।। মাওলানা তাজুল ইসলাম আশরাফী ।।
মহান আল্লাহর নৈকট্য ও তাঁর সাথে সম্পর্কের গভীরতা তাকওয়া ও ইবাদাতের চেতনায় উদ্বুদ্ধ মুমিনের অমূল্য সম্পদ। আর হজ্জ সে তাকওয়া ও ইবাদাত চর্চার এক রূপময় কর্মশালা এবং শিরক, কুফর ও বিদআত মুক্ত হয়ে ঈমানের অনুপম মাহত্ম্য অর্জনের এক সমৃদ্ধ পাঠশালা। হজ্জ নামক এ পাঠশালাতেই আল্লাহর সাথে গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের সম্পর্ক, আনুগত্যের নানামুখী সুষমায় সিক্ত হয় তাদের মন, আল্লাহর সামনে দীনতা হীনতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে ঔজ্জ্বল্য পায় তাদের হৃদয়।
হজ্জের মধ্যে আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতের নানাবিধ কল্যাণের বিপুল সমারোহ ঘটিয়েছেন বলেই সে সব কল্যাণের অর্জনকে তিনি হজ্জের লক্ষ্যমাত্রা ও মূলমর্ম হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। তিনি পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন-
অর্থাৎ- ‘‘আর তুমি মানুষের মধ্যে হজ্জের ঘোষণা দাও, তারা তোমার কাছে আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রসমূহের পিঠে চড়ে, তারা আসবে দূর দূরান্তের পথ অতিক্রম করে; যাতে তারা প্রত্যক্ষ করতে পারে তাদের জন্য নির্ধারিত সকল কল্যাণ’’। (সুরা আল-হাজ্জ- ২৭-২৮)।
সুদীর্ঘকাল ধরে এ সকল কল্যাণের ফল্গুধারা মুসলিম মানসকে করেছে সমৃদ্ধ, চেতনাকে করেছে উজ্জীবিত, ইবাদাতকে করেছে সুষমামন্ডিত এবং প্রাত্যহিক জীবনকে করেছে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যে অলংকৃত। হজ্জ নামক ইবাদাতের সুবিশাল পাঠশালায় ছড়িয়ে আছে নানামুখী শিক্ষার মহাসমারোহ। সে সব শিক্ষা অর্জন করতে পারলেই হজ্জের তাৎপর্য ও মর্মার্থ অনুধাবন করা সম্ভব হবে। হজ্জের সে সব কল্যাণমুখী শিক্ষার মহাসম্ভার থেকে আমরা প্রধানতম বিষয়গুলোকে নিচে আলোচনার জন্য বেছে নেব।
প্রথমতঃ মহান আল্লাহর দেয়া শরীয়তের প্রতি নিরংকুশ সমর্থন ও আত্মসমর্পণ
আমাদের বুদ্ধি-বিবেক, চিন্তা-চেতনা ও আমলকে আল্লাহমুখী করা ও আল্লাহর নিরংকুশ আনুগত্যে সমৃদ্ধ করা আমাদের ঈমানী চেতনার এক অনিবার্য দাবী। এদিকেই ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ রাববুল আলামীন ইরশাদ করেন-
অর্থাৎ- ‘‘তোমার রবের কসম! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তারা তোমাকে বিচারক নির্ধারণ করবে, তারপর তুমি যে ফয়সালা দেবে সে ব্যাপারে নিজেদের অন্তরে কোন দ্বিধা অনুভব করবে না এবং পূর্ণ সম্মতিতে মেনে নেবে।’’ (সূরা আন্-নিসা- ৬৫)।
দ্বিধাহীন আনুগত্যের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হল হজ্জ। পবিত্র স্থানসমূহের মধ্যে হাজীদের বিচরণ, বায়তুল্লায় তাদের তাওয়াফ, হাজারে আসওয়াদে চুম্বন ও জামারাতে কংকর নিক্ষেপ ইত্যাদিসহ হজ্জের সকল কর্মকান্ডেই সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে শরীয়তের প্রতি প্রবল আনুগত্য, আত্মসমর্পণ ও সর্বান্তকরণে শরীয়তের সকল বিধি-বিধান মেনে নেয়ার জীবন্ত উদাহরণ।
হজ্জের এ পবিত্র ভূমিতে এসেই আল্লাহর নবী ইবরাহীম ও ইসমাঈল আ. তাদের নিজেদের জন্য ও অনাগত প্রজন্মের সন্তানদের জন্য অনুগত মুসলিম হওয়ার দো‘আ করেছিলেন এভাবে-
অর্থাৎ- ‘‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে আপনার অনুগত করুন এবং আমাদের বংশধরদের মধ্য থেকে আপনার অনুগত জাতি বানান। আর আমাদেরকে আমাদের ইবাদাতের বিধি-বিধান দেখিয়ে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’’ (সুরা আল-বাকারাহ- ১২৮)।
হজ্জের সেই পবিত্রভূমিসমূহে আজো তাই সম্মানিত হাজীগণের আগমন ঘটে নিরংকুশ আনুগত্যের সে মহড়া দেয়ার জন্যই। আমীরুল মুমিনীন উমার ইবনুল খাত্তাব রা. হাজারে আসওয়াদকে চুম্বন দিতে গিয়ে এ দৃষ্টিভঙ্গিরই সার্থক প্রতিধ্বনি করেছেন এ কথা বলে যে-
অর্থাৎ- ‘‘নিশ্চয়ই আমি জানি তুমি একটি পাথর, তুমি কোন ক্ষতি করতে পার না এবং কোন উপকারও করতে পার না, রাসূল সা. তোমাকে চুম্বন করেছেন – এটা যদি আমি না দেখতাম, তাহলে তোমাকে চুম্বন করতাম না।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪৯৪)
