চীনের শাসকরা ভারতকে ছোট করে দেখতে পছন্দ করে। ভারতের অশান্ত রাজনীতি, ভঙ্গুর অবকাঠামো এবং দারিদ্রকে অবজ্ঞা করে তারা। অন্যদিকে ভারত ভয় এবং ঈর্ষার সংমিশ্রণ নিয়ে সমান হিসাবে বিবেচিত হওয়ার নিছক আশায় তাকিয়ে আছে। এতদিন দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক এমন থাকলেও এখন পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। সীমান্তে সাম্প্রতিক রক্তপাত বৈরিতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিলেও দুই দেশের প্রস্ফুটিত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বরং এমন কিছুর পূর্বাভাস দিচ্ছে যা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সমস্যায় ফেলতে পারে।
১৯২৪ সালের এপ্রিলে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চীন সফর করেন, তখন চীনের বুদ্ধিজীবীরা তার প্রতি মুগ্ধ হননি। প্রথম অ-ইউরোপীয় নোবেল সাহিত্য বিজয়ী হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ভারতের ব্রিটিশ শাসনের তীব্র সমালোচক রবীন্দ্রনাথ এশিয়ার প্রাচীনতম সভ্যতার মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক বন্ধন পুনঃনির্মাণের আশা করেছিলেন।
যদিও নেতৃস্থানীয় চীনা চিন্তাবিদদের কাছে রবীন্দ্রনাথের আহ্বানের গুরুত্ব ছিল না। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সহ-প্রতিষ্ঠাতা চেন দুক্সিউ লিখেছেন, চীনের তরুণদের ‘ভারতীয়করণের’ প্রয়োজন নেই। যদি না তারা চায় যে, তাদের কফিন একদিন ঔপনিবেশিক শক্তির গোড়ালির নিচে পড়ে থাকুক।’
প্রায় এক শতাব্দী পরও চীনা কর্মকর্তা ও পণ্ডিতদের মধ্যে ভারত সম্পর্কে এমন অবজ্ঞা দেখা যায়। তারা পরিসংখ্যান দেখিয়ে দিয়ে বলেন, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময় ভারতের মাথাপিছু জিডিপি চীনের চেয়ে বেশি ছিল। ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে চীন জিডিপি এবং অন্যান্য বিষয়ে ভারতকে ছাপিয়ে যায়। ২০২২ সালে এখন দুই দেশের জনসংখ্যা সমান হলেও চীনের অর্থনীতি তিনগুণের বেশি বড়।
চীনের জেনারেলরাও ভারতকে পাত্তা দিতে নারাজ। ১৯৬২ সালে সীমান্ত যুদ্ধে চীনের বিজয় গর্বের সাথে স্মরণ করা হয়। চীনারা নিজেদের তৈরি আধুনিক অস্ত্রের সঙ্গে রাশিয়া থেকে আমদানির উপর নির্ভরশীল ভারতের অস্ত্রাগারের তুলনা করেন। চীনের একাডেমি অব মিলিটারি সায়েন্সের সিনিয়র কর্নেল ঝাও জিয়াওঝুও বলেন, ‘আগামী ২০-৩০ বছরে চীনের সমপর্যায়ে পৌঁছানোর কোনো সুযোগ নেই ভারতের।
তবুও চীন-ভারত সম্পর্কের মৌলিক বিষয় অর্থাৎ সামরিক খাত এবং অর্থনীতি- এখন এমনভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, যা দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক ও বাকি বিশ্বের প্রতি তাদের আচরণ পুনরায় মূল্যায়ন করতে বাধ্য করছে।
আমেরিকা এবং তার মিত্রদের মধ্যে আশার বিষয় হল, চীনের সাথে ভারতের সীমান্ত সংঘাত অব্যাহত থাকা মানে দিল্লি এমন গণতান্ত্রিক জোটের দিকে যাওয়া যারা ইতোমধ্যে চীনা শক্তিকে সীমাবদ্ধ করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু প্রশ্ন হল: ভারত-চীন যদি সীমান্ত বিরোধ নিরসনের পথ খুঁজে পায়?
