।। আলেমা ঊর্মি বিনতে আবুল বাশার ।।
কুসংস্কার হলো যুক্তিহীন , ভিত্তিহীন মানুষের নিজের থেকে বানোয়াট কিছু কথাবার্তা বা নিয়ম-নীতি। বিজ্ঞান আর ইসলামী বিধিবিধান কোথাও কুসংস্কারের স্থান নেই ।
সমাজে বহুল প্রচলিত একটি কুসংস্কার হলো, কোনো কিছুকে অশুভ অলক্ষী মনে করা। ইসলামপূর্ব আরবের পৌত্তলিকদের মাঝে এর প্রচলন ছিল অতি মাত্রায় । শুধু আরবরাই নয়, বরং অন্য জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যেও কোনো কিছুকে অশুভ অপয়া মনে করার রেওয়াজ ছিল দেখার মতো।
এ ব্যাপারে কোরআনের কোথাও কোথাও আলোচনাও হয়েছে। যেমন হজরত সালেহ (আ.)-এর জাতি তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদের অশুভ মনে করত। ইরশাদ হচ্ছে, “তারা বলল, আমরা তো তোমাকে এবং তোমার সঙ্গীদের অশুভ মনে করি।” (সুরা নামল- ৪৭)।
ওদিকে ফিরআউন ও তার জাতি হজরত মূসা (আ.) এবং তাঁর অনুসারীদের অপয়া মনে করত। কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “যখন তাদের সুখের দিন আসত, তখন বলত, এটা তো আমাদের প্রাপ্য ছিল। আর যখন কোনো বিপদ আসত, তখন তারা মূসা ও তাঁর সঙ্গীদের অশুভ সাব্যস্ত করত।’ (সুরা আরাফ- ১৩১)।
এদিকে মুনাফিকরাও কোনো অকল্যাণ সাধিত হলে রাসুল (সা.)-এর দিকে আঙুল নির্দেশ করে বলত, এটা তার কারণে হয়েছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “তাদের (মুনাফিকদের) যদি কোনো কল্যাণ লাভ হয়, তবে বলে যে এটা আল্লাহর পক্ষ হতে।
পক্ষান্তরে যদি তাদের মন্দ কিছু ঘটে, তবে (হে নবী) তারা বলে এ মন্দ ব্যাপারটি আপনার কারণেই ঘটেছে। বলে দাও সব কিছুই আল্লাহর পক্ষ হতে ঘটে। ওই সব লোকের হলো কী যে তারা কোনো কিছু বোঝার চেষ্টা করে না? (সুরা নিসা- ৭৮)।
উপরোক্ত আয়াতগুলোতে একটি সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে যে এ জগতে যা কিছু হয় তা আল্লাহর ইচ্ছা ও হুকুমেই হয়। বিদায় হজের ভাষণে রাসূল সাঃ জাহিলায়েতর যুগের সব কুসংস্কার রহিত করে দিয়েছেন ।
কিন্তু হাজার বছর পার হয়ে গেছে, মানব সভ্যতারো অনেক অগ্রগতি হয়েছে , তবুও মানবসমাজ থেকে এখনো কুসংস্কারের মূল উৎপাটন করা সম্ভব হয়নি । বরং সামাজিক উন্নয়ন এবং যুগের নতুনত্বের পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন নতুন কুসংস্কারের সৃষ্টি হয়েছে ।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
এসমস্ত কুসংস্কারকে এক ধরনের মারাত্মক বেধী বললেও চলে । কারণ কিছু কিছু মানুষ কুসংস্কারে এত বেশি বিশ্বাসী হয় যে তারা শিরিক এর পর্যায়ে চলে যায় । ইসলামী বিধিবিধান এর থেকেও বেশি কুসংস্কারকে প্রাধান্য দেয় । যেমন পরীক্ষায় যাওয়ার সময় ডিম খেতে নেই , কোথাও যাত্রা করার সময় কোনো পাখির ডাকে কুলক্ষণ মনে করা, এছাড়াও ব্যাঙ ডাকলে বৃষ্টি আসা, জন্মবার নখ চুল কাটতে নেই, সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ এর সময় গর্ভবতীদের শুয়ে থাকতে হয় ঘরের কোণে সুই গেঁথে রাখতে হয় ইত্যাদি এমন আরও অসংখ্য উদ্ভট উদ্ভট কুসংস্কার রয়েছে ।
এই সমস্ত কুসংস্কারের খন্ডন হাদীস শরীফে রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘ভাগ্যের ভালো-মন্দ নির্ণয়ের জন্য পাখি ওড়ানো বা ঢিল ছোড়া বা কোনো কিছুকে অশুভ লক্ষণ মান্য করা শিরক।(আবু দাউদ, হাদিস : ৩৯০৯)।