হাফিয ইবন হাজার (রাহ.) বলেন, ‘‘উমার (রাযি.)এর এ উক্তির মধ্য দিয়ে দ্বীনী ব্যাপারে শরীয়তের দ্বিধাহীন আনুগত্য এবং মর্ম ও নিগুঢ় তত্ত্ব বোধগম্য হচ্ছে না এমন বিষয়ে শরীয়তের সুন্দর অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণিত হল। রাসূল সা. যা করেছেন যদি তার অন্তর্নিহিত মর্ম ও হিকমাত বোঝা নাও যায় তবু তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণের অপরিহার্যতার ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে শরীয়তের মহান মূলনীতি।’’ (ফাতহুল বারী- ৩/৪৬৩)।
ইমাম ইবনুল কাইয়েম (রাহ.) বলেন, ‘‘আল্লাহর ইবাদাত ও গোলামী এবং তাঁর প্রতি, তাঁর গ্রন্থসমূহ ও রাসূলগণের প্রতি ঈমানের ভিত্তি হল তা দ্বিধাহীনভাবে মেনে নেয়া এবং শরীয়তের আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধানের হিকমাত বিষয়ে সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম প্রশ্ন উত্থাপন না করা। এজন্য যে নবীর উম্মাত তাঁকে সত্যায়ন করেছে এবং তাঁর আনীত সত্য বিধানের প্রতি ঈমান এনেছে সে নবীর উম্মাতের বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু একথা বলেননি যে, তারা আদেশ, নিষেধ ও প্রচারিত সত্যের বিস্তারিত হিকমাত ও যৌক্তিকতা তুলে তাঁকে প্রশ্নবানে বিদ্ধ করেছে; বরং তারা আনুগত্য পোষণ করেছে, মেনে নিয়েছে, ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে এবং যে হিকমাতসমূহ জানার মত তা জেনেছে আর যেগুলো গোপন ও অজানা থেকে গেছে সেগুলো জেনে নেয়ার উপর নির্ভর করে তাদের ঈমান, আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ স্থগিত হয়ে যায়নি।….. যেমন ইঞ্জিলে বলা হয়েছে, ‘‘ হে বনী ইসরাঈল, তোমরা বলো না : কেন আমাদের রব এ নির্দেশ দিয়েছেন? বরং তোমরা বল, আমাদের রব কি নির্দেশ দিয়েছেন?’’ এজন্যই এ মুসলিম উম্মাহ বুদ্ধি, বিবেক ও জ্ঞানে সবচেয়ে বেশী পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ, তাদের নবীকে তারা জিজ্ঞাসা করেনি, কেন আল্লাহ এ নির্দেশ দিয়েছেন? আর কেন ওটা থেকে নিষেধ করেছেন? কারণ তারা জানে, এ প্রশ্ন ঈমান ও আত্মসমর্পণ বিরোধী এবং ইসলামের বৈশিষ্ট্যই হল শুধু মেনে নেয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত।’’ (আস-সাওয়া‘য়েক আল-মুরসালা- ৪/১৫৬০-১৫৬১)।
দ্বিতীয়তঃ তাওহীদ তথা একত্ববাদের চর্চা ও প্রতিষ্ঠা
মহান হজ্জব্রতের সকল বিধান ও কর্মকান্ডই তাওহীদ তথা একত্ববাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষের চিন্তা, চেতনা ও কর্মে একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করাই হজ্জের অন্যতম লক্ষ্য। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থাৎ- ‘‘আর তোমরা হজ্জ ও উমরা আল্লাহর জন্য সম্পন্ন কর।’’ (সূরা আল-বাকারাহ- ৯৬)।
কা’বাকে শিরক মুক্ত করার প্রসঙ্গটি এনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থাৎ- ‘‘আর স্মরণ কর, যখন আমি ইবরাহীমকে সে ঘরের (বায়তুল্লাহর) স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম, আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না আর আমার ঘরকে পাক সাফ রাখবে তাওয়াফকারী, দাঁড়িয়ে সালাত আদায়কারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য।’’ (সূরা আল-হাজ্জ : ২৬)।
তাওহীদের চিরন্তন ধারাকে অভ্রান্ত ও নির্ভেজাল রাখার জন্যই সূরা আল-হাজ্জে আল্লাহ শির্ক তথা তাওহীদ বিরোধী সকল কর্মকান্ড সম্পর্কে এভাবে সতর্ক করেন-
অর্থাৎ- ‘‘সুতরাং মূর্তিপূজার অপত্রিতা থেকে বিরত থাক এবং মিথ্যা কথা পরিহার কর আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ হয়ে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করে।’’ (সূরা আল-হাজ্জ- ৩০-৩১)।