প্রথমে সামরিক সমীকরণ বিবেচনা করলে দেখা যায়, ২০০৮ সালে একটি বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা চুুক্তি স্বাক্ষর করার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত কাছাকাছি আসে। তাদের সম্পর্ক আরো জোরদার হয় চীন সীমান্তে কয়েক দফা সংঘর্ষের পর। ২০২০ সালে লাদাখ সীমান্তে ২০ ভারতীয় সেনা এবং অন্তত চারজন চীনা সেনা নিহত হয়। এটি ছিল ১৯৬৭ সালের পর থেকে সীমান্তে দুই দেশের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এবং তিন দশকের আপেক্ষিক স্থিতিশীলতার অবসানও।
ভারতের সশস্ত্র বাহিনী তারপর পাকিস্তান থেকে সরিয়ে চীন সীমান্তে মনোনিবেশ করে। তারা চীনের সাথে সীমান্তে প্রায় ৭০ হাজার সৈন্যের পাশাপাশি ফাইটার জেট এবং সারফেস টু এয়ার মিসাইল স্থানান্তর করেছে। দেশটি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সাথে, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সাথে যৌথ মহড়া সম্প্রসারিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীকে গোয়েন্দা তথ্য ও অতি উচ্চতায় যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধও সম্পর্ক জোরদারে অবদান রেখেছে। ভারতীয় কমান্ডাররা রাশিয়ান অস্ত্রের উপর তাদের নির্ভরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত অস্ত্র কিনতে চায় এবং ভারতেও তৈরি করতে চায়। জুন মাসে ওয়াশিংটনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সশস্ত্র ড্রোন কেনার এবং ভারতে যৌথভাবে ফাইটার-জেট ইঞ্জিন তৈরির চুক্তি নিয়ে অগ্রগতি করেছেন।
চীন কেন সীমান্ত সংঘাতে জড়াচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। হয়তো সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সড়ক নির্মাণের প্রতিক্রিয়া হতে পারে, যা দিল্লিকে আরো বেশি টহলের সুযোগ দেবে। অথবা মীমাংসার বিষয়ের আলোচনার অগ্রগতি নিয়ে হতাশা থেকেও হতে পারে। অথবা আমেরিকার সাথে পূর্বে সম্পর্ক স্থাপনে ভারতকে শাস্তি দিতে চায়। ভারতের দুর্বলতা প্রকাশ করে দেখাতে চায় যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের ওপর নির্ভর করে থাকতে পারে না।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর নর্দান কমান্ডের সাবেক প্রধান দীপেন্দ্র সিং হুডা বলেন, চীন নিজেকে প্রতিযোগিতায় ভারতের চেয়ে ভিন্ন পর্যায়ের মনে করে। অর্থাৎ তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী।
একটি দ্বিমুখী ত্রিভুজ
যদিও ভারত যুুক্তরাষ্ট্রকে বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে সাহায্য করতে পারে। তবে তাইওয়ান বা দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে সংঘাতে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। যুক্তরাষ্ট্র চীনের দাপট সীমিত করতে চাইছে এবং নরেন্দ্র মোদিও তাই। তবে সামরিক বিকল্প কম থাকায় মোদি সীমান্ত ইস্যু নিয়ে বেশি চড়াও হচ্ছেন না। তারচেয়ে বরং কোন ভূখণ্ড হারানো নিয়ে দেশের মানুষের মনোযোগ নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। এমন অবস্থায় আপস সম্ভব বলে মনে হচ্ছে।
দুই দেশের সামরিক কমান্ডারদের মধ্যে ১৮ দফা আলোচনার পর, সৈন্যরা পাঁচটি ফ্ল্যাশপয়েন্ট থেকে ফিরে গেছে। উভয় পক্ষের টহল হবে না এমন ‘বাফার জোন’ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এখন দুটি ফ্লাশপয়েন্ট অবশিষ্ট আছে।
চীন আরেক দফা আলোচনার জন্য চাপ দিচ্ছে এবং ভারতকে অনুরোধ করছে সীমান্ত সমস্যা দিয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মূল্যায়ন না করতে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ১৪ই জুলাই জাকার্তায় চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন এবং সীমান্ত নিয়ে আলোচনা করেন। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি জোর দিয়ে বলছেন, একটি শান্তিপূর্ণ এবং স্থিতিশীল সীমান্ত ছাড়া স্বাভাবিক ব্যবসায়িক সম্পর্ক পুনরায় শুরু করা যাবে না।
দুই দেশের বাণিজ্য বিবেচনা করলে ভারতের সতর্ক বার্তাকেই বাস্তবিক মনে হয়। আধুনিক ইতিহাসে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক খুব বেশি উষ্ণ ছিল না। তবে তা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ২০২০ সাল নাগাদ তা ৮৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদারও হয়ে ওঠে চীন। ভারতে চীনা বিনিয়োগও বাড়তে থাকে। বিশেষ করে প্রযুক্তি, সম্পত্তি ও অবকাঠামো খাতে। চীনা ব্র্যান্ডগুলোও ভারতে জনপ্রিয়। অপ্পো এবং শাওমি ভারতের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া মোবাইল ফোনের তালিকায় আছে।
