।। মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম ।।
মানবজীবন সময়ের সমষ্টি। সময়কে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারোপযোগী করে আল্লাহ তাআলা প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন দিন, রাত, মাস, বছর ইত্যাদি। ইরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই নভোমণ্ডল-ভূমণ্ডল সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে মাস ১২টি, এর মধ্যে ৪টি নিষিদ্ধ মাস; এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। ’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ৩৬)
অন্যত্র মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং এগুলোর মঞ্জিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ এগুলো নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত : ৫)
নতুন বছরের সঙ্গে আসে নতুন চাঁদ ও নতুন মাস।
নতুন চাঁদে নতুন মাসে রাসুলে আরবি (সা.) নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করতেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি ওই চাঁদকে আমাদের ওপর উদিত করো নিরাপত্তা, ঈমান, শান্তি ও ইসলামের সঙ্গে। (হে চাঁদ) আমার ও তোমার প্রতিপালক আল্লাহ।’
বর্ষ গণনার ইতিকথা : বহু প্রাচীনকাল থেকে সন গণনা প্রচলিত। আরবদের মধ্যে গোত্রগত বিভাজনের কারণে নানা ধরনের বর্ষ গণনা করা হতো।
তবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো সাল বা বর্ষ ছিল না। বিভিন্ন প্রকারের এসব সনের মধ্যে নুহ (আ.)-এর বন্যা সন, ইয়েমেনের খ্রিস্টান বাদশাহ আবরাহা কর্তৃক কাবাঘর ধ্বংসের জন্য প্রেরিত হস্তিবাহিনীর নামে আমুল ফিল, আমুল ফুজ্জার, আমুল ফাতহ, হবুতি, লুই এবং খসরু সন উল্লেখযোগ্য।
এ ছাড়া আরবরা বণিক ছিল বিধায় আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে রোমান সনকে অনুসরণ করত। ব্যাবেলি সন চালু হয় সম্রাট বুখতে নসরের জন্ম তারিখ থেকে। মিসর ত্যাগ করে বনি ইসরাঈল যেদিন মুক্ত হয়, সে দিন থেকে তাদের সন গণনা শুরু ঈসা (আ.)-এর জন্মদিন থেকে খ্রিস্টাব্দ বা ইংরেজি সনের প্রচলন।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও উজ্জয়িনীর কিংবদন্তি রাজা বিক্রমাদিত্য খ্রিস্টপূর্ব ৫২ অব্দে ভারতবর্ষে বিক্রমাব্দ প্রচলন করেন। রোমীয়, ব্যাবেলীয়, ইংরেজি, ইরানি, হিন্দুস্তানি প্রত্যেকটি সনের সূচনাতে কোনো না কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা আছে।
হিজরি বর্ষের প্রবর্তন : হিজরতের ১৭ বছর পর দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়, তখন অনেক নতুন ভূখণ্ড ইসলামী খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাষ্ট্রীয় কাগজপত্র ইত্যাদিতে সাল-তারিখ উল্লেখ না থাকায় অসুবিধা হতো। আর তখন কুফার গভর্নর ছিলেন আবু মুসা আল আশয়ারি (রা.)। তাই তিনি প্রশাসনিক কাজের অসুবিধার কথা জানিয়ে সন ও তারিখ নির্ধারণের আবেদন করেন। সে আবেদনকে গুরুত্ব দিয়ে এবং প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে ফারুক আজম (রা.) একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করেন।
যেহেতু নবী করিম (সা.)-এর হিজরতেই ইসলামের পূর্ণতা লাভ, কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র গঠন এবং মানব ইতিহাসে নবদিগন্তের সূচনা করে, তাই সে সভাতেই প্রিয় নবী (সা.)-এর হিজরতের বছরকে সন গণনার বছর হিসেবে নির্ধারণের জন্য আলী (রা.) পরামর্শ দেন।
আরও পড়তে পারেন-
- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান
- ইসলামের আলোকে নারীর কর্মপরিধি
- সালাম: উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষার অন্যতম বাহন
- বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ: বাস্তবতা ও অপপ্রচার
- সকালের ঘুম যেভাবে জীবনের বরকত নষ্ট করে
পবিত্র মহররম মাস থেকে ইসলামী বর্ষ হিজরি সালের শুরু করা এবং জিলহজ মাসকে সর্বশেষ মাস হিসেবে নেওয়ার পরামর্শ দেন উসমান (রা.)। সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। আর তখন থেকেই ইসলামী বর্ষ বা হিজরি সন গণনার শুরু। আর বর্ষ গণনায় বিভ্রান্তি লক্ষ্য করে স্বয়ং রাব্বে করিম মানবজাতির সংশোধনের জন্য সুরা তাওবার উপর্যুক্ত আয়াত হিজরিতের দশম বর্ষে নাজিল করেন। আয়াতে হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম, সপ্তম মাস রজব, ১১তম মাস জিলকদ আর ১২তম মাস জিলহজ বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
হিজরতের দিনক্ষণ : প্রিয় নবীজি (সা.)-এর মক্কা মুকাররমা থেকে মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরতের ঘটনা মুসলমানদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হিজরত মানে ছেড়ে যাওয়া, পরিত্যাগ করা; দেশান্তর হওয়া ও দেশান্তরিত করা। পরিভাষায় হিজরত হলো ধর্মের জন্য এক স্থান ত্যাগ করে অন্য স্থানে চলে যাওয়া।
সর্বোপরি মহান আল্লাহ তাআলার আদেশ পেয়ে নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা মুকাররমা থেকে মদিনা শরিফের উদ্দেশে হিজরত করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ৮ রবিউল আওয়াল মদিনা মুনাওয়ারার পার্শ্ববর্তী কোবায় পৌঁছান তিনি।
২৭ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ১২ রবিউল আওয়াল জুমার দিনে নবী করিম (সা.) মদিনা মুনাওয়ারায় প্রবেশ করেন। তিনি যখন মদিনা শরিফে প্রবেশ করেন, তখন তাঁকে বরণ করার জন্য তাঁর উটের দড়ি নিয়ে আনসারি সাহাবিদের মাঝে টানাটানি শুরু হলো।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘উট ছেড়ে দাও। যেখানে সে বসবে, সেটাই হবে আমার বাসস্থান। তাকে এমনই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ উট বনু নাজ্জার গোত্রের এলাকায় গিয়ে দাঁড়াল, যা ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নানার বাড়ি।
এই গোত্রের আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর বাড়ির সামনে গিয়ে উট বসে পড়ল। এখানেই নবীজি (সা.)-এর বাসস্থান নির্ধারণ করা হলো। এখানেই গড়ে উঠেছে মসজিদে নববী ও মদিনাতুর রাসুল বা রাসুলের শহর। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া; জাদুল মাআদ; তারিখুল ইসলাম)
মূলত, হিজরতের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত ঘটনা স্মারক বানিয়ে হিজরি সাল প্রবর্তিত হয়।
উম্মাহ২৪ডটকম:এমএ