হজ্জের মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাওহীদকেই প্রিয় নবী সা. তাঁর জীবনের মধ্যমনি বানিয়েছেন ও এর জন্যই সর্বস্ব উৎসর্গ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। পবিত্র হজ্জ পালনে রাসূলুল্লাহ সা. এর নিম্নবর্ণিত কর্মধারা ও আমল একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলে এ বিষয়টি মূর্ত হয়ে ওঠে।
১. তালবিয়ার মহান ধ্বনি :
তালবিয়া হচ্ছে হজ্জের শ্লোগান। আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য ও তাগুতকে অস্বীকার করার উদ্দেশ্যেই ইহরামের নিয়ত করার সাথে সাথে তালবিয়া পাঠ হাজীদের জন্য নিয়ম করে দেয়া হয়েছে। তালবিয়ার ঘোষণায় একথা শনৈঃ শনৈঃ অনুরণিত হতে থাকে যে, ‘‘ইবাদাত-আরাধনা, জীবন-মরণ সবকিছুই একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত।’’
হযরত জাবের (রাযি.) বর্ণনা করেন-
অর্থাৎ- ‘‘তাওহীদ দিয়েই রাসূল (সা.) তালবিয়া শুরু করলেন ও বললেন, আমি হাজির, হে আল্লাহ, আমি হাজির। আমি হাজির, তোমার কোন শরীক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা, নিয়ামত ও রাজত্ব তোমার, তোমার কোন শরীক নেই।’’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২১৮)।
তালবিয়ার শব্দমালায় এক আল্লাহর সান্নিধ্যে হাজিরা দেয়া ও তাঁর লা-শরীক হবার ঘোষণা বারবার উচ্চারিত হয়, আলোড়িত হয় একত্ববাদ অবিচল দৃঢ়তায়। তালবিয়া যেন সকল পৌত্তলিকতা, প্রতিমা-পূজা অথবা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন সত্তার সমীপে দীনতা-হীনতা ও আনুগত্য প্রকাশের বিরুদ্ধে এক অমোঘ ঘোষণা, যে ঘোষণার সার্থক রূপায়ন ঘটতে দেখা যায় রাসূলুল্লাহ সা.এর জীবনে শির্ক ও মুশরিকদের সকল অসার কর্মকান্ড থেকে নিজেকে ও অনুসারী সকল সাহাবাকে মুক্ত করে নেয়ার মাধ্যমে।
২. ইখলাস ও ঐকান্তিকতা :
ইবাদাত পালনে ইখলাস ও ঐকান্তিক নিষ্ঠা যেন অর্জিত হয় এবং রিয়া ও প্রদর্শনেচ্ছা থেকে যেন দূরে থাকা যায় সে জন্য মহান রবের দরবারে আকুতি-মিনতি তাওহীদমুখিতারই বহিঃপ্রকাশ। এ প্রসঙ্গে আনাস রা. থেকে একটি মারফু হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
অর্থাৎ- ‘‘হে আল্লাহ, এমন হজ্জ চাই যা হবে রিয়া ও লোক দেখানো থেকে মুক্ত।’’ (সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২৮৯০)।
৩. তাওয়াফের দু’রাকাত সালাত :
তাওয়াফ শেষে যে দু’রাকাত সালাত আদায় করতে হয় তাতে সূরা ইখলাস ও সূরা আল-কাফিরূন পাঠের সুন্নাত তাওহীদের প্রতি গুরুত্বেরই বহিঃপ্রকাশ। হযরত জাবির (রাযি.)এর বর্ণিত হাদীসে এসেছে-
অর্থাৎ- ‘‘হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এ দু’ রাকাতে তাওহীদের সূরা ও ‘কুল ইয়া আইয়ুহাল কাফিরূন’ পাঠ করলেন’’। (সুনান আবি দাঊদ, হাদীস নং- ১৯১৯, সুনান আত-তিরমিযী, হাদীস নং- ৮৬৯)।
৪. সাফা-মারওয়ায় সা‘ঈ করার দোআ
সাফা-মারওয়ায় সায়ী করার প্রাক্কালে তাওহীদ বিষয়ক দো‘আ একত্ববাদের সাথে রাসূলুল্লাহ সা.এর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ককে প্রকটভাবে ফুটিয়ে তোলে। হযরত জাবির (রাযি.)এর হাদীসে এসেছে-
অর্থাৎ- ‘‘অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পাহাড় দিয়ে শুরু করে তাতে আরোহণ করলেন, কা‘বা দৃষ্টিগ্রাহ্য হলো, তিনি কিবলামুখী হয়ে আল্লাহর একত্ববাদের কথা বললেন এবং তাঁর মাহাত্ম্যের ঘোষণা দিলেন। তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই। তিনি একক তাঁর কোন শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, প্রশংসাও তাঁর। তিনি সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান’…….।’’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ১২১৮)।
৫. আরাফার দোআ :
আরাফার দোআ ও যিকরসমূহেও তাওহীদের বাণী উচ্চারিত হয়েছে। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
অর্থাৎ- ‘‘উত্তম দোআ হলো- ‘আরাফার দিবসের দোআ। আর আমি ও আমার পূর্ববর্তী নবীদের সর্বোত্তম কথাটি হলো – ‘আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোন ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, প্রশংসাও তাঁর। তিনি সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান।’’ (সহীহ সুনান আত-তিরমিযী, হাদীস নং ২৮৩৭)।
