।। মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা ।।
দৈনন্দিন চলার পথে মানুষ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়, তা থেকে মুক্ত হতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের দ্বারস্থ হতে হয়। ইসলামের বিষয়েও মানুষের কৌতূহল ও প্রশ্নের শেষ নেই, সঠিকভাবে আমল করার জন্য বরং এটি অত্যন্ত জরুরি।
ইসলামী বিষয়ে মানুষের এসব জিজ্ঞাসাকে পরিভাষায় ‘ইস্তেফতা’ বলা হয়, প্রশ্নকারীকে বলা হয়, ‘মুসতাফতি’। আর সমাধানকে বলা হয়, ‘ফাতওয়া’, সমাধানদাতাকে বলা হয়, ‘মুফতি’।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বান্দার সমস্যা সমাধান দিতে গিয়ে ‘ফাতওয়া’ শব্দটি নিজের ব্যাপারেও ব্যবহার করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, “তারা তোমার কাছে (ফাতওয়া) সমাধান চায়, বলো, আল্লাহ তোমাদের (ফাতওয়া) সমাধান দিচ্ছেন ‘কালালা’ সম্পর্কে।” (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৭৬)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা তোমার কাছে নারীদের ব্যাপারে (ফাতওয়া) সমাধান চায়। বলো, ‘আল্লাহ তাদের ব্যাপারে তোমাদের (ফাতওয়া) সমাধান দিচ্ছেন এবং (ফাতওয়া) সমাধান দিচ্ছে ওই আয়াতসমূহ, যা কিতাবে তোমাদের পাঠ করে শোনানো হয় এতিম নারীদের ব্যাপারে।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১২৭)
এই আয়াতগুলো দ্বারা আরো জানা যায় যে মানুষ নবীজি (সা.)-এর কাছেও ফাতওয়া জানতে চাইত, নবীজি (সা.) তাদের ফাতওয়া দিতেন। যা পরবর্তী সময়ে ইলমের উত্তরাধিকার সূত্রে বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের দায়িত্বে ন্যস্ত হয়েছে। তাঁরা কোরআন-হাদিসের আলোকে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান বের করেন।
যারা জানে না তাদের দায়িত্ব বিজ্ঞ আলেমদের কাছ থেকে জেনে নেওয়া।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা যদি না জানো, তাহলে তোমাদের (আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে) যারা অবগত, তাদের কাছে জিজ্ঞেস করো।’ (সুরা : নাহাল, আয়াত : ৪৩)
আর আলেমের ওপর ওয়াজিব কোরআন-হাদিসের আলোকে মানুষের এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব দেওয়া, যাতে ইলম গোপন করার গুনাহে লিপ্ত না হতে হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই যারা আমার অবতীর্ণ কোনো দলিল এবং হিদায়াতকে লোকদের জন্য আমি কিতাবের মধ্যে বর্ণনা করার পরও গোপন করে, আল্লাহ তাদের অভিসম্পাত করেন আর অভিসম্পাতকারীরাও তাদের প্রতি অভিসম্পাত করে থাকে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৫৯)
অতএব, যাদের মহান আল্লাহ কোরআন-হাদিসের সঠিক জ্ঞান দিয়েছেন, তাদের জন্য জেনেশুনে জ্ঞান গোপন করা জায়েজ হবে না, যদি কেউ করে, তাহলে তাকে আয়াতের ওয়াদামতে শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। আবার যাদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সঠিক ও যথার্থ জ্ঞান নেই, তাদের জন্য না জেনে ভুলভাল ফতওয়া দেওয়া জায়েজ নয়।
