গল্পটি হজরত লোকমান (আ:)-এর। কে ছিলেন লোকমান? মোটাদাগে তাঁর একটি পরিচয় দেয়া যাক তবে। তিনি মিসরের অধিবাসী ছিলেন। ছিলেন একজন হাবশি কৃতদাস। হাবশি বলা হতো আবিসিনিয়ার অধিবাসীদের। আবিসিনিয়ার বর্তমান নাম- ইথিওপিয়া
এটি পূর্ব আফ্রিকার একটি দেশ। লোহিত সাগরের পশ্চিম তীরে এর অবস্থান। লোহিত সাগরের পুব পারে ইয়েমেন ও সৌদি আরব।
লোকমান আ. ইথিওপিয়ান হলেও মিসরের অধিবাসী ছিলেন। তিনি হযরত দাউদ (আ:)-এর সময়ের মানুষ। জানা যায় তিনি দাউদ (আ:)-এর রাজ্যে একজন বিচারপতি ছিলেন। কোনো কোনো মতে ছিলেন- প্রধান বিচারপতি। শারীরিক অবয়বে তিনি ছিলেন বেঁটে। গায়ের রঙ বেজায় কুচকুচে। নাক ছিল উঁচু এবং বোঁচা। ঠোঁট মোটা। তিনি নবী ছিলেন না। ছিলেন একজন মহাজ্ঞানী। পবিত্র কুরআন মজিদে তাঁর নামে রয়েছে একটি সূরা। তিনি তাঁর সন্তানকে উপদেশ দিয়েছিলেন। সে উপদেশ মহান আল্লাহ তায়ালা এতই পছন্দ করলেন, সে উপদেশ উল্লেখ করে দিলেন মহাগ্রন্থ আল কুরআনে, সূরা লোকমানে। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁকে দান করেছেন-হেকমত। এই সূরার দ্বিতীয় আয়াতেই এ হেকমতের কথা আল্লাহ তায়ালা নিজেই বর্ণনা করেছেন- ‘নিশ্চয় আমি লোকমানকে হেকমত দান করেছি।’
হেকমত সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার ২৬৯ নম্বর আয়াতে বলেছেন- ‘তিনি যাকে ইচ্ছা হিকমত দান করেন এবং যাকে হিকমত দান করা হয় তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয় এবং বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরাই শুধু শিক্ষা গ্রহণ করে।’
এ আয়াতের আলোকে বলা যায়- লোকমান (আ:) কে সীমাহীন কল্যাণ দান করেছেন মহান রব।
সেই কল্যাণের ঔজ্জ্বল্যে তিনি উপদেশ দিতেন মানুষদের। তার আসর জমজমাট হতো মানুষের আগমনে। তাঁর জলসা হতো পরিপূর্ণ। একদিন তিনি একটি মজলিসে উপদেশ দিচ্ছিলেন। এমন সময় একজন রাখাল তাঁকে উদ্দেশ করে বলল- তুমি তো লোকমান, তুমি কি বনু হাসহাসের গোলাম নও?
তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি তাই। লোকটি আবার প্রশ্ন করল- তুমি কি বকরি চরাতে না?
জবাবে লোকমান বললেন- হ্যাঁ, চরাতাম।
লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল- তুমি কি কালো বর্ণের লোক নও?
জবাব দিলেন তিনি- আমি যে কালো বর্ণের তা তো দেখতেই পাচ্ছ ভাই। এখন তুমি আমাকে কী বলতে চাও বলো!
লোকটি বলল- তাহলে তুমি কী করে এমন মর্যাদা লাভ করলে?
জবাবে লোকমান বললেন- সত্য কথা বলা এবং বাজে কথা না বলার কারণে আমি এ মর্যাদা লাভ করেছি।
এবার গোড়ার কথায় আসি। সেই দুটো গুরুত্বপূর্ণ বস্তুর গল্পে।
ক্রীতদাস ছিলেন লোকমান। তিনি বকরি অর্থাৎ ছাগল চরাতেন। একদিন তার মনিব তাঁকে বললেন- তুমি একটি বকরি জবাই করবে। সেই বকরির মাংসের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট দুটো টুকরো আমার জন্য নিয়ে আসবে।
লোকমান জবাই করা বকরির হৃদপিণ্ড এবং জিহবা নিয়ে আসলেন। কিছু দিন পর মনিব তাঁকে মনিব একই রকম আদেশ করলেন। বললেন- বকরির মাংসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট দুটি টুকরো আনবে আমার জন্য।
লোকমান এবারও সেই আগের দুটো টুকরো অর্থাৎ হৃৎপিণ্ড এবং জিহবাই নিয়ে এলেন।
মনিব বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন- কি ব্যাপার? কি ধরনের কাজ হলো এটি? যা উৎকৃষ্ট তা-ই নিকৃষ্ট হয় কী করে!