আরও পড়তে পারেন-
- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান
- ইসলামের আলোকে নারীর কর্মপরিধি
- সালাম: উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষার অন্যতম বাহন
- বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ: বাস্তবতা ও অপপ্রচার
- সকালের ঘুম যেভাবে জীবনের বরকত নষ্ট করে
হজ্জের প্রতিটি কর্মে তাওহীদের অমোঘ বাণীর বহুমুখী উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, যা হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্জ বিষয়ক স্বীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে উম্মাতের উদ্দেশ্যে বারবার তুলে ধরেছেন। তাই হজ্জ পালনকারী প্রতিটি ব্যক্তিরই উচিত তাওহীদের নির্ভেজাল শিক্ষা জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে দেয়া এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাওহীদের ধারক-বাহক বনে যাওয়া।
তৃতীয়তঃ আল্লাহর নিদর্শন ও সীমারেখাসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন
মহান আল্লাহ তাঁর নিদর্শনসমূহ ও নির্ধারিত সীমারেখার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি যে সব বিষয়কে সম্মান করার নির্দেশ দিয়েছেন সেগুলোকে যথার্থভাবে সম্মান করা আল্লাহর নিষ্ঠাবান বান্দা হওয়ার শর্ত ও কল্যাণ অর্জনের পথ হিসাবে বিবেচিত। পবিত্র কুরআনে হজ্জের কিছু আহকাম উল্লেখ করার পর আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
অর্থাৎ- ‘‘এটাই এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখার সম্মান রক্ষা করে, তার রবের কাছে তা উত্তম।’’ (সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত- ৩০)।
নির্ধারিত সীমারেখা বলতে পূর্বের আয়াতে বর্ণিত হজ্জের কাজগুলোকে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন-
অর্থাৎ- ‘‘ওটাই এবং যারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে, তা তাদের হৃদয়ের তাহকওয়ার অন্তর্গত।’’ [সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত- ৩২)।
আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান প্রদর্শনের অর্থ হলো সেগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, ভালবাসা পোষণ ও সেগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট ইবাদাত সঠিকভাবে পালন। ইমাম ইবনুল কাইয়েম রাহেমাহুল্লাহ বলেন, ‘‘ইবাদাতের প্রাণ হলো শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। যখন এর কোন একটি অন্যটি থেকে বিচ্ছিন্ন হবে তখন ইবাদাতটি নষ্ট হবে।’’ [মাদারিজুস সালিকীন ২/৪৯৫]
অন্যদিকে আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি তাচ্ছিল্য, অনীহা, অবজ্ঞা, অবহেলা প্রদর্শন ও তাঁর নির্ধারিত সীমারেখা লংঘন করা থেকে তিনি কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। বায়তুল্লায় পাপ কাজে লিপ্ত হওয়ার ভয়ংকর পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থাৎ- ‘‘আর যে ব্যক্তি এতে পাপ কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করবে, আমি তাকে বেদনাদায়ক শাস্তি আস্বাদন করাবো।’’ (সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত- ২৫)।
আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন-
অর্থাৎ- ‘‘এগুলো আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং তোমরা তা লংঘন করো না। আর যারা আল্লাহর সীমারেখাসমূহ লংঘন করে বস্তুত তারাই যালিম।’’ (সূরা আল-বাকারাহ- ২২৯)।
পবিত্র হজ্জে রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন বিচিত্রধারায় প্রকাশ পেয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ নিচে সে সবের কিছু দিক তুলে ধরা হলো-
১. ইহরামের জন্য গোসল করা ও গোসলের পর খুশবু ব্যবহার করা :