এছাড়াও অন্যত্র আরেক হাদীসে বর্ণিত আছে- ‘হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন- আমি শুনেছি যে, হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন: “কোন বিষয়কে অশুভ কুলক্ষণে মনে করো না , তবে শুভ লক্ষন আছে। ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগন আরজ করলেন, শুভ লক্ষন কি ? তখন তিনি বললেন, উত্তম কথা, যা তোমাদের মধ্যে হতে কেউ শুনতে পায় !” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, হাদীস নং- ৫৬০৪)।
কুসংস্কারের প্রধান কারণ হলো অজ্ঞতা। ইসলামের প্রথম কথাই হলো ‘ইকরা’ বা তুমি পড়ো। অজ্ঞতাকে জয় করা গেলে কুসংস্কার নির্মূল করা সম্ভব। ইসলামে অশুভ বলতে কিছু নেই। সৃষ্টির কোনো কিছুই অশুভ নয়। কোরআনের ভাষায়, ‘হে আমার রব, তুমি এসব নিরর্থক সৃষ্টি করোনি।’ (সুরা আলে ইমরান- ১৯১)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদি ও ভাগ্যনির্ধারক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো।’ (সুরা মায়েদা- ৯০)।
আল্লাহ তাআলা ছাড়া কাউকে শক্তির উৎস মনে করা কুফরি। অথচ কুসংস্কার এমন ধারণাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো কিছুকে কার্যসম্পাদনের কারণ মনে করা শিরকেরই পর্যায়ভুক্ত। যেমন মানুষের ভ্রান্ত বিশ্বাস রয়েছে যে ব্যাঙ ডাকলে বৃষ্টি হয়, কালো বিড়াল বা প্যাঁচা দেখা দুর্ভাগ্যের লক্ষণ, কাক ডাকলে মৃত্যু আসে, জোড়া কলা খেলে যমজ বাচ্চা হয়, হাতের তালু চুলকালে টাকা আসে ইত্যাদি। এগুলো অজ্ঞতা, মূর্খতা ও অন্ধ আনুগত্যের ফসল। প্রকৃত মুমিন কখনোই এসব বিশ্বাস করতে পারে না। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তিনিই বাদশাহ, মহা পবিত্র, ত্রুটিমুক্ত, নিরাপত্তাদানকারী, মহাপরাক্রমশালী, মহাপ্রতাপশালী ও অতি মহিমান্বিত। তারা যা শরিক করে, তা থেকে তিনি পবিত্র।’ (সুরা হাশর- ৩৩)।
মানুষ আল্লাহর উপর নির্ভর না করে বানোয়াট নিয়ম নীতি ও কথাবার্তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। যার ফলে মানুষের অন্তর থেকে ঈমান আক্বীদা লোপ পেতে থাকে । কুসংস্কার করার সময় অনেক মানুষ তো এটা বলে থাকে যে মুরুব্বিদের কথা মানতে হয়। অথচ মানুষ আল্লাহর করা হুকুমের গুরুত্ব দেয় না , আল্লাহর তৈরি বিধিবিধান গুলোকে মান্য করে না , আল্লাহর দেওয়া ফরয বিধান আদায় করে না । রাসূল সাঃ এর সুন্নত পালন করে না । কিন্তু কুসংস্কার গুলো খুব গুরুত্বের সাথে পালন করে। অথচ এগুলোতে বিশ্বাস স্থাপন করতে স্বয়ং আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাঃ নিষেধ করেছেন ।
রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন: “সংক্রামক বলতে কিছু নেই। তারকার ( উদয় বা অস্ত যাওয়ার) কারনে বৃষ্টি হওয়া ভিত্তিহীন এবং ছফর মাসে অশুভ বলতে কিছু নেই !” (মুসলিম শরীফ, হাদীস ৫৫৯৯)।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুসংস্কার থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন, আমীন!
লেখিকা: ইসলামিক প্রাবন্ধিক।
উম্মাহ২৪ডটকম: আইএএ