জবাবে লোকমান বললেন- এ দুটো যখন ভালো থাকে তখন দেহের কোনো অঙ্গই এ দুটোর চেয়ে উৎকৃষ্ট নয়। আবার এ দুটি জিনিস যখন খারাপ হয়ে যায়, তখন সবচেয়ে নিকৃষ্ট জিনিস এ দুটোই হয়ে থাকে।
মনিব বিস্ময় দৃষ্টি তুলে চেয়ে রইলেন লোকমানের দিকে।
উচ্চ কণ্ঠে এটি স্বীকার করে নিতে হবে- মাংসের এ দুটো খণ্ড বকরির চেয়ে মানুষের জন্য আরো আরো গুরুত্বপূর্ণ। আরো বেশি মূল্যবান! কেমন মূল্যবান! আসা যাক তবে হৃদপিণ্ড বা হৃদয়ের কথায়। একজন মানুষের ভালো যা তার সবই বসত করে হৃদয়ে। সব খারাপের বাড়িও এটিই। সোজা কথা- ভালো খারাপ দুটোই মানুষের গভীরে বসত করে। বসত করে হৃদয়ের ভেতর।
আরও পড়তে পারেন-
- ধর্ষণ প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা
- কিশোর অপরাধ রোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে
- আদর্শ পরিবার গঠনে যে সব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরী
- ইসলামে সামাজিক সম্পর্ক এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখার গুরুত্ব
- মানুষ মারা যাওয়ার পর, তাঁর আত্মার কি হয় ?
একজন কবির ভাষায়- ‘হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো রাজ্য নেই।’ কোনো মানুষ যখন মানবিক হয়ে ওঠে। যখন অন্যের জন্য কাজ করে স্বার্থহীন এবং যখন হাত খুলে দান করেন কেউ। তখন তাকে বলা হয় একজন মহৎ হৃদয়ের মানুষ। নিকোলাস রাউ-এর একটি মতো এখানে উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন- একটি মহৎ হৃদয় যার আছে, সে অতুলনীয় ঐশ্বর্যের অধিকারী। সত্যি তাই। ঐশ্বর্যের সাতমহল হলো হৃদয়। সে-ই প্রকৃত ধনী যে হৃদয়ের দিক থেকে ধনী।
আরেকটি বিখ্যাত উক্তি উল্লেখ করা যায়- ‘একটি বৃহৎ হৃদয় বিশ্বের অনেক প্রতিভাবানের মস্তিষ্কের চেয়ে শ্রেয়।’ উক্তিটি বুলওয়ার লিটনের। কথাটি যথার্থ- অনেক মেধাবী মস্তিষ্ক একটি গভীর হৃদয়ের কাছে পরাজিত হয়!
মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এ হৃদয় বা আত্মাকে রুহ্ বলা হয়েছে। রুহ্ বা আত্মা একজন মানুষের বুকের ভেতর জ্যোতি হয়ে জাগ্রত থাকে এবং এ জ্যোতি সচ্ছল থাকে পবিত্র কুরআনের স্পর্শে।
একটি বিখ্যাত উক্তি আছে গীতার মধ্যে- ‘শরীরের চেয়ে ইন্দ্রিয় বড়, ইন্দ্রিয়ের চেয়ে মন বড়, মনের চেয়ে জ্ঞান বড়, জ্ঞানের চেয়ে যিনি বড় তার নাম আত্মা!’
মজার বিষয় হচ্ছে- হৃদয়ের কথাগুলো প্রকাশ্য করে জিহ্বা। জিহ্বা তখনই নড়ে ওঠে যখন হৃদয় তাকে জাগিয়ে তোলে। হৃদয়ের কথাগুলো বেরিয়ে আসে জিহবার মাধ্যমে। ভেতরের চিন্তা বাহিরে আসে জিহ্বার সাহায্যে। তাই বলতে পারি-জিহবা হলো হৃদয়ের নদী। সাদা কথায় বলা যায়- হৃদয় এবং জিহ্বা পরস্পরের বন্ধু। একটি আরেকটির আওয়াজ। একটি আরেকটির সেতু। ফ্রাংকলিন-এর একটি চমৎকার কথা আছে। কথাটি এমন- বোকাদের হৃদয় তাদের মুখের মধ্যে আর জ্ঞানীদের মুখ তাদের হৃদয়ের মধ্যে থাকে।
এখন প্রশ্ন তোলা যাক- আমাদের সমাজের মানুষগুলোর হৃদয় কেমন? আর কেমন অবস্থা জিহ্বার?