অর্থাৎ- যায়েদ ইবন সাবিত (রাযি.) বলেন, ‘‘রাসূলুল্লাহ (সা.) ইহরামের জন্য প্রস্তুত হলেন এবং গোসল করলেন।’’ (সুনান আত-তিরমিযী, হাদীস নং ৬৬৪)।
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন, ‘‘আমি রাসূলুল্লাহ সা.এর গায়ে ইহরামের নিয়ত করার পূর্বে উত্তম খশবু লাগাতাম।’’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ১১৮৯)।
২. শুরুতেই তাওয়াফ করা :
মক্কায় আগমনের পর মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করেই রাসূলুল্লাহ (সা.) তাওয়াফ আরম্ভ করতেন। এটা আল্লাহর নির্ধারিত হজ্জের পবিত্র অনুষ্ঠানাদি ও নিদর্শনের প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধার উদাহরণ। হযরত আয়েশা (রাযি.)এর বর্ণনা অনুসারে রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মক্কায় আগমন করলেন, শুরুতেই অযু করলেন ও তাওয়াফ সম্পাদন করলেন।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৬১৫)।
৩. হাজারে আসওয়াদ চুম্বন :
হাজারে আসওয়াদের প্রতি হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)এর যত্ন ও সম্মানবোধও আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান দেখানোর একটি অংশ। রাসূলুল্লাহ (সা.) হাজারে আসওয়াদকে স্পর্শ করেছেন, চুমু খেয়েছেন, এর উপর সিজদা করেছেন ও এর পাশে কেঁদেছেন। সুওয়াইদ ইবন গাফালাহ রা. বলেন, ‘‘আমি উমারকে দেখেছি, তিনি হাজারে আসওয়াদকে চুমু খেয়েছেন, আঁকড়ে থেকেছেন এবং বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে তোমার প্রতি অত্যাধিক শ্রদ্ধাশীলরূপে দেখেছি।’’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২৭১)।
হযরত ইবন আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, ‘‘আমি উমার ইবনুল খাত্তাব রা.কে দেখেছি তিনি হাজারকে চুমু খেয়েছেন ও এর উপর সিজদা করেছেন। এরপর বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে এরূপ করতে দেখেছি, তাই তা করেছি।’’ (আস-সুনান আল-কুবরা, বায়হাকী, ৫/৭৪)।
হযরত জাবির (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) হাজারে আসওয়াদ দিয়ে শুরু করে তাতে চুমু খেলেন। কান্নায় তাঁর দু’ চোখ অশ্রুসিক্ত হল।’’ (আস-সুনান আল-কুবরা, বায়হাকী, ৫/৭৪)।
৪. কুরবানী করা :
হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যুলহুলাইফা থেকে হজ্জের কুরবানীর জন্তু হিসাবে সঙ্গে করে উট নিয়ে এসেছেন, যা আল্লাহর নিদর্শন বলে পরিগণিত। আল্লাহ ইরশাদ করেন-
অর্থাৎ- ‘‘আর উটগুলোকে আমি তোমাদের জন্য করেছি আল্লাহর নিদর্শন।’’ (আল-হাজ্জ- ৩৬)।
রাসূলুল্লাহ সা. কুরবানীর কিছু জন্তুকে চিহ্নিত করলেন এবং এগুলোর গলায় বা কুঁজে মালা ঝুলালেন। রাসূলুল্লাহ সা. এ মর্মে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন যে, যে ব্যক্তি আরোহণের জন্তু পেল সে যেন কুরবানীর পশুতে আরোহণ না করে, যেমনটি জাবির রা. এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩২৪)।
৫. জামরাতুল আকাবায় কঙ্কর নিক্ষেপের পূর্ব পর্যন্ত তালবিয়া পাঠ :
হজ্জে প্রবেশ থেকে শুরু করে দশ যিলহজ্জ জামরাতুল আকাবায় কঙ্কর নিক্ষেপের পূর্ব পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সা.এর তালবিয়া পাঠ আল্লাহর নির্ধারিত পবিত্র অনুষ্ঠানাদির প্রতি সম্মান প্রদর্শনেরই উদাহরণ। আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রা. বলেন, ‘‘যিনি সত্যসহ মুহাম্মাদকে পাঠিয়েছেন তাঁর কসম, আমি মিনা থেকে আরাফায় রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে গিয়েছি, তিনি কখনো তালবিয়া পড়া থেকে বিরত হননি জামরাতুল আকাবায় কঙ্কর নিক্ষেপের পূর্ব পর্যন্ত, হাঁ যদি মাঝখানে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ অথবা ‘আল্লাহু আকবার’ মেলাতে চাইতেন তাহলে।’’ (সহীহ ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ২৮০৬)।
৬. মুযদালিফায় মাশ‘আরুল হারামে দাঁড়িয়ে থাকা :
