ধরনের সামাজিক আচরণে বর্বরতা ও অনৈতিকতা।
আমরা এমন একটি দেশে বাস করি যেখানে সহমর্মিতার অভাব, ব্যক্তিগত আক্রমণ ও সর্বক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতি দেখতে পাই। মানুষ সমাজে এখন মানুষের মনস্তত্ত্ব বুঝতে ব্যর্থ। আমরা যেন কাউকে হেয় করে, ক্ষতিগ্রস্ত করে, অত্যাচারে, নির্যাতনে, হত্যা করে আনন্দ পাই। সত্য, মানবিকতা, সহমর্মিতার যেন আর অস্তিত্ব নেই। মানুষ আজ অনৈতিকতা, দুর্নীতি, সহিংসতায়, অজ্ঞতা ও আত্মকেন্দ্রিক জীবনযাপন করছে। সমাজে আমাদের আশেপাশের মানুষ বা পরিবারের কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত হলে, এটি আমাদের এখন আর প্রভাবিত করে না।
আগে একজন দুর্নীতিবাজ ও নীতিহীন ব্যক্তিকে সমাজ পরিহার করলেও এখন কেউ অন্যায় করলে এটিই স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়। নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। তরুণরা তাদের ক্যারিয়ারের জন্য প্রস্তুতি ও তাদের জীবন উপভোগ করতে ব্যস্ত। সামাজিক সমস্যা বা পারিবারিক বিষয় নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। বৃদ্ধরা প্রায়ই অবহেলিত। আমরা বর্তমান সমাজে প্রজন্মদের তাদের বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার, এমনকি তাদের বের করে দেয়ার ঘটনাও দেখছি।
অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক জীবনের কারণে ছোট শিশু, কিশোর, তরুণরা অবহেলিত। বর্তমান প্রজন্মের পিতা-মাতারা তাদের শিশুদের বিষয়ে যতœহীন। ফলে পাশ্চাত্যের প্রভাব ও চলচ্চিত্রের প্রভাবে দিন দিন সংস্কৃতির অবক্ষয় ঘটছে যা তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত ও প্রভাবিত করছে। ইলেকট্রনিক গ্যাজেট এবং মোবাইল অ্যাপ শিক্ষার পদ্ধতির পরিবর্তন করেছে। বর্তমান প্রজন্ম অনলাইনে শিক্ষার প্রতি আসক্ত। কিন্তু আজকাল তারা তাদের শিক্ষকদের প্রতিও কম শ্রদ্ধাশীল। তরুণ প্রজন্ম আইপ্যাড ও ল্যাপটপে ব্যস্ত। মূল্যবোধ ও আদর্শের অবক্ষয়ের কারণে বর্তমান প্রজন্ম উচ্চ শিক্ষিত হয়ে উঠলেও, তাদের জীবন দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি এবং সরকারের দুর্বল নীতির কারণে মানুষ আজ তাদের পরিবারের খরচ চলতে হিমশিম খাচ্ছে।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
মানুষ সরল ও অর্থবহ জীবনযাপনের মূল্য ভুলে গেছে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে বিনোদনের নতুন মাধ্যম গড়ে উঠেছে। তারা গভীর রাত পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় অনুষ্ঠান উপভোগ করে। তারা ভোরে তাড়াতাড়ি উঠতে এবং ধর্ম, ধ্যান ও ব্যায়াম করতে ভুলে গেছে। আধুনিক সময়ে নগরায়ণের কারণে, বর্তমান প্রজন্ম ধীরে ধীরে একাকিত্বে ভুগছে। ফলে প্রজন্ম মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে। কঠোর প্রতিযোগিতা তরুণদের আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি করছে যা খুবই হতাশাজনক এবং আমাদের দুর্বল সমাজব্যবস্থাকে প্রতিফলিত করে।
কারণ সমাজে সর্বক্ষেত্রে আমাদের লোভনীতি ও অনৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধকে নিম্নমুখী করেছে। অনৈতিকতা, দুর্নীতি, সহিংসতায় জড়িত, প্রভাবশালীদের তাণ্ডব, রাষ্ট্র পরিচালকদের অনৈতিকতা, নীতিনির্ধারকদের দুর্নীতি, ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফার লোভে অনৈতিকতার অপরাধ বৃদ্ধির ফলে নিরপরাধ সাধারণ জনগণের মধ্যে ভয় ও তাদের জীবনে হুমকির সৃষ্টি হয়েছে। সমাজে আজ অবৈধভাবে ধনী, অভদ্র এবং অহঙ্কারী ধনী শ্রেণীর তৈরি হয়েছে যা সমাজের নৈতিকতাকে ধ্বংস করছে। মানুষের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করছে। নিম্ন নৈতিক মূল্যবোধ সমাজে অস্থিরতা ও অশান্তি সৃষ্টি করেছে। সমাজে সাধারণ ও সৎ লোকেরা সংগ্রাম, অবহেলা ও কষ্টের সম্মুখীন।
এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশের সমাজে মানুষ কি সত্যিই কম নৈতিক হয়ে উঠছে? নৈতিক আচরণ কি হ্রাস পাচ্ছে? আসলেই নৈতিকতা হ্রাস পাচ্ছে। কারণ আমাদের সমাজের সব ক্ষেত্রে, মানুষ বিশ্বাস করে যে, নৈতিকতা ক্রমাগত অবক্ষয়ের মধ্যে রয়েছে। কারণ মানুষ মনে করে, সাম্প্রতিক অতীতেও, লোকেরা একে অপরের সাথে আরো দয়া ও শ্রদ্ধার সাথে আচরণ করত। আমাদের দেশে বিগত দুই দশকে সমাজে অনেক নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে।
বর্তমান সময়ে বেশির ভাগ মানুষই সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়ী করে। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে বর্তমান প্রজন্মের কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ প্রাপ্তবয়স্করা খুব আক্রমণাত্মক। তা ছাড়া রাজনৈতিক ও আর্থিক দুর্নীতি নৈতিক অবক্ষয়ের আরেকটি কারণ। আমাদের দেশের রাজনীতি নোঙরা হয়ে গেছে। রাজনীতিবিদ ও কর্তৃত্বের বা নীতিনির্ধারক ব্যক্তিরা তাদের মূল নৈতিক নীতিগুলো ত্যাগ করেছেন। আর্থিক দুর্নীতিও একটি বিষয়। ফলে প্রতারণা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বেআইনিভাবে কিছু মানুষ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে, ফলে নৈতিকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত সমাজের সৃষ্টি হয়েছে। বৃদ্ধি ঘটেছে সহিংসতা, দুর্নীতি, যৌন হয়রানি ও বৈষম্য।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক
উম্মাহ২৪ডটকম: আইএএ