এর জবাব যদি খুব ছোট করে বলি, বলতে হয়- সমাজের বেশির ভাগ লোকের হৃদয় হিংসায় পরিপূর্ণ! বিদ্বেষে ভরা! পরস্পরকে উচ্ছেদের খেলায় মত্ত। প্রতিপক্ষকে নিঃশেষ করার তীব্র বাসনা হৃদয়ের ভেতর। প্রতিশোধ গ্রহণের ভয়ঙ্কর ইচ্ছে ঠাসাঠাসি করে আছে। একে অপরকে ল্যাঙ মারার কাণ্ড জমজমাট। অন্যকে বঞ্চিত করার পিপাসা ভয়ঙ্কর! সমাজের বেশির ভাগ মানুষের হৃদয়ে সত্যের বসবাস নেই। সত্য এক প্রকার নির্বাসিত। মিথ্যার ঢোল বাজানোর হাত ভীষণ শক্ত। জ্ঞান অর্জনের তৃষ্ণা নেই। সত্যের প্রতি ভালোবাসা নেই। ইনসাফের দিকে দৃষ্টি নেই। কোথায় ন্যায়বিচার। কোথায় মানবিক উচ্চারণ! কোথায় নীতিনৈতিকতার বেবেচনা! সাদা কালোর ব্যবধান কোথাও!
জিহবা এখন গীতের ঝর্ণা হয়ে উঠেছে। কথায় ঔদ্ধত্য! আচরণে অহঙ্কারী! কাজে নীতিহীন। কারো জিহবা চাবুক হয়ে আছে। যাদের শক্তি আছে তারাই জিহবাকে ব্যবহার করছেন খোলা তরবারির মতো।
জীবনানন্দ দাশের সেই কবিতাটি ভীষণ বাস্তব হয়ে উঠেছে-
‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই- প্রীতি নেই- করুণার আলোড়ন নেই,
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।’
এখানে একটু থামি। কবিতার বাকি অংশ পড়ব খানিক পর। এ ফাঁকে হৃদয়বান মানুষের কথা একটু বলে নেই।
সমাজে হৃদয়বান মানুষ নেহায়াতই কম এ কথা বলার জো নেই। সংখ্যায় আছে বেশ। কিন্তু হৃদয়বানদের মূল্য সামাজে বড়ই কম। খুব অল্প মূল্যের হয়ে আছেন তারা। ক্ষমতা তাদের হাত ছাড়া। সম্পদে টানাটানি। প্রতিপত্তির ভীষণ অভাব। তারা ঐক্যবদ্ধ নয়! সমাজের এই বেহাল দশা দেখে তারা নিজেদের হৃদয় নিজেরাই পোড়ায়! বিবেকের দংশনে তারা নীল হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্র কিংবা সমাজে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। এমনকি পরিবারেও নিষ্পেষিত।
এ শ্রেণীটিই সমাজের মধ্যবিত্ত। এরাই শেকড়ের সাথে নিজেদের জড়িয়ে রেখেছেন। সংস্কৃতি লালন করেন এরাই। রক্ষা করেন মূল্যবোধ। এই শ্র্রেণীটিই একটি সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করেন। কিন্তু এদের বিষয়ে সমাজের চোখ বড়ই অন্ধ। এবার কবিতার বাকি অংশ পাঠ করা যাক-
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহত্সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
কিন্তু না এসব হৃদয় শকুন ও শেয়ালের খাদ্য হতে দেয়া চলবে না। এদের মূল্য নিঃশেষ হতে দেয়া যাবে না। কেননা পৃথিবীটা জেগেই আছে এমন সত্যের উষ্ণতায়। সত্যের আনন্দে সূর্য জেগে ওঠে প্রতিদিন। রাত ও দিনের আবর্তনও সত্যকে ঘিরেই। আর কে না জানে শেষ পর্যন্ত সত্যেরই জয় হয়। যেমনটি আমাদের জাতীয় কবি আজাদ কবিতায় বলেছেন ভয় নাহি নাহি ভয়/মিথ্যা হইবে ক্ষয়/সত্য লবিবে জয়!
লেখক : কবি, শিশু সাহিত্যিক, কথাশিল্পী, গীতিকার ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