আল্লাহর নিদর্শনসমূহ ও হজ্জের পবিত্র অনুষ্ঠানাদির প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানোর আরেকটি উদাহরণ হলো মুযদালিফায় কুযাহ পাহাড়ের সন্নিকটে রাসূলুল্লাহ সা. এর দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা। এ সময় তিনি আল্লাহর স্মরণে নিয়োজিত থেকেছেন, আল্লাহর আশ্রয়ে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন এবং তাঁর সামনে নিজেকে দীন-হীনরূপে পেশ করেছেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২১৮)।
৭. হজ্জের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল স্থান ও কালকে সম্মান করা :
হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন-
অর্থাৎ- ‘‘নিশ্চয়ই তোমাদের রক্ত ও সম্পদ তোমাদের জন্য হারাম, তোমাদের এ মাস. এ শহর ও এ দিবস হারাম হওয়ার মতই।’’ (সুনান আবি দাউদ, হাদীস নং ১৭৬৫)।
তিনি আরো বলেছেন-
অর্থাৎ- ‘‘ নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট সবচেয়ে সম্মানিত দিন কুরবানীর দিন ও এর পর পরবর্তী দিন।’’ (সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ১৭৬৭)।
লক্ষ্য করলে দেখা যায়, হজ্জ পালনকারীদের অনেকে আল্লাহর নির্দেশ ও নিদর্শনসমূহের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শনের প্রতি আন্তরিক নয়। ফলে অনেকক্ষেত্রেই তাদের দ্বারা প্রকাশ্যে সীমালংঘিত হচ্ছে, যা পবিত্র হজ্জের অমর্যাদারই নামান্তর। এটা সঠিকভাবে আল্লাহর নির্দেশের মূল্যায়ন ও মর্যাদা প্রদর্শনে ব্যর্থতারই আলামত।
ইমাম ইবনুল কাইয়েম রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘‘আল্লাহকে যথাযথ মর্যাদা দেখালো না ঐ ব্যক্তি যার কাছে আল্লাহর নির্দেশ তুচ্ছ বলে মনে হল, ফলে তা অমান্য করলো। তাঁর নিষেধাজ্ঞা হালকা বলে মনে হলো ফলে সে নিষিদ্ধ কাজটি করে ফেলল। তাঁর হক ও অধিকারটি হীন বলে মনে হলো ফলে সে তা নষ্ট করলো। তাঁর যিকর নিরর্থক বলে মনে হলো ফলে সে তা উপেক্ষা করলো ও তার হৃদয় এ থেকে গাফিল রইল। আল্লাহর সন্তুষ্টির চেয়ে নিজের প্রবৃত্তিই তার কাছে প্রাধান্যপ্রাপ্ত হলো। আল্লাহর আনুগত্যের চেয়ে তার সৃষ্টির আনুগত্য তার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো।’’ (আল-জাওয়াবুল আল-কাফী পৃঃ ৯৮)।
চতুর্থতঃ শিরকে লিপ্ত ব্যক্তিবর্গ থেকে দায়মুক্ত হবার ঘোষণা ও ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের বিপরীত কাজ করা :
ইসলাম ও শির্ক বিপরীতধর্মী দু‘টি বিষয় যা কোনদিন একত্রে সহাবস্থান করতে পারে না। এ দুয়ের একটির উপস্থিতির অর্থ অন্যটির প্রস্থান, ঠিক যেমনটি হয়ে থাকে দিবস-রজনীর অনিবার্য বৈপরিত্বের ক্ষেত্রে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হজ্জের সময় অত্যন্ত সচেতনভাবে মুশরিকদের উল্টো কাজ করতে যত্নবান ছিলেন ও হজ্জকর্মে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের আদর্শের অনুসরণ করেছেন। যেসব হজ্জকর্মে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইচ্ছাকৃতভাবে মুশরিকদের বিপরীতে কাজ করেছেন তা অনেক, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
তালবিয়া : তালবিয়া পড়তে গিয়ে মুশরিকরা শিরকের ঘোষণা দিত। তারা বলত, إِلَّا شَرِيكًا هُوَ لَكَ تَمْلِكُهُ وَمَا مَلَكَ“তবে তোমার একজন শরীক আছে, যার তুমিই মালিক এবং তার যা কিছু রয়েছে তারও”। (সহীহ মুসলিম, হাদীস-২০৩২)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসে তালবিয়ায় নির্ভেজাল তাওহীদের ঘোষণা দিলেন এবং ইবাদাত একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করলেন আর প্রবলভাবে শিরক থেকে দায়মুক্তির অমোঘবাণী উচ্চারণ করলেন ‘লা-শারীকা-লাকা’ বলে।
উকুফে আরাফা : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফায় অবস্থানকে হজ্জের মূল প্রোগ্রামে পরিণত করলেন তার ঐতিহাসিক বাণীর মাধ্যমে যে, الْحَجُّ عَرَفَة “আরাফায় অবস্থানই হলো হজ্জ”। (সুনান আন্-নাসায়ী, হাদীস-৩০১৬)।