ইরশাদ হয়েছে, ‘বলো, আমার প্রতিপালক অবশ্যই প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা, পাপ, অন্যায়, বিরোধিতা, আল্লাহর অংশীদার স্থির করা, যে ব্যাপারে তিনি কোনো প্রমাণ নাজিল করেননি, আর আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদের অজ্ঞতাপ্রসূত কথাবার্তা নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩৩)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের জিহ্বা থেকে মিথ্যা কথা বেরোয় বলেই তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করার জন্য এমন কথা বলো না যে এটা হালাল, আর এটা হারাম। যারা আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা উদ্ভাবন করে, তারা কখনো কল্যাণ লাভ করতে পারে না।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১১৬)
অতএব, কোনো বিষয়ে যথার্থ জ্ঞান না থাকলে ভুলভাল ফতওয়া দিয়ে অকল্যাণে ডেকে আনা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। একবার এক ব্যক্তি ইমাম মালেক (রহ.)-কে ৪০টি প্রশ্ন করেছিল, তিনি তার ছয়টি প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন, আর বাকি সব প্রশ্নের উত্তরেই বলেছিলেন, আমি জানি না। আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.)-কে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে, তাঁর যদি বিষয়টি না জানা থাকত, তাহলে তিনি ওহির অপেক্ষা করতেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে সমাধান আসার পর তিনি সমাধান দিতেন। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য জায়গায় এমন আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, যেখানে আল্লাহ নবীজি (সা.)-কে সম্বোধন করে বলেছেন, ‘ইয়াসতাফতু-নাকা…’ (তোমার কাছে সমাধান চাওয়া হয় অমুক বিষয়ে)।
কোনো বিষয়ে না জানা থাকলে ‘জানি না’ বলে দেওয়া দোষের কিছু নয়; বরং না জেনে ভুলভাল জবাব দেওয়া ভয়ংকর বিষয়। আবার কোনো স্বার্থে হক জেনেও তা গোপন করা, মানুষকে বিভ্রান্ত করা মহাপাপ। কোনো আলেমের জন্য তা করা কোনোভাবেই উচিত নয়। কিয়ামতের দিন এর জন্য কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘কিতাব থেকে আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, যারা এটা গোপন করে এবং এর বিনিময়ে স্বল্প মূল্য গ্রহণ করে, এরা নিজেদের পেটে একমাত্র আগুন ভক্ষণ করে, ওদের সঙ্গে আল্লাহ কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না এবং ওদের পবিত্রও করবেন না; এবং ওদের জন্য আছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৭৪)
অতএব, কোনো আলেমের জন্য দুনিয়াবি স্বার্থে কোরআন-হাদিসকে পাশ কাটিয়ে প্রশ্নকারীর সুবিধামতো ফাতওয়া দেওয়া কোনোভাবেই জায়েজ হবে না। ইসলামী বিষয়ে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অনর্থক প্রশ্ন করা যাবে না। পবিত্র কোরআনে এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, এমন কথাবার্তা জিজ্ঞেস করো না, যা তোমাদের কাছে পরিব্যক্ত হলে তোমাদের খারাপ লাগবে। যদি কোরআন অবতরণকালে তোমরা এসব বিষয় জিজ্ঞেস করো, তবে তা তোমাদের জন্য প্রকাশ করা হবে। অতীত বিষয় আল্লাহ ক্ষমা করেছেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, সহনশীল। এরূপ কথাবার্তা তোমাদের আগে এক সম্প্রদায় জিজ্ঞেস করেছিল। এরপর তারা এসব বিষয়ে অবিশ্বাসী হয়ে গেল।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ১০১-১০২)