তবে ২০২০ সালের সীমান্ত সংঘর্ষ এসব ঝুঁকিতে ফেলেছে। ভারত প্রায় ৩২০টি চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে। বেশ কয়েকটি চীনা কোম্পানির উপর কর অভিযান শুরু করে এবং চীনা বিনিয়োগের জন্য ভারত সরকারের অনুমোদনের প্রয়োজনে নতুন নিয়ম চালু করেছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন যে তারা ১৫৭টি প্রাসঙ্গিক আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। এবং তবুও দ্বিপাক্ষিক পণ্য বাণিজ্য ২০২১ সালে ৪৩% এবং গত বছর ৮.৬% বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক সময় সিঙ্গাপুর হয়েও ভারতে বিনিয়োগ হচ্ছে।
ভারতীয় কর্মকর্তারা চীনা আমদানির উপর নির্ভরতা কমাতে এবং অন্য জায়গা থেকে আরও বেশি বিনিয়োগ আনতে চান। বিশেষ করে বড় বহুজাতিক নির্মাতারা চীনের বিকল্প খুঁজছেন। তাদের গন্তব্য হতে পারে ভারত। মে মাসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেন, আমাদেরকে চীনের কাছে সমাধান খোঁজা বন্ধ করতে হবে। ভারতের সমৃদ্ধি চীনা দক্ষতার উপর নির্মিত হতে পারে না।
আরও পড়তে পারেন-
- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান
- ইসলামের আলোকে নারীর কর্মপরিধি
- সালাম: উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষার অন্যতম বাহন
- বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ: বাস্তবতা ও অপপ্রচার
- সকালের ঘুম যেভাবে জীবনের বরকত নষ্ট করে
তবে ব্যক্তিগতভাবে ভারতের অনেক ব্যবসায়ী নেতা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, ভারত সরকার যদি অবকাঠামো এবং উৎপাদনের উন্নয়নে তার লক্ষ্যগুলি অর্জন করতে চায় তবে আসন্ন বছরগুলোতে চীনা আমদানির উপর নির্ভর করতে হবে। যেমন ভারতের ওষুধ শিল্প তার উপাদানগুলোর প্রায় ৭০%-এর জন্য চীনের উপর নির্ভর করে।
অন্যান্য ক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক সমন্বয় রয়েছে। বেইজিং-ভিত্তিক এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতা ভারত। পশ্চিমা-নেতৃত্বাধীন ঋণ সংস্থাগুলোর বিকল্প হিসাবে এই ব্যাংক স্থাপন করে চীন। ভারত ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকেরও সদস্য।
তবে আন্তরিক অর্থনৈতিক বিনিময় সীমান্তে রক্তপাত এড়ানোর গ্যারান্টি দেয় না। দুই দেশের অন্যান্য উত্তেজনার মধ্যে আছে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, ভারতের জন্য অত্যাবশ্যক নদীগুলোর উজানে বাঁধ দেওয়া এবং তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামাকে ভারতের আশ্রয় দেওয়া।
তবুও ক্রমবর্ধমান ব্যবসায়িক সম্পর্ক উভয় পক্ষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আরও ভূমিকা রাখবে। দুই দেশই বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থায় বড় ভূমিকা রাখতে চায়। মানবাধিকার ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে পশ্চিমা সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করে এবং ইসলামী চরমপন্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। উভয়ই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা করেনি।
এছাড়াও আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়। ২০২০ সালের সীমান্ত সংঘাতের আগে নরেন্দ্র মোদি শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ট করতে বদ্ধপরিকর বলেই মনে হচ্ছিল। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পরই জিনপিংকে নিজের রাজ্য গুজরাটে আতিথেয়তা দেন মোদি। পরের বছর মোদি বলেন, ভারত ও চীন একই রকম আকাঙ্খা, চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ ভাগ করে নেয়। বৈশ্বিক অনিশ্চয়তায়, আমরা একে অপরের অগ্রগতিকে শক্তিশালী করতে পারি।
আর যদি এমন কিছুর সম্ভাবনা তৈরি হয়ে ওঠে এবং দুই দেশ বন্ধু হয়ে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশ-যারা ভারতকে চীনের পাল্টা জবাব হিসেবে দেখে, তাদের খুশি হওয়ার কোন কারণ নেই।
সূত্র- দ্য ইকোনমিস্ট , ভায়া- টিবিএস।
উম্মাহ২৪ডটকম:এমএ