হাজীদেরকে নিয়ে তার এ আরাফার অবস্থান ছিল মুশরিকদের পুরোপুরি বিপরীত; কেননা মুশরিকরা আরাফায় অল্প কিছু সময় থেকে তারপর মুযদালিফায় চলে যেতো এ দাবি সাপেক্ষে যে, আমরা হারামের সীমানার ভেতরে তেকেই প্রস্থান করব, হারামের বাহির থেকে নয়। (সহীহ মুসিলিম, হাদীস- ১২১৮)।
শুধু তা ই নয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরাফার খুতবায় জাহিলী যুগে মুশরিকদের কৃত যাবতীয় শির্কী ও হারাম কার্যকলাপ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার ও দায়মুক্ত হবার যুগান্তকারী ঘোষণা দিলেন। তিনি বললেন-
অর্থাৎ- “জাহিলী যুগের সকল কিছু আমার দু’পায়ের নিচে দলিত হলো, জাহিলী যুগের সকল হত্যা-পণ বাতিল বলে ঘোষিত হলো, আর আমাদের হত্যাসমূহের প্রথম হত্যা – ইবনে রাবিয়া/ রাবিয়া ইবনুল হারিস ইবনু আবদুল মুত্তালিবের হত্যা-পণ বাতিল বলে ঘোষণা করছি। বনী সা’দে দুগ্ধপান অবস্থায় তাকে হুযাইল গোত্র হত্যা করে। আর জাহিলী যুগের সকল সুদ মওকুফ বলে ঘোষিত হলো। আর প্রথম সূদ মওকুফ করছি আমাদের সুদ, আব্বাস ইবনু আবদুল মুত্তালিবের সুদ। এর পুরোটাই মওকুফ। (সহীহ মুসলিম, হাদীস-১২১৮)।
আরাফাহ ও মুযদালিফা থেকে প্রস্থান : আরাফা ও মুযদালিফা থেকে প্রস্থানের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চিরাচিরিত মুশরিকী প্রথা রহিত করে দিলেন। মুশরিকদের প্রথা ছিল – সূর্যাস্তের আগেই আরাফা ত্যাগ করা এবং পরদিন সূর্যোদয়ের পর মুযদালিফা ত্যাগ করা। পক্ষান্তরে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরাফা থেকে সূর্যাস্তের পর এবং মুযদালিফা থেকে সূর্যোদয়ের পূর্বে প্রস্থান করেন। আর মুমিনদেরকেও সে নির্দেশনা প্রদান করেন। সাহাবী মিসওয়ার ইবন মাখরামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন-
অর্থাৎ- “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরাফায় আমাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করলেন। তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করলেন এবং বললেন, ‘মুশরিক ও পৌত্তলিকরা এখান থেকে প্রস্থান করত সূর্যাস্তের সময় যখন সূর্য পাহাড়ের উপর পুরুষের পাগড়ীর মত অবস্থান করত। আমাদের আদর্শ তাদের থেকে ভিন্ন। তারা মাশআরুল হারাম থেকে পাহাড়ের চূড়া বরাবর ঠিক পাগড়ীর ন্যায় সূর্য উঠার সময় প্রস্থান করত। (বায়হাকী, আস-সুনান আল-কুবরা, হাদীস-৯৭৯৩)।
হজ্জের পর আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার উমরা:
মুশরিকরা বিশ্বাস করতো যে, সফর মাসের আগে উমরা করলে তা শুদ্ধ হয় না। মুশরিকদের থেকে বিশ্বাস ও আমলে মুসলিম ব্যক্তিরা যে ভিন্ন, তা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে হজ্জের পর পরই উমরাহ করার অনুমতি প্রদান করেন।
ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, “আল্লাহর কসম, মুশরিকদের প্রথা বাতিল করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশাকে জিলহজ্জ মাসে উমরাহ করার অনুমতি দিয়েছেন। কুরাইশদের এ গোত্রটি ও তাদের অনুসারীরা বলতো, যখন উটের অনেক লোম গজাবে ও পৃষ্ঠদেশ সুস্থ হবে এবং সফর মাস প্রবেশ করবে তখনই উমরাকারীর উমরাহ শুদ্ধ হবে। তারা জিলহজ্জ ও মুহররম মাস অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে উমরাহ করা হারাম মনে করত”। (সুনান আবু দাউদ, হাদীস-১৯৮৭)।
শিরকী কাজ করা হয়েছে এমন স্থানসমূহে ইসলামের নিদর্শন প্রকাশ :
মিনার খায়ফ এলাকার কুরাইশ ও কিনানা গোত্র এ মর্মে বনু হাশিম ও বনু আবদুল মুত্তালিবের বিরুদ্ধে কসম খেয়েছিল যে, তারা যতক্ষণ না মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাদের কাছে সোপর্দ করবে, ততক্ষণ তাদের সাথে তারা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করবে না ও বেচাকেনা করবে না। (সহীহ বুখারী, হাদীস-১৫৯০)।