অনেকে আবার হঠাৎ করে কোনো সূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করে নিজের জ্ঞানের বাহার দেখানোর জন্য অথবা উপস্থিত মানুষের কাছে আলেমকে অপদস্ত করার জন্য। অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতি বা বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করে আলেমকে অন্যদের সামনে হেয় করার চেষ্টা করা হয়, যা কোনোভাবেই জায়েজ নয়। আবার আলেমরা অনেক সময় ব্যস্ত থাকেন, ব্যস্ততার সময় তাদের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করা উচিত নয়, এমনিভাবে তিনি কোনো কারণে রাগান্বিত বা চিন্তিত থাকলে সেই মুহূর্তেও প্রশ্ন করা যাবে না।
আরও পড়তে পারেন-
- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান
- ইসলামের আলোকে নারীর কর্মপরিধি
- সালাম: উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষার অন্যতম বাহন
- বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ: বাস্তবতা ও অপপ্রচার
- সকালের ঘুম যেভাবে জীবনের বরকত নষ্ট করে
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে এমন আলেমকে প্রশ্ন করা উচিত, যার জ্ঞান ও তাকওয়ার প্রতি প্রশ্নকারীর আস্থা রয়েছে। অনেকে একই প্রশ্ন একাধিক আলেমকে জিজ্ঞেস করে একাধিক মত পেলে বিভ্রান্ত হয়। অনেকে আবার ইন্টারনেট থেকে বিভিন্ন বক্তব্য শুনে সে ব্যাপারে বিভিন্ন আলেমকে জিজ্ঞেস করে, যারা এমন করে, তাদের মধ্যে সাধারণত দুই ধরনের লোক থাকে, এক এরা বিভিন্ন আলেমের মধ্যে মতানৈক্য তৈরি করার জন্য একই বিষয়ে একাধিক লোকের অভিমত নেয়, পরে আবার অন্যদের কাছে গিয়ে বলে অমুক হুজুর তো বিষয়টা এভাবে বলেছেন।
আরেক ধরনের লোক আছে, যারা নিজের সুবিধামতো উত্তর পাওয়ার আশায় জনে জনে একই প্রশ্ন করে, কারোটা তার ব্যক্তিগত চিন্তার সঙ্গে মিলে গেলে, তারটিই গ্রহণ করে। অথচ ইসলামের অনেক বিষয় আছে গবেষণাসাপেক্ষ। বিভ্রান্তি থেকে বাঁচতে নিরাপদ পদ্ধতি হলো, যেকোনো একজন অভিজ্ঞ ও মুত্তাকি আলেমের কাছ থেকে সমাধান নিয়ে সে মোতাবেক আমল করা।
আলেমদেরও উচিত, পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে প্রশ্নের উত্তরের ব্যাপারে যথাযথ নিশ্চিত হয়ে তারপর উত্তর দেওয়া। প্রয়োজনে সময় নিয়ে কোরআন-হাদিস ও ফিকহের নির্ভরযোগ্য কিতাবগুলো ভালোভাবে দেখে প্রশ্নের সমাধান দেওয়া। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে ঠিক ততটুকুই উত্তর দেওয়া, যতটুকু প্রশ্নকারী জানতে চেয়েছেন।
রোগীকে যেমন রোগ বুঝে সঠিক মাত্রায় ওষুধ দিতে হয়, তেমনি প্রশ্নকারীকেও কোরআন-হাদিস ভালোভাবে গবেষণা করে ঠিক সাবলীলভাবে উত্তর দেওয়া। আর প্রশ্নকারীরও উচিত, প্রশ্ন করার সময় এমন ব্যক্তির কাছে প্রশ্ন করা উচিত, যে সঠিক উত্তর দিতে পারবে।
কোনো জটিল বিষয় জানতে হলে অবশ্যই কোনো নির্ভরযোগ্য রিসার্চ সেন্টারে যাওয়া উচিত, যাতে সমাধানটি সঠিক পাওয়া যায়। জটিল রোগে ডাক্তার দেখাতে যেমন মানুষ অনেক খোঁজখবর নিয়ে নির্ভরযোগ্য হাসপাতাল বা ডাক্তার নির্বাচন করেন, তেমনি ইসলামের বিষয়ে সঠিক সমাধান পেতে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান বা আলেমের কাছে যেতে হবে।
মহান আল্লাহ সবাইকে এই শিষ্টাচারগুলো মেনে চলার তাওফিক দান করুন।
উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