মিগুয়েল সালাস ডক্টরেট করেছেন কম্পারেটিভ লিটারেচারে। তার মতে, বর্তমান বিশ্বে কিশোর-কিশোরীরা যে এখনো পড়ালেখা করছে এটাই একটি কৃতিত্বপূর্ণ কাজ। এখন স্পেনের মাদ্রিদের একটি স্কুলে পড়ান মিগুয়েল সালাস। তিনি জানান, তার স্কুলের শিক্ষার্থীদের মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা কমে গেছে।
সালাস বিশ্বাস করেন, মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে এবং কোন বিষয় গভীরভাবে বুঝতে পড়ার বিকল্প নেই।
চীন এবং তাইওয়ানের বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছেন সালাস। নিজের বই ‘রিডিং প্লান: সারভাইভিং এডলসেন্স উইথআউট স্টপিং রিডিং’-এ তিনি পরামর্শ দেন, শিক্ষকরা যাতে উচ্চস্বরে পড়ান এবং পাঠ্যবইয়ের লেখা নিয়ে যাতে শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করেন।
অভিভাবকদেরও পড়ার জন্য রুটিন তৈরি এবং লাইব্রেরিতে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। অভিভাবকরা ছোটবেলায় পড়ে মুগ্ধ হয়েছেন, এমন বই পড়তে সন্তানদের সাথে জোরাজোরি না করার কথাও বলেন তিনি।
এল পাইসে প্রকাশিত মিগুয়েল সালাসের সাক্ষাৎতার তুলে ধরা হলো উম্মাহর সুপ্রিয় পাঠকদের জন্য।
প্রশ্ন: ২০০৮ সালের (অর্থনৈতিক) সংকটে শিশুদের বই বিক্রি কমেনি। কিন্তু অভিভাবকরা সে তুলনায় খুম কম বই কিনেছে অর্থাৎ কম পড়েছে।
উত্তর: পড়ার গুরুত্ব বা মর্যাদা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। তবে আমরা পড়ার জন্য খুব বৈরি পরিবেশে বাস করছি। আমরা চাই বা না চাই, খুব দ্রুতই মোবাইল ফোন ব্যবহারের মতো নতুন অভ্যাস গড়ে তুলছি।
প্রশ্ন: বয়ঃসন্ধিকালে মানুষ পড়া বন্ধ করে দেয় কেন?
উত্তর: এসময় মানুষ বন্ধুদের সাথে অভিজ্ঞতা শেয়ার করার উপর বেশি মনোযোগ দেয়। মোবাইল ফোনেই তারা অলস সময় কাটায়। এটি সাশ্রয়ীও। ৩০ সেকেন্ডের কোনো ভিডিও দেখতে তেমন কোনো খরচ হয় না। কিন্তু বই কেনার ক্ষেত্রে এমনটা নয়। যদিও পড়ার মধ্যেই উপকার বেশি।
প্রশ্ন: বইয়ে আপনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
উত্তর: স্মার্টফোনের কারণে আমার ছাত্রদের মনোযোগ অনেক কমে গেছে। আমরা দিনে প্রায় হাজার বার মোবাইল স্পর্শ করি এবং অন্যদের সাথে প্রায় ১৫০ বার যোগাযোগ করি। মোবাইল হাতে সবাই কম আইকিউ থাকা মানুষের মতো কাজ করে। একাডেমিকভাবে ভালো করতে, নাচ ও গানে পারদর্শী হতে মনোযোগ বেশি থাকা প্রয়োজন। শিশুরা এখন টেনে টেন ভিডিও দেখে। কারণ কোন জিনিসের খুঁটিনাটি দেখার মতো মনোযোগ তাদের থাকে না।
প্রশ্ন: এভাবে তো তাদের পক্ষে পুরো একটি উপন্যাস পড়া অসম্ভব।
উত্তর: তারা পড়ে, কারণ তাদের পড়তে হয়। কিন্তু ঠিকই তারা শেষে বিষয়টি পছন্দ করে। আমার স্কুলে আমরা তাদেরকে সপ্তাহে একবার লাইব্রেরিতে নিয়ে যাই পড়ার জন্য। তারা তাদের মোবাইল ফোন বের করতে বা অন্য কোন কাজ করতে পারে না। বেশিরভাগই এটা পছন্দ করে। প্রয়োজন হলো মজাদার কোন কিছু বের করা এবং সেটি পড়ে সময় কাটানো। পরে শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরে এবং সেখানে প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো তারা আবারও মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা ফিরে পেতে শিশুদের সবচেয়ে বড় ব্যয়াম হলো পড়া। ট্যাবের ছড়াছড়ির মধ্যে যেটি অনেকটা যুদ্ধের মতো।
সামাজিক নেটওয়ার্কগুলি মনোযোগের বিভক্তি থেকে অর্থ উপার্জন করে। আমি সবসময় বাচ্চাদের বলি যে, তোমরাই তাদের পণ্য। অন্যথায় সামাজিক মাধ্যমগুলোকে অর্থ প্রদান করতে হতো। সোশ্যাল মিডিয়াকে যোগাযোগের একটি মাধ্যম বলার ধারণাটি মিথ্যা। তারা মূলত বিজ্ঞাপনের একটি মাধ্যম।
আরও পড়তে পারেন-
- ধর্ষণ প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা
- কিশোর অপরাধ রোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে
- আদর্শ পরিবার গঠনে যে সব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরী
- ইসলামে সামাজিক সম্পর্ক এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখার গুরুত্ব
- মানুষ মারা যাওয়ার পর, তাঁর আত্মার কি হয় ?
প্রশ্ন: কোনো একটি বিষয় সুপারিশ করার আগে আপনি কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে আলোচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন।
উত্তর: এটা অপরিহার্য। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করে শুরু করি। আপনাকে তাদের জগতের প্রতি আগ্রহ দেখাতে হবে। আর সেটা খুবই কঠিন। আমি ১১ বছর ধরে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আছি। শুরুতে, আমি বাচ্চাদের বিষয়গুলো বুঝতে পেরেছি। তবে এখন এটি আমার জন্য সত্যিই কঠিন। আগে আমি তাদের বুঝতাম, কারণ আমি টেলিভিশন দেখেছি, এবং তারাও দেখেছে। সময়ে সময়ে আমরা একই জিনিস দেখেছি। কিন্তু এখন আমাদের আর শিশুদের বিনোদন ভিন্ন। ইউটিউব, টিক-টকে সবই আছে…
প্রশ্ন: আপনি কি শিক্ষাগত উদ্দেশ্যে মোবাইল ব্যবহারের বিরুদ্ধে?
উত্তর: এটি প্রয়োজনীয় কোন টুল নয়। মোবাইলে হয়তো স্প্রেডশিট বা ই-মেইল আছে, তবে তার সাথে আছে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ার এক গুচ্ছ উপাদান। আমার মনে হয়েছে, এটি শিক্ষার্থীদের ভুল পথে নিচ্ছে। তারা (মোবাইল ব্যবহার করে) খুব খুশি থাকছে, তবে তারা শিখছে খুব কম। আমি বুঝতে পেরেছি যে, মোবাইল তাদের বোঝার ও সংশ্লেষণ ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে। যখন তারা ক্লাস শিক্ষকের দেওয়া নোট পড়ে, তখন তারা বুঝতে পারে না। কারণ তারা ক্লাসে মনোযোগ দেয়নি।
প্রশ্ন: আপনি সব বয়সীদের মধ্যে পড়া ক্ষমতার অভাবের কথা বারবার বলেছেন।
উত্তর: যখন আমার কাছে কোন জিনিসের নাম জানা থাকে না তখন সে জিনিস বিদ্যমান নেই বলা যায়। ২০ মাস বয়সে, উচ্চ সাংস্কৃতিক স্তরের পরিবারের একটি শিশু ২০০ শব্দ ও নিম্ন সাংস্কৃতিক স্তরের পরিবারের একটি শিশু ২০টি শব্দ ব্যবহার করে। কম শব্দ জানা শিশু দেরিতে পড়তে শেখে। আর যখন তারা শেখার জন্য পড়া শুরু করে, তখন তাদের কাছে কম শব্দ জানা থাকে। অনেক সময় তারা পড়তে পছন্দ করে না। স্কুলে এসে আমরা আমাদের অনেক দুর্বলতাই খুঁজে পাই। কিন্তু আপনি যদি কোনো বিষয় বুঝতেই না পারেন তাহলে সে বিষয়ে উৎসাহী না হওয়াই স্বাভাবিক।
প্রশ্ন: আমাদের কি এই সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আরও পাঠ্য যোগ করা উচিত?
উত্তর: না। শিক্ষকদের আগের গুলোকেই প্রাসঙ্গিক করে পড়ানো উচিত। ক্লাসে জোরে জোরে বই পড়ার বিষয়টি হারিয়ে গেছে। শিক্ষককে পাঠ্যবইগুলি আয়ত্ত করতে হবে, আকর্ষণীয় অংশগুলি বের করতে হবে এবং সেগুলি শিক্ষার্থীদের জীবনের সাথে মিলিয়ে বোঝাতে হবে। ধীরে ধীরে এ বিষয়গুলো করতে হবে।
তার জন্য আমাদেরকে সাহিত্য এবং ভাষাকে পৃথক দুটি বিষয় হিসেবে পড়াতে হবে। একাডেমিক বই পড়ে পাঠক তৈরি হয় না। আমাদেরকে অন্য বই প্রাপ্তী নিশ্চিত করতে হবে। আগ্রহ এবং বিষয় বিবেচনায় বইগুলোকে ভাগ করতে হবে। যাতে তারা একটি পড়া শুরু করে, আর ভালো না লাগলে আরেকটি ধরতে পারে। যদি তারা মোটরসাইকেল ম্যাগাজিনও পড়ে, তাও ঠিক আছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তারা যাতে পড়ার অভ্যাস তৈরি করে।
প্রশ্ন: বইটিতে আপনি বলেছেন যে পড়া সহানুভূতি বাড়ায়।
উত্তর: আমি মনে করি আমরা যারা পাঠক, তারা সবাই এমন একজন ব্যক্তির জায়গায় নিজেকে ভেবেছি বা কল্পনা করেছি যার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। সাহিত্য আপনাকে বোঝায় যে, মানুষ মানুষে পার্থক্য থাকবেই।
সূত্র- টিবিএস।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