অবশ্য আল্লাহ তাদের কোন কাজই সিদ্ধ হতে দেননি, বরং ব্যর্থ মনোরথ করে ফিরিয়ে দিয়েছেন। মিনার খায়েফের এ স্থানগুলোতে তিনি ইসলামের নিদর্শন উচ্চকিত করেছেন। ইবনুল কাইয়েম রাহেমাহুল্লাহ বলেন, “এটিই ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অভ্যাস যে, তিনি কুফরের নিদর্শনসমূহের স্থানে তাওহীদের ঝান্ডা উড্ডীন করতেন। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লাত ও উযযার জায়গায় তায়েফের মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। মুশরিকদের বিপরীতে চলার জন্য সাহাবাদেরকেও তিনি নির্দেশ দিতেন। যেমন, কুরাইশদের নিয়ম ছিল – ‘হজ্জ পালন করতে বাহির থেকে আসা কোন ব্যক্তি কুরাইশদের পোষাক ব্যতীত নিজেদের পোষাকে তাওয়াফ করতে পারবে না। আর যে ব্যক্তি এ পোষাক পাবে না সে বিবস্ত্র হয়ে তাওয়াফ করবে’। (ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৩/৫৬৫)।
এ মন্দ প্রথা অপনোদন করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবম হিজরীতে হজ্জ বিষয়ে মানুষের মধ্যে এ বলে ঘোষণা দিতে নির্দেশ দিলেন যে, وَلَا يَطُوفُ بِالْبَيْتِ عُرْيَان “বিবস্ত্র হয়ে কেউ বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে না”। (সহীহ বুখারী, হাদীস-১৬২২)।
জাহিলী যুগে মুশরিকরা মূর্তির উদ্দেশ্যে হজ্জ পালন করত এবং মনে করত যে, সাফা-মারওয়ার মধ্যে সাঈ করা বৈধ নয়। তাদের এ বিষয়টি যে, ইসলামের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় সেটি প্রকটিত হয় যখন আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী অবতীর্ণ হলো-
অর্থাৎ- “নিশ্চয়ই সাফা-মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভূক্ত”। (সূরা আল-বাকারাহ : ১৫৮)।
এ আয়াতটি নাযিল হয়েছিল আনসারদের কিছু লোকের ব্যাপারে যারা জাহিলী যুগে মানতের উদ্দেশ্যে হজ্জের নিয়ত করত। তারপর সাঈ করা – তাদের বিশ্বাস মতে – তাদের জন্য অবৈধ হয়ে যেত। অতঃপর তারা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হজ্জ করতে আসল তখন বিষয়টি তার কাছে উপস্থাপন করলে আল্লাহ এ আয়াতটি নাযিল করেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন-
অর্থাৎ- “আল্লাহ কারো হজ্জ বা উমরাহ পরিপূর্ণ করবেন না, যে সাফা-মারওয়ার মধ্যে সাঈ করেনি”। [সহীহ বুখারী, হাদীস-১৭৯০] এ জন্যই ইমাম ইবনুল কাইয়েম বলেছেন, “মুশরিকদের বিপরীত করার মনোবৃত্তির উপর শরীয়ত স্থির হয়ে গিয়েছে, বিশেষ করে হজ্জের আচার অনুষ্ঠানে”। (ইবনুল কাইয়েম, হাশিয়া আলা আবি দাঊদ ৫/১৪৬)।
পঞ্চমতঃ হজ্জের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন নিশ্চিত করা
হজ্জ তাকওয়া অর্জনের একটি সমৃদ্ধ পাঠশালা। তাকওয়ার মূল মর্ম হচ্ছে আল্লাহর সকল নির্দেশ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নার আলোকে পালন করা এবং সকল নিষেধাজ্ঞা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী বর্জন করা। হজ্জের ছোট বড় কাজকর্মের মধ্য দিয়ে তাকওয়ার সে মর্ম গভীরভাবে উপলদ্ধি করা সহজ হয়, বরং বলা চলে হজ্জের সকল আমল মূলতঃ তাকওয়া অর্জনের এক কার্যকর কর্মশালা। এজন্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন-
অর্থাৎ- ‘‘ওটাই এবং যারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে, তা তাদের হৃদয়ের তাহকওয়ার অন্তর্গত।’’ (সূরা আল-হাজ্জ : ৩২)।
হজ্জের কুরবানীর পশুর রক্ত ও গোশ নয় বরং অন্তরের তাকওয়াই শুধু আল্লাহর কাছে পৌঁছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থাৎ- “কুরবানীর গোশ ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং তোমাদের তাকওয়াই তার কাছে পৌঁছে”। (সূরা আল-হজ্জ : ৩৭)।
পবিত্র হজ্জের সমৃদ্ধ কর্মশালা ও বিদ্যাপীঠ হতে আল্লাহ আমাদেরকে আমল, আখলাক, তাকওয়া ও ইখলাস শেখার তাওফীক দিন এবং আমাদের হজ্জ ও উমরা কবুল করুন। আমীন।।
লেখক: শায়খুল হাদিস- তিলপাড়া মদিনাতুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসা, খিলগাঁও, ঢাকা ও মিফতাহুল উলূম মাদ্রাসা, বাড্ডা, ঢাকা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক- সানমুন ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস, নয়াপল্টন, ঢাকা।
উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম