দাসপ্রথার মতো স্পর্শকাতর এক বিষয় ঘিরে মূলত শুরু হয় আমেরিকার গৃহযুদ্ধ। ১৮৬১ সালে দাসপ্রথা সম্প্রসারণের সমর্থক দক্ষিণাঞ্চলীয় সাত অঙ্গরাজ্য গঠন করে কনফেডারেট স্টেট অব আমেরিকা। এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে ফেডারেল আর্মি বা কেন্দ্রীয় বাহিনী। যাদেরকে ইউনিয়ন আর্মিও বলা হতো। চার বছরের বেশি সময় ধরে চলা এই গৃহযুদ্ধে ছয় লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারান। আর সে যুদ্ধই কি না থেমে যায় একটি ডিশ তোয়ালের মাধ্যমে!
১৮৬৫ সালের ৯ এপ্রিল। ভার্জিনিয়ার অ্যাপোমটেক্সে সেদিন বিদ্রোহী কনফেডারেট সেনাদের ঘিরে ফেলে ইউনিয়ন বাহিনী। কনফেডারেট আর্মির জেনারেল রবার্ট ই. লি. বুঝতে পারলেন, আত্মসমর্পণের আলোচনা ছাড়া তার হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। তিনি ইউনিয়ন বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইউলিসিস এস. গ্রান্টের সঙ্গে দেখা না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির অনুরোধ জানান।
নিজের বার্তা নিয়ে তিনি আর. এম. সিমস নামক এক কর্মকর্তাকে পাঠান ইউনিয়ন সেনাদের কাছে। আত্মসমর্পণ বোঝাতে সে কর্মকর্তার হাতে দেওয়া হয় খাবারের পাত্র রাখার কাজে ব্যবহৃত সাদা রঙের একটি তোয়ালে। পরে এই তোয়ালের নাম হয়ে যায় ‘কনফেডারেটের যুদ্ধবিরতি পতাকা’।
বর্তমানে ‘দ্য আমেরিকান প্রেসিডেন্সি’ প্রদর্শনীতে এই তোয়ালের অর্ধেক রাখা আছে স্মিথসোনিয়ান’স ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব আমেরিকান হিস্ট্রির তৃতীয় তলায় একটি কাচের ঘরে। সময়ের সাথে সাথে সাদা তোয়ালের রং এখন অনেকটা হলদেটে হয়ে গেলেও মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর একটিতে ভূমিকার রেখে তা অবিনশ্বর হয়ে আছে।
আরও পড়তে পারেন-
- উলামায়ে কেরামের প্রতি মুফতি শফী (রাহ.)এর দরদমাখা নসিহত
- কম্পিউটার চিপ শিল্প: জলবায়ুর উপর ফেলছে ভয়ঙ্কর প্রভাব
- ইরানি বিজ্ঞানীকে যেভাবে হত্যা করে ইসরায়েল
- ব্যতিক্রমী এক ইসলামী আইন গবেষক
- ইবাদতের গুরুত্ব নিয়ে ঠাট্টা-তাচ্ছিল্য জঘন্য গুনাহ
তোয়ালেটি সম্পর্কে নর্থ আমেরিকান ভেক্সিলোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন-এর কর্মকর্তা, পতাকা গবেষক জেমস ফেরিগান বলেন, ‘এটি একটি জাতীয় সম্পদ। এটি সেই পতাকা, যার মাধ্যমে আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান ঘটানোর আলোচনা শুরু হয়েছিল।’
যুদ্ধবিরতির পতাকা—পরাজয়ের স্মৃতি?
১৮৬৫ সালের এপ্রিলে এই তোয়ালে প্রদর্শনের মাধ্যমে লি এবং গ্রান্টের মধ্যে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ বৈঠকের পথ তৈরি হয়। পাঁচদিন পর, জন উইলকস বুথ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনকে হত্যা করেন। এরপর উত্তর ও দক্ষিণের এই যুদ্ধ আরও এক বছরের বেশি সময় ধরে চলে। অবশেষে ১৮৬৬ সালের আগস্টে প্রেসিডেন্ট অ্যান্ডু জনসন আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। তবে অনেকেই তোয়ালে দেখিয়ে অ্যাপোমেটক্স কোর্ট হাউসে আত্মসমর্পণকে গৃহযুদ্ধের প্রকৃত সমাপ্তি বলে মনে করেন।
তবে এই তোয়ালেকে আত্মসমর্পণে ব্যবহারে অনিচ্ছুক ছিলেন আর. এম. সিমস। ১৮৮৬ সালের এক চিঠিতে আত্মসমর্পণে নিজের ভূমিকা বর্ণনা করেন সিমস। তিনি লেখেন, কর্নেল হুইটেকার (ইউনিয়ন বাহিনীর) আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, পতাকা হিসেবে ব্যবহার করা তোয়ালেটি সংরক্ষণের জন্য আমি তাকে দেব কি না।
সিমস জবাবে বলেন, এটি বহন করা এবং প্রদর্শন করাও যথেষ্ট অপমানজনক। আমি আপনাকে আমাদের পরাজয়ের স্মৃতি হিসেবে এটি সংরক্ষণ করতে দেব না।
তবে শেষ পর্যন্ত তোয়ালেটি ইউনিয়ন সেনাদের হাতে পড়ে। যুদ্ধের পর জেনারেল ফিলিপ শেরিডান জেনারেল জর্জ কাস্টারের স্ত্রী এলিজাবেথকে তার স্বামীর ‘বিশ্বস্ত সেবার প্রতিদানে’ যুদ্ধবিরতির এই ‘পতাকা’ দেন। তার মৃত্যুর পর এটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় জাদুঘরে দান করা হয়। ১৯৩৬ সাল থেকে তোয়ালেটি জাতীয় সংগ্রহ হিসেবে সংরক্ষিত। তবে পতাকাটির ঠিক অর্ধেক অংশ কোথায় তা এখনো রহস্য হয়েই আছে।
তোয়ালেই কেন?
ইতিহাস থেকে জানা যায়, আত্মসমর্পণের জন্য পতাকা হিসেবে সব সময়ই তোয়ালে, গামছা, চাদর বা বালিশের মতো গৃহস্থালীর জিনিসই ব্যবহার হয়েছে।
পতাকা গবেষক ফেরিগান বলেন, কারণ বিশ্বের কোনো বাহিনীই আত্মসমর্পণের জন্য কোনো পতাকা বানায় না। বিষয়টি মানসিকভাবে তাদের দুর্বল করে দিতে পারে। সুতরাং যখন যুদ্ধে কোনো কিছু নিজেদের পক্ষে যায় না, আত্মসমর্পণের প্রয়োজন হয় — তখন তোয়ালে বা এ জাতীয় কিছুই পতাকা হিসেবে ব্যবহারের জন্য খুঁজে নিতে হয়।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